ভারত বা বাংলাদেশ থেকে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস মহামারির উৎস হয়েছে বলে দাবি করেছেন চীনা একদল বিজ্ঞানী। উহান থেকে দোষ সরাতে এমন চেষ্টা বলে দাবি করেছে সংবাদ মাধ্যম দি সান।
সম্প্রতি চীনের সাংহাই ইন্সিটিটিউট ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্স এর প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে, করোনাভাইরাস উহানে ছড়িয়ে পড়ার আগে গত ডিসেম্বরে ভারত উপমহাদেশে দেখা দিয়েছিল। তবে এই তত্ত্বে ত্রুুটি রয়েছে বলে ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
‘দ্য আর্লি ক্রিপটিক ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ইভলিউশন অব সারস-কোভ-২ ইন হিউম্যান হোস্টস’ শীর্ষক এই গবেষণায় উহানের ভেজা বাজার থেকে যে ভাইরাসটির উদ্ভব হয়েছিল বিজ্ঞানীদের এমন ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে।
গবেষণাটি মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটের এসএসআরএন.কম-এ গত ১৭ নভেম্বর ১৭ টি দেশের ভাইরাস স্ট্রেন নিয়ে পোস্ট করা হয়েছে।
ডাঃ শেন লিবিং-এর নেতৃত্বে ওই গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, করোনাভাইরাস স্ট্রেনের উদ্ভবের সন্ধানের প্রচলিত পদ্ধতি যেভাবে বেশ কয়েক বছর আগে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ইউনানানে ব্যাট ভাইরাস আবিষ্কারে ব্যবহার করেছিল তা এবার কার্যকর হয়নি। ফলে গবেষণাপত্রে গবেষকরা দাবি করেছেন যে এটি বিজ্ঞানীদের মহামারীর প্রকৃত উত্স শনাক্ত করতে বাধা তৈরি করে।
এ পদ্ধতির পরিবর্তে গবেষক দল একটি নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন যা প্রতিটি ভাইরাল স্ট্রেনে পরিবর্তনের সংখ্যা গণনা করে। তাদের দাবি সর্বাধিক রূপান্তরিত স্ট্রেনগুলি দীর্ঘ সময়ের জন্য থাকে। অন্যদিকে কম রূপান্তরিত স্ট্রেনগুলো কোভিড-১৯ এর মূল উৎসের কাছাকছি।
এর ভিত্তিতে ওই গবেষকদল ভারত-বাংলাদেশের পাশাপাশি করোনার সম্ভাব্য উৎস হিসেবে অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, ইতালি, গ্রিস, যুক্তরাষ্ট্র এবং চেক রিপাবলিকেরও নাম বলেছেন।
বাংলাদেশ ও ভারতের কয়েকটি শহরের দিকে ইঙ্গিত করে গবেষণাপত্রে আরও দাবি করা হয়েছে, এই ভাইরাসটি প্রথম সেসব শহরেই প্রথম মহামারি আকারে ছড়িয়েছে, যেসব শহরে জিনগত বৈচিত্র্য ছিল সবচেয়ে বেশি। এসব শহরের তরুণ জনগোষ্ঠী ও চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া ও এই ভাইরাসকে মানব শরীরে আক্রমণের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করেছে।
গবেষকরা দাবি করেছেন, গবেষণায় প্রাপ্ত ফল থেকে দেখা যাচ্ছে, মানবশরীরে সার্স-কোভ-২-এর প্রথম সংক্রমণ উহানে হয়নি। এই ভাইরাসের যেসব স্ট্রেইনের রূপান্তর সবচেয়ে কম হয়েছে সেসব স্ট্রেইনের তথ্য এবং স্ট্রেইনের বৈচিত্র্য ইঙ্গিত করে, ভারতীয় উপমহাদেশ থেকেই প্রথম এই ভাইরাস মানবশরীরে প্রবেশ করে থাকতে পারে, যা উহানের করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ারও তিন থেকে চার মাস আগেেই ঘটেছিল।
তবে গবেষণাপত্রটির কোনো প্রমাণ না থাকায় গবেষণাপত্র নিয়ে স্থির কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার সুযোগ নেই।
গবেষণা নিয়ে অন্যান্য দেশের বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি ভারতীয় বিজ্ঞানীরাও এ গবেষণা নিয়ে দ্বিমত জানিয়েছেন। ভারতীয় ভাইরোলজিস্ট মুকেশ ঠাকুর সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে বলেছেন, এই গবেষণায় তথ্য-উপাত্ত ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
অন্যদিকে, লস অ্যাঞ্জেলেসের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার জেনেটিকস ও বায়োস্ট্যাটিসটিকসের অধ্যাপক মার্ক সুচার্ড বলেন, এই গবেষণার জন্য ভাইরাল স্ট্রেইনের নমুনা সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি ‘অযৌক্তিক’। এ ধরনের নমুনা বিশ্লেষণ করে এই ভাইরাসের উৎস খুঁজে পাওয়াটা স্বাভাবিক নয়। অবশ্য তিনি চীনের গবেষকদের গবেষণা পদ্ধতিকে সম্ভাবনাময় বলেও মনে করেন। তবে একইসঙ্গে এর মধ্যে কিছু অনিশ্চয়তা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
ড. শেন লিবিং এসব সমালোচনাকেও স্বাগত জানিয়ে বলেন, সবার মন্তব্য ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই কেবল গবেষণাটিকে ‘যথার্থভাবে’ গ্রহণযোগ্য বা বাতিল করে দেওয়ার সুযোগ আছে।
এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য বলছে, চীনের উহান থেকে গত বছরের শেষ দিন, অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো কোনো মানুষের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া যায়। শুরুতে একে কোনো ধরনের ফ্লু ভাইরাস মনে করা হলেও সংক্রমণ ছড়াতে থাকলে বিজ্ঞানীরা জানান, এটি নতুন এক ধরনের ভাইরাস। অনেক গবেষণার পর জানা যায়, এটি সার্স ভাইরাসের নতুন একটি ধারা। পরবর্তী সময়ে একে সার্স-কোভ-২ বা করোনাভাইরাস নাম দেওয়া হয়। এই ভাইরাসে আক্রমণে সৃষ্ট রোগের নাম দেওয়া হয় কোভিড-১৯।
এখন পর্যন্ত বিশ্বের ২১৮টি দেশে ৬ কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষের শরীরে এই ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এই ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছে ১৪ লাখেরও বেশি মানুষ। এই ভাইরাসের সংক্রমণে গোটা বিশ্বই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।