আমাদের রবীন্দ্রনাথ। তিনি সব হতে আপন। আত্মার শান্তি। প্রাণের আনন্দ তিনিই। সেই কবি রবীন্দ্রনাথের পর, চিত্রী রবীন্দ্রনাথ জয়ী হয়েছেন, মানুষের প্রেমেই সময়ের স্রোতে। পাণ্ডুলিপির পাতায় পাতায় তাঁর আঁকিবুঁকি নজরে এসেছে বিশ্ববাসীর। তাঁর গানও সাগরপারী দিয়েছে, অনেক আগেই। নাটক, প্রবন্ধ ও জীবনী লেখার পর সিনেম্যাটিক অভিযোজনে, বিশেষ করে চিত্রনাট্যে রবি ঠাকুরের লেখা চিরকালের কাছের। বর্তমানে খুব কম মানুষকেই ভারতীয় সিনেমার ক্রমবিকাশে লেখক রবীন্দ্রনাথের নিবিড় যোগ আর অবদান নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়।
বাংলা ও বাঙালির মননে যিনি সার্ধশতবর্ষ পেরিয়ে গেলেও আজও একই তেজে দীপ্ত, তাঁকে আর যে ভাবেই হোক প্রাসঙ্গিক করে তোলা যায় কী না, এই আলোচনায় যাওয়া মানে নিজের নিজেকে বাঙালির থেকে দূরে রাখাই শ্রেয়। কারণ তিনি আমাদের মধ্যে বহমান। এখনও আমরা জাতে বাঙালি আর তালে রবি সেই “… তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে…”। সেই তালে তাই বছরের পর বছর ধরে সুর বেঁধে চলেছে একের পর এক সিনেমা। গল্প, স্ক্রিপ্ট, গান, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক কিংবা ট্রানজিশন, ভরসা সেই রবি ঠাকুরেই।
সময়ের বদল এসেছে, মানুষের চারিত্রিক আয়োজনে পরিবর্তন এসেছে, নির্বাক ছবির সময় থেকে সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল সেন হয়ে ঋতুপর্ণ- অপর্ণা- সৃজিত-শিবপ্রসাদে এসেও বড়পর্দায় কিন্তু আজও সেই নামটিই রয়ে গিয়েছে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’, কাহিনী-গল্প-গান-নাটকে এখনও তিনিই বাংলা ছবির অবলম্বন। খুব কম মানুষকে ভারতীয় অঞ্চলের সিনেমার ক্রমবিকাশের ধারায় রবীন্দ্রনাথের নিবিড় যোগ নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়। সিনেম্যাটিক অভিযোজনে, বিশেষ করে চিত্রনাট্যে, গানে রবি ঠাকুরের লেখা চিরকালের কাছের, পছন্দের।
অথচ তিনি সিনেমা সম্পর্কে বলেছিলেন, সিনেমা যেহেতু একটি নতুন আর্ট ফর্ম, সে কারণেই নাকি তাঁর সাহিত্যের ক্রীতদাস হয়ে থাকা উচিত নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়ে আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন’ আর ‘জেনারেল লাইন’ দেখে উদ্বুদ্ধ হন ঠিকই, কিন্তু সিনেমার সমালোচনায় মুখর থেকেছেন নিজে সর্বদা। তাই তো পরবর্তীতে নির্বাক ছবিতে ইন্টার টাইটেলের বেশি ব্যবহার নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন তিনি স্বয়ং।
ভারতীয় সিনেমাতেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যের ব্যবহার শুরু হয় নিবার্ক ছবির সময়েই। নরেশ মিত্র আর নাট্যজন শিশির ভাদুড়ি বেশকিছু ছবি তৈরি করেছিলেন রবি ঠাকুরের লেখা নির্ভর করে, ভাব অবলম্বনে। ‘মানভঞ্জন’ (১৯২৩), রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প অবলম্বনে এটিই ছিল প্রথম চলচ্চিত্র। এরপরে আসে নাভাল গান্ধীর ‘বলিদান’ (১৯২৭)। নাট্যজন শিশির কুমার ভাদুড়ির পরিচালনায় ‘বিচারক’ (১৯২৯) এবং ‘বিসর্জন’ (১৯২৯) একই সময়ে তৈরি দুটি ছবি নির্মিত হয়।
পরিচালক মধু বসু তৈরি করেন ‘গিরিবালা’ (১৯২৯)। পর পর দুটি ছবি তৈরি হয় রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির উপরেই। কবিগুরু নিজে মধু বসুকে সাহায্য করেছিলেন চিত্রনাট্য তৈরিতে, শোনা যায়। রবীন্দ্রনাথের কাব্যের ব্যবহারে তৈরি হয় ‘মানভঞ্জন’ এবং ‘দালিয়া’ ছবি। এমনকি ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘তপতী’ তৈরি হওয়ার কথা হলে, তাতে মুখ্য চরিত্রে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। তবে এ ছবির কাজ শেষ হয়নি।
১৯৩২ সালে রবীন্দ্রনাথের পরিচালিত একমাত্র ছবি তৈরি হয় ‘নটীর পূজা’। মঞ্চস্থ হওয়ার সময় শুটিং করা এই ছবি অনেকটা পরীক্ষামূলকই বটে। শান্তিনিকেতনে তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে দুটো স্টেশনারি ক্যামেরা সহযোগে মাত্র পাঁচদিনে শুটিং হয়েছিল ‘পূজারিণী’ কবিতার নাট্যরূপ। নরেশ মিত্রের পরিচালনায় নির্বাক ছবি ‘নৌকাডুবি’ (১৯৩৮) তৈরি হয় পরবর্তীতে।