ঢাকা শহরে প্রতিদিন ব্যক্তিগত বা গণপরিবহনে যারা চলাচল করেন, বিশেষ করে যাদের কর্মস্থল ও বাসার দূরত্ব অনেক– তাদের কাছে এই শহর বস্তুত এক নরক। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় বসে থাকা, গরমে ঘামে অস্থির হওয়া, অব্যাহত হর্নে বিরক্ত হওয়া এবং ধীরে ধীরে জীবনীশক্তি ক্ষয় হওয়া মানুষের সংখ্যা অগণিত। অনেকেই ভাবেন এই শহরটা ছেড়ে যেতে পারলেই বাঁচা যায়। প্রায় দুই কোটি কিংবা তারও চেয়ে বেশি মানুষের ভারে ন্যূব্জ পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ এই মহানগরী নিজেও হাঁফ ছেড়ে বাঁচে যখন দুই ঈদে অর্ধেকের মতো মানুষ এই শহর ছেড়ে চলে যায়। এক অন্যরকম ঢাকা আবিষ্কার করেন এখানে থেকে যাওয়া মানুষেরা। তখন তারা ভাবেন, সারা বছর এমন থাকলে কতই না ভালো হতো!
কিন্তু তা তো হবার নয়। সবাই ঢাকামুখী। বছরের পর বছর ধরে ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলা হলেও সেই উদ্যোগ বাস্তবায়নের কোনো আলামত নেই। ফলে মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে পিষ্ট এই শহর প্রতি বছরই উঠে আসে বিশ্বের বসবাসঅযোগ্য শহরের তালিকায়।
বলা হয়- ঢাকা শহর এতটাই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে বা গড়ে তোলা হয়েছে যে, এখানে যেকোন নতুন আইডিয়া বা ধারণা অথবা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বেশ কঠিন। বিশেষ করে যোগাযোগ খাতে। ঢাকা শহরে জ্যামে আটকে থেকে ক্লান্ত আর বিরক্ত অনেক মানুষই হয়তো ভাবেন বা স্বপ্ন দেখেন যে, আহা যদি রাস্তাটাই চলতো!
ফিউচার ট্রান্সপোর্ট বা ভবিষ্যতের পরিবহন ধারণায় এটি এখনও কল্পনা যে, পথচারীরা ঘর বা অফিস থেকে বের হয়ে রাস্তায় উঠবেন আর রাস্তাটি চলে যাবে তার গন্তব্যে। তবে স্বপ্ন বা কল্পনা হলেও এটি অসম্ভব কোনো ব্যাপার নয়। কেননা, মানুষ যা চিন্তা করে বিজ্ঞান সেটি করে দেখায়।
যানবাহনের পাশাপাশি ঢাকা শহরের রাস্তাও চলবে–এমন এক ধারণার কথা আমাদের বলছেন এমন একজন মানুষ, যিনি বিজ্ঞানী বা প্রকৌশলী নন, যিনি পরিবহন বিশেষজ্ঞও নন। তিনি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক আবু সাইয়ীদ।
সম্প্রতি তিনি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে চলন্ত রাস্তার আইডিয়াটা শেয়ার করেন। পরে এটির একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণাপত্র দেখান বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সুবাদে আবু সাইয়ীদের চলন্ত রাস্তার আইডিয়াটা জানা ও বোঝার চেষ্টা করি।
চলন্ত রাস্তার ধারণাগত এবং কারিগরি বিষয়ে তিনি বুধবার থেকে শিল্পকলা একাডেমির ভাস্কর্য গ্যালারিতে শুরু করেছেন মডেল প্রদর্শনী। চলবে বৃহস্পতিবার রাত ৮টা পর্যন্ত। আবু সাইয়ীদের ধারণা মতে, মাত্র দুই থেকে তিন বছরেই এ চলন্ত রাস্তা নির্মাণ করা যায়। আর ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করেই, অর্থাৎ পদ্মা সেতু নির্মাণের চেয়ে অনেক কম খরচেই ঢাকা ও আশপাশের এলাকার ৪০০ কিলোমিটার চলন্ত সড়ক নির্মাণ করা সম্ভব–যেখানে ৪০ কিলোমিটার গতিতে যাত্রীরা গন্তব্যে যেতে পারবেন।
আবু সাইয়ীদ বলেছেন, এই চলন্ত সড়কে পাঁচটি সুবিধা পাওয়া যাবে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যানজটমুক্ত অবস্থায় গন্তব্যে যাওয়া, পরিবেশ সুরক্ষা এবং ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা হ্রাস।
ধারণাপত্রে বলা হয়, চলন্ত রাস্তা সড়কের মাঝ বরাবর এবং রাস্তার দুই পাশে স্থাপন করা যাবে। রাস্তার মাঝ বরাবর এ চলন্ত সড়ক নির্মাণে ৩২-৪৪ ফুট জায়গার প্রয়োজন হবে। রাস্তার মাঝে ডিভাইডার বরাবর ৮ ফুট জায়গা প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এর দুই পাশে প্রতি লেইনের জন্য ৬ ফুট করে জায়গা চলন্ত রাস্তার জন্য বরাদ্দ থাকবে। দুই থেকে পাঁচ মিনিট পর পর ১০ থেকে ১৫ সেকেন্ডের জন্য এই চলন্ত রাস্তা নির্দিষ্ট স্টপেজে থামবে বিভিন্ন ক্রসিংয়ে ভিন্ন দিক থেকে আসা চলন্ত রাস্তা একে অন্যকে উড়ন্ত পদ্ধতিতে ক্রস করতে পারবে।
এই ধারণাটি এখনও একটি স্বপ্ন। কিন্তু এর বাস্তবায়ন অসম্ভবও নয়। তবে এই পদ্ধতি বাস্তবায়ন করতে গেলে সরকারকে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে, তার মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াবেন গণপরিবহন মালিকরা। কারণ এই শহরে হাজার হাজার বাস চলাচল করে এবং যেখানে বহু মানুষের রুটিরুজি নির্ভরশীল।আবার পরিবহন খাতে যে কী ভীষণ ক্ষমতাবানরা আছেন তা দেশবাসী জানে। ফলে এমন কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন খুবই চ্যালেঞ্জিং হবে যেখানে ওই মাফিয়াদের স্বার্থহানির আশঙ্কা রয়েছে। তবে এরও একটা সমাধান আছে। তা হলো, এই রাস্তা নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণসহ এই খাতের যাবতীয় উন্নয়ন পরিবহন সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করা।
আরেকটি প্রতিপক্ষ বিভিন্ন দাতা সংস্থা যারা রেল ও নৌপথের বদলে সড়ক উন্নয়নে অর্থায়ন ও ঋণ দিতে আগ্রহী,যাতে বেশি করে গাড়ি বিক্রি করা যায়। কিন্তু চলন্ত রাস্তা নির্মাণ ও উন্নয়নে সেই দাতাদেরই সহায়তা নেয়া যায়। তবে এই খাতে তারা অর্থ দেবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
কিন্তু যদি সত্যিই ঢাকা শহরকে বদলে দিতে হয়, তাহলে এরকম একটি নতুন ও চ্যালেঞ্জিং পরিকল্পনা নিয়েই এগোতে হবে।এই শহরে কোনো ধরনের ট্রাফিক সিস্টেম যে কাজ করছে না, তা এরইমধ্যে প্রমাণিত। তবে শুরুতেই অনেক বড় প্রকল্প না নিয়ে পরীক্ষামূলক বা পাইলট আকারে করা যায়। যেমন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর গোলচত্বর থেকে বিমানবন্দরের গেট পর্যন্ত এরকম একটি চলন্ত রাস্তা তৈরি করা যেতে পারে, যাতে ঢাকার যেকোন স্থান থেকে যাত্রীরা পাবলিক বাসে এসে নেমে লাগেজসহ ওই সড়কে উঠে সরাসরি বিমানবন্দরের গেটে চলে যেতে পারেন। কেননা নিজস্ব বাহন বা ভাড়ায়চালিত অটোরিকশা অথবা প্রাইভেট কার না থাকলে গোলচত্বর থেকে বিমানবন্দরের গেট পর্যন্ত পৌঁছানো কঠিন। এখানে সফলতা পেলে ঢাকার কোনো একটি ব্যস্ত এলাকায়, ধরা যাক ফার্মগেট থেকে শাহবাগ পর্যন্ত আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়।
তবে এটা ঠিক, চলন্ত রাস্তা নির্মাণ যেমন চ্যালেঞ্জ অনেক, তেমনি এর সম্ভাবনাও ব্যাপক। বড় স্বপ্ন বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ যে বড় হবে, সেটিই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হলো সেই চ্যালেঞ্জটা আমাদের সরকার নেবে কি না, নাকি চলন্ত রাস্তার ধারণাটিকে আমরা একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার স্রেফ ফ্যান্টাসি হিসেবেই দেখব?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)