‘কেউ কেউ চলে গেলেও থেকে যায়’। সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির একটি টুইট ছিল এরকম। আরেকটি টুইট বার্তায় তিনি বলেছিলেন, তোমার যা বলার আছে তা বলো এবং চলে যাও। খাশোগির জীবনে শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে।
এ যুগের হালাকু খান সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানদের হাতে তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। তার আগে নির্যাতনে অঙ্গহানির শিকার হতে হয়েছে, তার শরীরকে টুকরো টুকরো করা হয়েছে। পুরোপুরি মেরে ফেলার আগে তারা তার সেই আঙুলগুলো বিচ্ছিন্ন করেছে যে আঙুল দিয়ে তিনি তার দেশ সৌদি আরবের জন্য ভালোবাসা ও ভয়ের কথা লিখতেন। তারা তার সেই জিহ্বা বিচ্ছিন্ন করেছে যে জিহ্বা দিয়ে তিনি স্বাধীনতা ও স্বাধীন মতের কথা বলতেন। শেষ পর্যন্ত তারা গান শুনতে শুনতে তার শরীর টুকরো টুকরো করেছে এবং একটি ব্যাগে ভরে অপরাধস্থল থেকে দূরে নিয়ে লুকিয়ে রেখেছে।
চরম হাস্যকর যুক্তি দিয়ে সৌদি আরব দাবি করে যে, ইস্তাম্বুলে সৌদি দূতাবাসে ১৫ জনের সঙ্গে হাতাহাতির সময় খাশোগির মৃত্যু হয়েছে, যে ১৫ জনকে তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে সৌদি আরবে ফেরত আনার জন্য পাঠানো হয়েছিল। এর আগে অবশ্য দাবি করা হয়, খাশোগি সৌদি আরবে ফিরতে চেয়েছিলেন। যদি তাই হয় তাহলে সেই ১৫ জনকে কেন পাঠানো হয়েছিল যাদের মধ্যে গোয়েন্দা সংস্থা, নিরাপত্তা বাহিনী ও সৌদি রাজকীয় বাহিনীর সদস্যরা ছিল? এমনকি এমন কয়েকজন ছিল যারা ক্রাউন প্রিন্স যাকে সংক্ষেপে এমবিএস বলা হয় তার ঘনিষ্ঠ! যদি বুঝিয়ে-শুনিয়েই কাউকে দেশে ফেরত আনতে হয় তাহলে সৌদি ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধানকেই বা কেন পাঠাতে হলো! তাকে কেনই বা সার্জিক্যাল করাত নিয়ে যেতে হবে?
আমরা যদি আমাদের মাথা শূন্যও করে ফেলি, কিছুই বুঝি না এমন অবস্থায় মস্তিষ্ককে নিয়ে যাই, সৌদিদের অবিশ্বাস্য গল্প বিশ্বাসও করি; তবু কিছু প্রশ্ন মাথায় আসে: যদি খাশোগিকে দেশে ফিরিয়ে নেয়ার মতো মহৎ উদ্দেশ্যই হয়ে থাকে তাহলে হাতাহাতির ঘটনা কেন ঘটল? কেন তার গোঙানির শব্দ পাওয়া গেল? ওই ১৫ জন কী করছিল যে তার আর্তচিৎকার শোনা গেল? ওই ১৫ জন তাকে তার প্রিয় দেশ আর প্রিয় মানুষগুলোর কাছে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য এমন কী করল যে সেখানে এক ভয়াল পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল? একটি সৌদি সূত্র রয়টার্সকে নিশ্চিত করেছে যে, এমন একটি পরিবেশে সৃষ্টি হয় যে, তারা তাকে শ্বাসরোধ করতে বাধ্য হয় যে কারণে খাশোগি মৃত্যুবরণ করেন।
এ দাবি আরো কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়: একজন চিকিৎসকের উপস্থিতিতে এটা কীভাবে সম্ভব হলো? তিনি কেন তাদের থামাতে চেষ্টা করলেন না? কেন তার জন্য তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে তার মৃত্যু নিশ্চিত হতে দেখলেন? যদি তাকে মেরে ফেলাই তাদের উদ্দেশ্য না হয়ে থাকে, তাহলে কীভবে সেটা সম্ভব হলো? অবশ্যই তাদের বানানো গল্পটা যেরকম তাতে আমি এরকম আরো অনেক নিরীহ প্রশ্ন করতে পারি। কেন তাকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নেয়া হলো না? যদি খাশোগিকে সৌদি আরবে ফেরত নেয়ার মতো নিরীহ ইচ্ছাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য হয়, তাহলে ‘দুর্ঘটনাক্রমে’ তার মৃত্যুর পর কেন তারা এমন ব্যবস্থায় গেলো না যাতে শরিয়া আইন অনুযায়ী মৃতদেহের সম্মানজনক সৎকার হয়?
সৌদিদের বানানো গল্প এ গল্পের রচয়িতাদের মতো শুধু গর্দভরাই বিশ্বাস করবে। জামাল খাশোগি কোন মুষ্টিযোদ্ধা ছিলেন না যে তিনি পেশীর ব্যবহার করে হাতাহাতিতে জড়িয়ে যাবেন। তিনি অবশ্যই একজন যোদ্ধা ছিলেন, তবে তার যুদ্ধ ছিল কলম দিয়ে। এমনকি তার কলমযুদ্ধও ছিল খুবই নিরীহ গোছের এবং শান্তিপূর্ণ। দেশের জন্য ভালোবাসা এবং আশঙ্কা থেকে তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল তার প্রিয় দেশে এমন কিছু সংস্কার হোক যাতে সৌদিরা অহঙ্কারী যুবরাজের বোকামি ও বেপরোয়া সিদ্ধান্ত থেকে রক্ষা পায়।
তিনি সরকারের পরিবর্তন চাননি, রাজতন্ত্রের পতনও চাননি। কারণ তিনি আল-সৌদ ছাড়া সৌদি আরবকে কল্পনাও করতে পারতেন না। তবে তিনি বিশ্বাস করতেন যে দীর্ঘমেয়াদে সৌদি আরবে একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্রই বিকল্প, তবে সেটাও হতে হবে খুব ধীরে ধীরে।
তিনি আরো জনপ্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থায় বিশ্বাস করতেন। তিনি মনে করতেন শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রই একমাত্র বিকল্প যা আরব অঞ্চলকে সম্প্রদায়গত ও জাতিগত দ্বন্দ্ব-সংঘাত থেকে রক্ষা করতে পারে, মানুষকে জুলুম-নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে পারে এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে। এ কারণে ‘আরব বসন্তের’ সময় তিনি যেমন আনন্দে আত্মহারা ছিলেন, তেমনি প্রতিবিপ্লবীরা আবার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর তিনি কষ্ট পেয়েছেন। তবে, তরুণ প্রজন্মের উপর আস্থা ছিল তার এবং বিশ্বাস করতেন যে, একদিন সেই বিপ্লব আসবে।
তার খুনিরা তাকে হত্যা করে এবং দেহটা টুকরো টুকরো সন্তুষ্ট হলেও তারা জানতো যে তার ভুত তাদেরকে তাড়া করে বেড়াবে। তাই তারা ভুয়া গল্প ছড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা বলার চেষ্টা করছে যে, তার মতো একজন ভয়ঙ্কর মানুষ ১৫ জন খুবই নিরীহ মানুষের সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তিতে জড়িয়েছিল, যে মানুষগুলো তাকে শুধু তার দেশে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিল। তবে, তারা জানাতে ভুলে গেছে যে ৬০ বছর বয়সী মহাশক্তিধর মানুষটি একাই ১৫ জনের শরীরের কোন কোন জায়গায় আঘাত করতে পেরেছিল যে তাদেরকে বাধ্য হয়ে তাকে মেরে ফেলতে হয়েছে।
বোকা সৌদিরা যখন বুঝল যে তাদের গল্প কেউ বিশ্বাস করছে না, সারাবিশ্বে নিন্দার ঝড় উঠেছে, তখন গল্পটা সংশোধনের উদ্যোগ নিলো তারা। গল্পকার এবার জানালো, তাদের পরিকল্পনা ছিল যে খাশোগি যদি দেশে ফিরতে অস্বীকৃতি জানান, তাহলে তারা প্রথমে তাকে ইস্তাম্বুলের একটি অ্যাপার্টমেন্টে এবং পরে সৌদি আরবে নিয়ে যাবে। মানে কী! অপহরণ। এভাবে বানানো গল্পকে একটু ঠিকঠাক করতে গিয়ে বিষয়টাকে তারা আরো গুবলেট করে ফেলেছে। এখন তারা একটি ভিন্ন দেশের দূতাবাস থেকে একজনকে অপহরণের মতো অপরাধ পরিকল্পনার কথা সারাবিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে। এটি এমন এক অপরাধইচ্ছা যার বিরুদ্ধে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
আজকের যুগের হালাকু খান হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সৌদি যুবরাজ নিজের চাচার বিরুদ্ধে ক্যু করে নিজেকে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে ঘোষণা করে গত দুই বছর ধরে নিজের ইমেজ সৃষ্টির লক্ষ্যে জনসংযোগ কোম্পানিগুলোর পেছনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করেছেন। যুবরাজ এমন একটা ইমেজ সৃষ্টির চেষ্টা করছেন যাতে মনে হয় তিনি এক মহান সংস্কারক যিনি একদিকে তার দেশকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসবেন, অন্যদিকে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখবেন।
কিন্তু, জামাল খাশোগির রক্তে ভেসে গেছে ইমেজ সৃষ্টির লক্ষ্যে খরচ করা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। বরং প্রমাণ হয়েছে যে, এমবিএস হচ্ছে সন্ত্রাসবাদের উৎস এবং তিনি নিজে একজন পশ্চাৎপদ গোত্রনেতা যিনি রক্তাক্ত প্রতিশোধে বিশ্বাস করেন। সেই প্রতিশোধও শুধু তার সমালোচনা থেকে উৎসারিত। প্রকৃতপক্ষে, আগের রাজাদের থেকে তিনি ভিন্ন কিছু না যারা শুধুমাত্র রক্তারক্তি এবং চৌর্য্যবৃত্তিতে বিশ্বাসী। যে কোম্পানিগুলোর পেছনে যুবরাজ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করেছেন, আজ তারা সারাবিশ্বের সংবাদপত্রে ক্রাউন প্রিন্সকে নিয়ে শিরোনামগুলো বন্ধ করতে পারছে না।
খাশোগিকে হত্যা করে এমবিএস একটি কণ্ঠ স্তব্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন কোটি কণ্ঠ উচ্চকিত। নিজের কর্তৃত্ব বা পেট্রোডলার দিয়ে তিনি তা বন্ধ করতে পারছেন না। আরব বিশ্বে এখনো জীবিত বিবেকের মানুষ বেঁচে আছে যারা সত্য-মিথ্যা যাচাই করে চলে। এখনো এমন অনেক মানুষ আছে যারা মূল্যবোধকে মূল্য দেয়, মানবাধিকারকে সবার উপরে জায়গা দেয়। এমন মানবাধিকার সংগঠন আছে যারা উপসাগরীয় টাকার থোড়াই পরোয়া করে। বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার পত্রিকা আছে যারা খাশোগির সত্য উচ্চারণকে তুলে ধরছে। যুবরাজের টাকা কিছুই করতে পারছে না।
জামাল খাশোগির রক্ত আজ আবার তার দেহধারণ করেছে। এবার তিনি আরো বেশি দীর্ঘজীবী হবেন যার মাধ্যমে প্রথম জীবনে যা করতে পারেননি এবার সেটা দেখতে পারবেন।
খাশোগির রক্ত অন্যায্যতার প্রতিক সৌদি সিংহাসনকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। তার রক্তে দুর্নীতিবাজ শাসকদের তখতে-তাউশ কেঁপে উঠেছে। আজ না হোক, আগামীকাল এদের পতন অনিবার্য।
আমরা আজ জামাল খাশোগিকে শহীদ সাংবাদিক বলছি। কিন্তু, আপনি চলে যাননি। আপনার কথাগুলো এখন বিশ্বকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। আপনি চলে গেলেও আপনার উপস্থিতি এখন আরো বেশি শক্তিশালী। আপনার ভাষাতেই বলি, আপনি সেই গুটিকয় মানুষদের একজন যারা চলে গেলেও নিশ্চিতভাবেই থেকে যান।
(মিডল ইস্ট মনিটর থেকে অনুদিত। সংক্ষেপিত)
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)