চিত্রশিল্পী শাহনাজ সুলতানা অষ্ট্রেলিয়াতে থিতু হলেও হ্নদয়ে-অন্তরে বাংলাদেশকেই ধারণ করেন। বাংলার প্রকৃতি, নদী, খাল-বিল, পাখপাখালি, মেঠো প্রান্তর, পাহাড়, ফুল তাঁর জীবনের বোধ আর ভালোবাসার সাথে মিশে আছে। গহীন অরণ্যের নিস্তব্ধতা, মেঘমালা, সমুদ্র বিলাপ, কুয়াশার কান্না, একখন্ড নরম বিকেল তাঁকে নিয়ে যায় কোনো এক অজানা দেশে। যাপিত-জীবনের এ সবকিছু শিল্পীর কাছে ভীষণ প্রিয়।
চিন্তায়, মননে এবং সৃজনে চিত্রশিল্পী শাহনাজ নিরবধি এক নদীর মতো। আপন মনে সর্বদা বেয়ে চলেন। তাইতো রঙ-তুলি নিয়ে বসলেই প্রকৃতিই বড় বেশি উঠে আসে তাঁর আঁকা চিত্রে। তাঁর চিত্রকর্মগুলো এক কথায় স্বপ্ন-ভাবনার অপূর্ব সংমিশ্রণ। প্রতিটি ছবিতেই লুকিয়ে থাকে অব্যক্ত গল্প, আর আত্মসুখ অনুসন্ধান। তাঁর আঁকা ছবির দিকে তাকালেই যে কাউকে দ্রুত গভীরে টেনে নিয়ে যাবে। কেননা ছবিতে রঙের অপূর্ব ব্যবহারের সাথে মনের সুপ্ত নিবেদনগুলোর অনন্য প্রকাশ থাকে। সেই অনবদ্য প্রকাশ যে কারো হ্নদয়ে প্রসন্নতা ছুঁয়ে দেবে বলাবাহুল্য।
করোনার দুর্যোগের মাঝেও এই শিল্পী নিজের অপূর্ব সব শিল্প সমাহার নিয়ে হাজির হয়েছিলেন চিত্র প্রেমিকদের কাছে। শিল্পীর একক চিত্র প্রদর্শনী হয়ে গেল গত ১৭-২৩ জানুয়ারি, রাজধানীর ধানমন্ডিস্থ সফিউদ্দিন শিল্পালয়ে। আয়োজনটা এখানেই করা হয়েছিল। সংষ্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছিলেন প্রধান অতিথি। ‘কালান্তর’ শিরোনামে এই আয়োজনে প্রদর্শিত হয় শিল্পীর সম-সাময়িক সময়ে আঁকা মোট ৩২টি ছবি। সব ছবিগুলোই ছিল এক্রাইলিক রঙের মাধ্যম আঁকা।
ছবিগুলোর শিরোনামগুলো একটু দেখে নিই- ১. সম্ভাবনার এপাশ ওপাশ, ২. ওই অজানার জানা, ৩. অপরাজিতা পরম্পরা, ৪. মুক্তির অন্বেষণে, ৫. দৃশ্যমান অদৃশ্য, ৬. জীবনের প্রতিফলন, ৭. সঞ্চিত সুখের সন্ধানে, ৮. সময়ের প্রেক্ষাপট, ৯. অজানা ওই অদূরে, ৯. অজানায় গল্পগাঁথা, ১০, মানুষের দুর্ভোগ, ১১. ছায়া ১, ১২. ছায়া ২, ১৩. সুখ, ১৪. ধূসর মগ্নতা, ১৫. প্রশান্তি ১, ১৬. প্রলয়ের প্রতিবিম্ব, ১৭. মুগ্ধতার বিশুদ্ধতায় পরম্পরা, ১৮. আশা শৃঙ্খল, ১৯. সময়ের প্রেক্ষাপট ২, ২০. আত্মমগ্নতায় নবজাগরণ। এ ছাড়াও ছিল এ থার্স্টি বার্ড, মোগল মিনিয়েচার, ইন্টিমেট-এসব শিরোনামের মিনিয়েচার।
আসুন, চিত্রশিল্পীর ভাবনা খানিকটা শেয়ার করি। ‘সম্ভানার এপাশ ওপাশ’ শিরোনাম ছবির বর্ণনা এরকম ‘মূর্ত বিমূর্ত সময় সংকট ও সম্ভাবনার এক সুনিপূণ ধারাপাত প্রকৃতির। মনোরাজ্যে ঘোর অমবস্যার তমাশাচ্ছন্ন আঁধার কেটে যখন মন নিমজ্জিত হয় হতাশার ঘনকালো অস্তরণে, তখন ঠিক তখন আশা নামক সম্ভাবনার প্রদীপ শিখায় মন প্রজ্জ্বলিত হয়। বিস্তৃতির জীর্ণ ও পুরাতন সংস্কারের জানালার চৌকাঠে আটতে থাকা কাটা বৃক্ষের ঘোর লাগানো স্মৃতিকে পেছনে রেখে আশা আলোর নতুন সম্ভাবনার সরল সজীব আশালতায় জাগে স্বর্ণালী আলোর আভা। নবজাগরণের নবচেতনায় আন্দোলনে মন কালের নতুন আশায় প্রজ্বলিত হয়। সম্ভাবনার নব আলোয় বিকশিত হয় অন্তর আত্মা। সময়ের জয়গান।’
‘জীবনের প্রতিফলন’ চিত্রের বর্ণনায় বলেছেন, ‘জীবন এক অপরিকল্পিত ধারাপাত। এর শ্রোত আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায় লৌকিক ও অলৌকিক, সামাজিক ও আনুষ্ঠানিক নিয়ম অনিয়মের ভিন্ন ধারায়। নারীর জীবনধারা নির্ধারিত হয় পরিবার ও পরিজনের ইচ্ছায়। এখানে আত্মার চাওয়া প্রায় মূল্যহীন। লৌকিকতার আস্তরণে মনের মাঝে বিরাজমান হয় ধূসর। উজ্বলতার আড়ালে বিবর্ণ সত্ত্বা উপলব্দি করতে হয় একান্তে। শিল্পীর সৃজনশীলতায় সমাজের ছায়া বিরাজ করে। এই চিত্রকর্মটি সংগ্রামের অজানা যাত্রার গল্প প্রতিফলিত করার চেষ্টা।’
‘আত্মমগ্নতায় নবজাগরণ’ শিরোনামে ছবির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে- ‘এক অখন্ড বাসনা নিয়ে জীবনের পথে পথে এগিয়ে চল। আশা নামক অন্তমিলের সন্ধানে নিত্য প্রতীক্ষায় বেঁচে থাকা। জলের একটু পরশে যেমন জগতে প্রাণের সঞ্চার ঘটে তেমনি জীবনের মোহনায় এতটুকু স্বপ্নপূরণ নতুনভাবে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়। একবিন্দু আশাজাগা নিয়ে স্বপ্ন সময়কে বদলে দেয়। জীবনবোধ জাগে নতুন আবেদন।’
যে কথা আগেই বলেছি শাহনাজের একক চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালেদ এমপি। বাণীতে তিনি লিখেছেন- ‘একজন শিল্পী শাহ্নাজ সুলতানার চিত্রশিল্পীর চিত্রকলা, আমাদের দেশে নারী জাতির চেতনা এবং স্বাধীন অনুভূতি প্রকাশের সুন্দরতম উদাহরণ। বাংলাদেশের শিল্পীসমাজ আমাদের গর্ব। তাঁদের সুন্দর স্বাধীন শিল্প রচনাতে তৈরি হোক আমাদের আগামীর স্বপ্ন।’
যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত শিল্পী আবু জাফর শাহনাজকে নিয়ে দুছত্র লিখেছেন। তাঁর মতে, শাহ্নাজের শিল্প নির্মাণ বিশেষভাবে আলোড়িত করে রঙ বিন্যাস, রং ও রেখার ছন্দে অবচেতনে গল্প, কোথায় যেনো মনের গহীন বনে অশনি সংকেতের তীব্র বেদনা। ব্যথিত করে সমাজের প্রায় অর্ধেক মানুষ। শাহনাজের চিত্রকলা বলে তাদের কষ্ট আর ভালোবাসা আর অসহনীয় গল্পকথা। শাহনাজের এ আগমন বাংলাদেশ শিল্পসমাজ নতুন আলোকে দেখবে শিল্পসুন্দর, অনেক ভাবনালোকে ছবি গল্প। এই শিল্পীর আঁকা প্রতিটি ছবিই যে নান্দনিকতাই ভরপুর ছিল তা বলাই বাহুল্য। শিল্পী যা একেঁছেন তা তার মনের আয়নায় দেখা উপলব্দি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আঁকা ছবিটি কিন্তু এক কথায় অসাধারণ। রঙ-তুলির অপূর্ব ছোঁয়ায় বঙ্গবন্ধুকে তিনি তুলে ধরেছেন ‘চেতনায় অবিনশ্বর তুমি হে মহান নেতা’ এই শিরোনামে। ছবিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে পরিপূর্ণভাবে। এ ছবির আকর্ষণটাই অন্যরকম।
নিজের অপূর্ব সব সৃষ্টি নিয়ে কী বলেন মৃদুভাষী শিল্পী? প্রদর্শনীর শেষ দিনে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে জিজ্ঞাসা ছিল। নরম কণ্ঠে উত্তর ছিল-‘আমি সবসময়ই মনে করি আমার জন্ম হয়েছে কেবলই ছবি আঁকার জন্য। একারণেই ছবি আঁকার মধ্যেই নিজের প্রাণ খুঁজে পাই। ছবি আঁকার ক্ষেত্রে কখনই আগেভাগে চিন্তা করি না। থিম নিয়েও ভাবিনা। কেবলই ক্যানভাসের সামনে বসে আঁকতে থাকি।’ আরও বললেন, ‘আসলে যখন ক্যানভাসের সামনে বসি তখন হৃদয়ের মাঝে যে অনুভূতি হয় সেটাই প্রকাশ করি। আঁকতে থাকি। কোন ছবি কোথায় গিয়ে শেষ হবে তাও কখনই ভাবি না। আঁকতে ইচ্ছে হলে আঁকি আর আাঁকি।’
প্রদর্শনী উপলক্ষ্যে বের হওয়া সুভ্যেনির-এ শিল্পী বলেছেন, ‘আমার চিত্রকর্মে বিভিন্ন সময়ে মনের গভীর অনুভূতিগুলোই প্রকাশ পেয়েছে বেশি। আমি বিশ্বাস করি শিল্পসৃষ্টি হলো মন ও আত্মার প্রতিচ্ছবি। প্রকৃতির প্রতি মুগ্ধ থেকে সৃষ্টির খেয়াল আপন মনে বর্ণবিন্যাস আর আর নিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় চিন্তাভাবনার সংযোজন করে আপনাদের কাছে অনুভূতি প্রকাশ করে নিজের কাজকে সহজ সরল চিন্তার মাধ্যমে তুলে ধরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। আপনাদের ভাল লাগলে আমার শিল্প চেষ্টা ও চেতনার প্রকাশ সার্থক হবে।
শাহনাজ সুলতানা ৯০ দশকের প্রারম্ভে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাশ করেছেন। বড় হয়েছেন ঢাকা শহরেই। এক কন্যা সন্তানের জননী। করোনা দুর্যোগ কেটে গেলে চলে যাবেন অষ্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে। তবে বাংলার প্রকৃতির টানে আবার আসবেন। ফের আসবেন নতুন রঙের সুষমা নিয়ে। শুভকামনা রইলো এই শিল্পীর প্রতি।