এক
আমি অনেককেই ইমদাদুল হক মিলনের ব্যাপারে নাক সিটকাতে দেখেছি। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে যারা মিলনের ব্যাপারে লোক দেখানো নাক সিকটানোর ভনিতা করেন তাদের মধ্যে ভন্ডামিতে পূর্ণ এক ধরনের বৈপরীত্যও লক্ষ্য করেছি। এই বৈপরীত্যটা ক্যামন? প্রায়ই ক্ষেত্রেই মিলনের লেখা নিয়ে এক ধরনের অজ্ঞতা রয়েছে এদের। এরা মিলনের লেখা না পড়েই তার সম্পর্কে মন্তব্য করে বসেন।
গত ২৯-৩০ বছর ধরে একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি তাহলো ইমদাদুল হক মিলনের লেখা সম্পর্কে বিন্দু বিসর্গ না জেনেই ঢালাও মন্তব্য, কার্ভ ডায়লগ দিতে দেখেছি তথাকথিত আঁতেলদের। নব্বই, মধ্য নব্বইয়ের দিকে অনেক লিখিয়েকে দেখেছি বইমেলায়, শাহবাগ, আজিজ মার্কেটের আড্ডায় ইমদাদুল হক মিলনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য জ্ঞান করে সাহিত্য থেকে খারিজ করে দিতে। এরা নয়িম করে , নষ্ঠিার সঙ্গে পাঁচওয়াক্ত তাকে বাজেয়াপ্ত করত।
মিলনের লেখা কালের বিচারে টিকবে কি টিকবে না, সাহিত্য বিচারে তার লেখা কোনো লেখাই না এ জাতীয় তুলনামূলক বিচারে প্রতিদিন তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টায় সুমো কুস্তিগীরদের মতো এরা মত্ত থাকত। এদের কেউ কেউ তার লেখা পাঠ শেষে পাস মার্ক দেয়ার দুঃসাহসও দেখাত। কেউ কেউ আবার পত্র-পত্রিকায় মিলনের লেখার ভুলত্রুটি (!) , সঙ্গতি-অসঙ্গতি (!!) তুলে ধরে লেখালেখি করে নিজেদের নাম চৌদ্দ / ষোল পয়েন্ট বোল্ডে ছাপাত আর কলার ঝাঁকিয়ে পরিচিতি মহলে সমালোচক তকমা জাহির করত। এরা মূলত ইমদাদুল হক মিলনের দু’চারটে বিচ্ছিন্ন গল্প-উপন্যাস পাঠ করে মিলন-বিরোধীদের খপ্পড়ে পড়ে তাকে এক হাত নেয়ার ধান্দায় ব্যস্ত থাকত। শুধু কী তাই ? এদের এ ধরনের অন্তঃসার শূন্য লেখা ছাপা হলে এরা নিষ্ঠার সঙ্গে গাটের পয়সা খরচ করে তা ফটোকপি করে পরিচিতদের মধ্যে বিলিবণ্টন করত আর বলত, এই তোমরা আমার লেখাটা পড়ছে ? পড়ো কিন্তু। এদের ভাবটা এ রকম, অনেক খেটে খুটে ইমদাদুল হক মিলনকে খারিজ করে একটা লেখা লিখে তারা বাংলা সাহত্যিরে উদ্দার করেছে।
ইমদাদুল হক মিলনকে সাহিত্য থেকে খারিজ করে দেয়ার মহান দায়িত্বপ্রাপ্ত সেসব স্বঘোষিত মিলন বিরোধী আঁতেলদের পরবর্তীতে অবলীলায়, বিনা বাক্য ব্যয়ে খারিজ হয়ে যেতে দেখেছি। এদের মধ্যে কেউ কেউ যারা চিকন বুদ্ধির ( পুরনো ঢাকায় এই প্রজাতিদের বলা হয় গিরিঙ্গি, চালবাজ ) তারা অন্যোপায় হয়ে লাইন পরিবর্তন করে অর্থাৎ তওবা পড়ে মিলনীয় সাহিত্যে সমর্পণ করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার দুর্নিবার কসরত করে সাহিত্যিক হওয়ার খায়েশও পূরণ করেছে। অবশ্য এ জাতীয় সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে দু-একটি চিহ্নিত গণমাধ্যম। আমি ছিয়াশি সাল থেকে চিকন বুদ্ধির এই প্রজাতিদের তুমুল উল্লম্ফন দেখেছি।
আমি নিজের চোখে এ রকম দু’চারজন গজায়মান লেখককে দেখেছি যারা উঠতে-বসতে ইমদাদুল হক মিলন আর হুমায়ূন আহমেদের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করতেন। কিন্তু পরবর্তীতে এরা সাংবাদিকতায় ঢুকে পত্রিকাকে ব্যবহার করে (পদলেহনের কথা না হয় বাদই দিলাম) হুমায়ূন-মিলনীয় স্টাইলকে অন্ধ অনুকরণ করে লেখালেখি ও সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ‘আলুটা-মুলাটা সাপ্লাই দিয়ে’ নামি-দামি পুরস্কার বাগিয়ে বইমেলায় ভাড়া করা স্তাবক নিয়ে ঘোরাঘুরি করছেন। ভাবতে বিস্ময় জাগে, মিলন – হুমায়ূন বিরোধিতায় বুঁদ হয়ে থাকা তাদের কেউ কেউ এখন দিব্যি লেখক ,তাও আবার জনপ্রয়ি !
একবার কথা প্রসঙ্গে মিলন ভায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম , অকারণে মিলন বিরোধিতাকারীদের ব্যাপারে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
মিলন ভাই কথা বলেন নিজস্ব ঢঙে। সেই ঢঙের সঙ্গে একটা অলিখিত হাসিও থাকে। তার এই কথা বলার ভঙ্গিটা আমার ভালো লাগে। আমার কথা শুনে মলিন ভাই হাসলেন। বিক্রমপুরের ঘ্রাণ মাখানো কণ্ঠে মিলন ভাই যা বললেন তার মানে দাঁড়ায় এ রকম, সাহিত্যে বড় বড় কথা বলে , একে তাকে খুচিয়ে নিজের জায়গা করা যায় না। এখানে কাজ দিয়ে টিকে থাকতে হয়। ধর্মপ্রাণ মানুষ যেমন নিষ্ঠার সঙ্গে ইবাদত করেন, প্রার্থনা করেন ইমদাদুল হক মিলনও তেমনি এক জীবনে লেখালেখির এই কাজটা করে গেছেন। লেখালেখির ব্যাপারে একাই লড়াই করেছেন। তা-ও কী খালি হাতে। এটা ভাবাই যায় না। ইমদাদুল হক মিলনের দুঃখ-কষ্টে মোড়ানো শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য লেখালেখির পক্ষে ছিল না। নিরন্তর অভাব, সংগ্রাম, নিরবচ্ছিন্ন যাতনার মধ্যে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে তার জীবন তার লেখার মধ্যেই আমি সেসবের সন্ধান পেয়েছি।
ইমদাদুল হক মিলন কখনো রাখ-ঢাক করে কথা বলেন না । নিজের সম্পর্কে অযথা ঢাকঢোলও পেটান না। যা সত্য তা-ই নির্বিঘ্নে বলেন। সেলফ-এডিট কখনো তিনি করেন না। জীবনের নির্মম সত্য উন্মোচন করেন। ‘বাবার মৃত্যুর কারণ’ স্মৃতিচারণে খুব খোলামেলাভাবে তিনি তার সেই জীবনের কথা লিখেছেন, ‘বহু ভাড়াটেওয়ালা একটি একতলা বাড়ি ছিল জিন্দাবাহার থার্ড লেনে। সেই বাড়ির একটি ঘরে ভাড়া থাকতাম আমরা। তখন আমার আট ভাই বোন, কখনও কখনও খালা এবং তার মেয়েও থাকে। কাজের আশায় এসে থাকে কোনও কোনও মামা, সৎ খালাতো ভাইয়েরা, বাবার দুজন সৎ ভাইয়ের কেউ না কেউ।
এমনকি নানাবাড়ির দিককার লতায়-পাতায় সম্পর্কিত কোনও কোনও আত্মীয়ও বাবা খুব বড় চাকুরে ভেবে তার সাহায্যের আশায় আমাদের ওইটুকু একঘরের সংসারের এসে উঠত। অথচ বাবা মিউনিসিপ্যালিটির সামান্য কেরানী। তবু তার কিছু পরিচয়, যোগাযোগ ছিল। আজিজ নামের একজনকে মিউনিসিপ্যালিটিতে ভুঁইমালির চাকরি দিয়েছিলেন বাবা। হামেদ মামাকে লিয়াকত অ্যাভিনিউর এক থান কাপড়ের দোকানে সেলসম্যানের কাজ দিয়েছিলেন। বাবার দু’জন সৎ ভাইয়ের কেউ সদরঘাটের ফুটপাতে কাটা কাপড় বিক্রি করে, কেউ পাউরুটির দোকানদার।’
ভুঁইমালির কাজ? সেলসম্যান? ফুটপাতে কাটা কাপড় বিক্রি? কিংবা পাউরুটির দোকানকদার? আমি নিশ্চিত মিলন ভায়ের জায়গায় অন্য কেউ হলে এসব তথ্য গোপন করে যেতেন। কিন্তু মিলন ভাই ইজ মিলন ভাই।
‘বাবা ছিলেন পরোপকারি, সৎ এবং নিরীহ ধরনের মানুষ। গ্রাম থেকে যেই আসত তাকে নিজের সংসারে রেখে সাহায্য সহযোগিতার এক প্রবণতা তার ছিল। নিজে মেঝেতে শুয়ে আমার মায়ের চাচাত ভাইদের চৌকি ছেড়ে দিতে বহুবার দেখেছি আমি। অন্যের উপকার করতে গিয়ে দু’দুবার মিউনিসিপ্যালিটি থেকে তার চাকরি চলে যায়। একে সামান্য বেতনের কেরানীর চাকরি তার ওপর অত বড় সংসার তার ওপর চাকরি চলে যাওয়া, ইস কী যে দুঃখকষ্টের দিন সেসব! প্রতিদিন সকালে মাকে দেখতাম সংসারে আজ চুলো জ্বলবে কী জ্বলবে না ওই নিয়ে উৎকণ্ঠিত। বাবাকে দেখতাম চারদিক থেকে মার খাওয়া বোবা জন্তুর মতো দিশেহারা।’
একই লেখায় তিনি অকপটে বলছেন, ‘জিন্দাবাহার এলাকায় তখনও ইলেকট্রিসিটি পৌঁছায়নি। সন্ধ্যাবেলা গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা লাইটপোস্টের মাথায় হারিকেনের মতো একখানা আলো জ্বালিয়ে যেত বাড়িওয়ালা। তার হাতে থাকত কেরোসিনের বালতি, কাঁধে মই। মই বেয়ে উপরে উঠে আলো জ্বালাত সে। ওই সামান্য আলায়ও বেশ আলোকিত হতো গলিটি। কিন্তু আমাদের সেই জীবনে বিন্দুমাত্র আলো ছিল না, জীবন ছিল গভীর অন্ধকারে। বেশিরভাগ দিন সকালে নাশতা হতো না আমাদের। তিনবার বাজার সারার পরও পেটে গভীর খিদে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতাম আমি।’
ইমদাদুল হক মিলনকে সবসময় দেখেছি একান্ত নিজের মতো থাকতে। নিজেকে খুব বড় লেখক ভাবেন এমন হামবড়া ভাবও কখনো তাকে তার শত্রুরাও করতে দেখেননি। তবে তিনি সবসময় ধোপ ধুরস্থ, ফ্যাশনেবল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে স্মার্ট লেখক তিনি। এখন পর্যন্ত তা বহাল রেখেছেন। সাধারণ বাঙালির যা গড় উচ্চতা তিনিও তা-ই ধারণ করেন কিন্তু লেখালেখির বাইরেও চলনে-বলনে, পোশাক-পরিচ্ছদে তিনি তার উচ্চতা নিয়ে গেছেন অন্যদের চেয়ে অনেক ওপরে। তার এই অনন্য উচ্চতা তাকে এনে দিয়েছে এক ভিন্ন মাত্রা। যেখানে ইমদাদুল হক মিলনের প্রতিদ্বন্দ্বী তিনি নিজে।
দুই
ইমদাদুল হক মিলন তার যাপিত জীবনে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই না গেছেন সেটা তার স্মৃতিচারণমূলক লেখাগুলোতে পাওয়া যায়। শুধু কি স্মৃতিচারণমূলক লেখায়? না, তার অসংখ্য লেখায় এসব প্রসঙ্গ উঠে এসেছে, যেগুলো পাঠ করে কখনো কখনো চোখের পানি আটকে রাখাও কষ্টকর হয়ে পড়ে। ১৯৭৯ সালের অক্টোবর ভাগ্যের খোঁজে জার্মানিতে গিয়েছিলেন। ‘কোথায় ছিল পরাধীনতা’য় ইমদাদুল হক মিলন তার প্রবাস দিনের দুঃখমাখা কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছেন, ‘একদিন বিকেলে কাজ শেষ করে বাসস্ট্যান্ডে বসে আছি। সিনডেলফিনগেন থেকে স্টুটগার্টে ফিরব। আমার পাশে বসে আছেন একজন জার্মান বৃদ্ধা। ততদিনে টুকটাক জার্মান বলতে শিখেছি। বৃদ্ধা আমাকে টুকটাক কথা জিজ্ঞেস করছেন, আমি জবাব দিচ্ছি। তিনি যাবেন এক জায়গায়, আমি অন্যত্র। দু’জনের দু’বাস। বৃদ্ধার বাস আগে চলে এলো। বাসে ওঠার আগে তিনি আমার হাতে একটা পাঁচ মার্কের কয়েন গুঁজে দিলেন। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি বাস চলে গেছে। কয়েক হাতে নিয়ে হতভম্ভ হয়ে বসে থাকি। বৃদ্ধা আমাকে এতই দরিদ্র ভেবেছেন যে পাঁচটি মার্ক ভিক্ষে দিয়ে গেলেন। কয়েনটা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হু হু করে কেঁদেছিলাম আমি।
ইমদাদুল হক মিলনকে আমি নানা কারণে শ্রদ্ধা করি। পছন্দও করি। অসম্ভব স্মার্ট, ব্যক্তিত্ববান আর স্ট্রেইট কাট কথা বলেন। কখনো কখনো তাকে দেখে আমার ভ্রম হয়, এই মানুষটি যদি ইউরোপে জন্মাতেন! দীর্ঘদিন মিলন ভাইকে জানি, চিনি তাতে করে বলতে পারি, তিনি যার সঙ্গে কথা বলবেন তার মধ্যে এক ধরনের ভাবান্তর হতে বাধ্য। মিলন ভায়ের মধ্যে একটা অদ্ভুত জাদু আছে। এই জাদুর ছোঁয়ায় তিনি সবাইকে মুগ্ধ করতে পারেন। মানুষকে মুগ্ধ করতে পারা এক ধরনের সুন্নত। এটা মিলন ভাই পারেন। সবাই পারে না।
মিলন ভায়ের সাহিত্য নিয়ে মূল্যায়ন করা কঠিন। কঠিন এই কাজ করার মহান (!) দায়িত্ব সমালোচকদের। তাদের মাথায় অনেক বুদ্ধি-বিচার। একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে আমি মিলন ভায়ের সব লেখায় মুগ্ধ। ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’, ‘ভালবাসার সুখ-দুঃখ’ ‘ভালবাসার গল্প’, ‘হে প্রেম’, ‘যত দূরে যাই’, ‘দিনগুলি’, ‘অভিমান পর্ব’, ‘এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’ থেকে শুরু করে ‘যাবজ্জীবন’, ‘কালাকাল’, ‘পরাধীনতা’, ‘পরবাস’, ‘অধিবাস’, ‘নিরন্নের কাল’, ‘কালোঘোড়া’, ‘নদী উপাখ্যান’, ‘ভূমিকা’, ‘ভূমিপত্র’, ‘বাঁকা জল’, ‘নূরজাহান’, ‘দেশভাগের পর’ তার সব লেখায়ই আমি বুদ হয়ে থাকি।
লেখক যখন একজন ভালো মানুষ হয়ে যায় তখন সেই লেখকের কোনো লেখাই আর খারাপ লাগে না। কারণ সেই লেখকের লেখায় আমি আমার প্রয়োজনীয় সব পাই। সব। সব। সব। আমি অনেক স্বঘোষিত মিলন বিরোধিতাকারীদের মেনি বেড়ালের মতো তার সামনে মিঁউ মিঁউ করতে দেখেছি কারণ-অকারণে। তিনি জীবন জীবিকার প্রয়োজনে কিংবা ব্যর্থতার গ্লানি মুছতে জীবনের না মিলানো হিসাব মিলানোতে দশ বছর মিলানোতে ‘কামলা’ দিতে হয়েছে আমাকেও। তখন দেখেছি প্রবাস জীবনের বিচিত্র চলচ্চিত্র করুণ উপাখ্যান। প্রবাস জীবনের কষ্টকর প্রতিটি মুহূর্তে আমাকে সাহস জুগিয়েছেন ইমদাদুল হক মিলন। প্রেরণাও জুগিয়েছেন।
জাতি হিসেবে ইতালিয়ানরা খুবই সহমর্মী। সমব্যথী তো বটেই। তাদের চলন-বলন, আচার-ব্যবহার আড্ডাবাজ বাঙালিদের মতোই। ইতালিয়ান বুড়োবুড়িরা সারাদিন বার-ক্যাফেতে বসে আড্ডা মারে। তাস খেলে। বিড়ি-সিগারেট খায়। আর কথায় কথায় গালাগাল করে। আরও একটা ব্যাপার, এরা অনর্গল হাত-পা, শরীর নাচিয়ে নাচিয়ে কথা বলে। কেউ যদি ইতালিয়ানদের হাত-পা বেঁধে রাখে তাহলে এরা কথা বলতে পারবে না। শুধু মুখ দিয়ে নয়, এরা হাত-পা দিয়েও কথা বলে। আমাদের পুরান ঢাকার মানুষরা যেমন আন্তরিক, রসিক এরাও তেমনি। ইতালিয়ান ভাষা অনেকটা মিউজিকের মতো। এদের কথা শুনলে গান শোনার কাজ হয়ে যায়। ওরা কথায় কথায় প্রেগো, গ্রাৎসে বলে। বলে বেনভেনুতো। প্রেগো মানে স্বাগতম। গ্রাৎসে মানে ধন্যবাদ। বেন ভেনুতো মানে অভিনন্দন।
বাঙালিরা ইতালিতে গেলে চলতে-ফিরতে পারার জন্য যতটা ভাষার প্রয়োজন ততটুকুই শেখে। কেউ কেউ এর ব্যতিক্রম। আমিও টুক-টুাক ইতালিয়ান শিখেছিলাম। একদিন বিক্রমপুরের এক ছেলে মিলানোর বাংলা পাড়া কাইয়াৎসোতে আমাকে বলল, ভাই কী ইমদাদুল হক মিলনরে চিনেন? আমি তো অবাক হয়ে গেলাম। এই মিলানোতেও মিলন ভায়ের ভক্ত!
পেরকে নো? (কেনো নয়?) লুই কনোশে মে (উনি আমাকে চেনেন)। আমার কথা শুনে কম বয়সী ছেলেটি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ভাই আপনারে আমি এক কাপ কফি খাওয়াইতে চাই? কেনো আপনি আমাকে কফি খাওয়াবেন? আপনে মিলন ভাইরে চিনেন হের লাইগা। ছেলেটির চোখে মুখে সারল্য। ছেলেটা আমাকে প্রায় জোর করেই বারে নিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, কী করো? ছেলেটি বলল, ফুল বিক্রি করি।
ইতালিতে ফুল বিক্রি খুবই কষ্টের কাজ। সারারাত হেঁটে হেঁটে বার-রেস্টুরেন্ট-ডিসকোটেকাতে ফুল বিক্রি করা খুব পরিশ্রমের কাজ। ভাগ্য ভালো হলে এক রাতে একশ-দেড়শ দেড়শ ইউরো আর কপাল খারাপ হলে সেনসা। সেনসা মানে খালি হাতে ঘরে ফেরা। ইতালীতে বলাই হয়, ফুল বিক্রির টাকা আর রক্ত বেচা টাকা একই কথা। অবশ্য প্রবাসে সব কাজের ক্ষেত্রেই এই কথা খাটে। কফি খেয়ে বেরিয়ে এলাম। আমি পয়সা দিতে চাইলাম। ছেলেটি কিছুতেই মানল না। সন্ধ্যা নামছে। ছেলেটা বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমি ছেলেটার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। দেশ থেকে সুদূর ইতালিতে আমি একজনের ফুল বিক্রির টাকা দিয়ে এক কাপ কফি খেলাম। তাও ইমদাদুল হক মিলনের কল্যাণে। এত দূরেও ইমদাদুল হক মিলন নামের ম্যাজিক!
গ্রাৎসে, মিলন ভাই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)