কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা উদ্যোগের পরও কোনোভাবেই কমছে না ব্যাংকগুলোতে গ্রাহক হয়রানির ঘটনা। গত ডিসেম্বরে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে সেবা নিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন পাঁচ শতাধিক গ্রাহক। গ্রাহক হয়রানির শীর্ষে রয়েছে নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়া ফারমার্স ব্যাংক। পরের দুটি স্থানে আছে যথাক্রমে ব্র্যাক ব্যাংক এবং সোনালী ব্যাংক।
অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে; অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ কর্তন, চেক জালিয়াতি, ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড, রেমিটেন্স, মোবাইল ব্যাংকিং, মিথ্যা তথ্য দিয়ে ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলন, স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) অর্থ ফেরত না দেয়া, স্বীকৃত বিলের মূল্য পরিশোধ না হওয়া, ঋণ ও অগ্রিম, নোটস এবং কয়েনস, ব্যাংক গ্যারান্টি ইত্যাদি।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছেন, গ্রাহক হয়রানি কমাতে ব্যাংকগুলোতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে অভিযুক্ত ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বর মাসেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাস্টমার সার্ভিসেস বিভাগে (সিএসডি) বিভিন্ন ব্যাংকের বিরুদ্ধে প্রায় ৫০০ অভিযোগ করেছেন গ্রাহকরা।
অভিযোগের ভিত্তিতে সব ব্যাংকের শীর্ষে ছিল বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংক। ব্যাংকটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ৫৭টি হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। এরপরই বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকে ৪৭টি ও রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের বিরুদ্ধে রয়েছে ৩৩টি অভিযোগ।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১১ সালের ১ এপ্রিল গ্রাহক স্বার্থসংরক্ষণ কেন্দ্র (সিআইপিসি) গঠন করে। পরিধি বাড়তে থাকায় পরে একে এফআইসিএসডি নামে পূর্ণাঙ্গ শাখায় রূপ দেয়া হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত (সিএসডি চালুর পর থেকে) বিভিন্ন ব্যাংকের বিরুদ্ধ প্রায় ২৬ হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে। এসব অভিযোগের বেশিরভাগই নিষ্পত্তি করা হয়েছে। তবে ব্যাংকের বিরুদ্ধে সব সময় প্রায় একই রকম অভিযোগ আসছে বলে জানা গেছে।
গ্রাহক হয়রানির অভিযোগের শীর্ষে থাকা ফারমার্স ব্যাংকের উপদেষ্টা প্রদীপ কুমার দত্ত চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো হলো গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে না পারা। এছাড়া অন্য অভিযোগ নাই। ব্যাংকটি নগদ অর্থের সংকটে পড়ায় গ্রাহকদের চাহিবামাত্র অর্থ ফেরত দিতে পারছে না।
তবে অার্থিক সমস্যা ছাড়া গ্রাহকদের অন্য সব সেবা সর্বোচ্ছ দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। গ্রাহকরা যেন আবারও আস্থা ফিরে পেয়ে ব্যাংকমুখী হন ফারমার্স ব্যাংক সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
‘আশাকরি তারল্য সংকট দূর হলে গ্রাহকদের আর কোনো অভিযোগ থাকবে না।’
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়দ উল্লাহ আল মাসুদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, বাংলাদেশে সব ব্যাংকের চেয়ে সোনালী ব্যাংকের শাখা বেশি, ১ হাজার ২শটি। গ্রাহকও বেশি। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা এসব শাখার দুই-একটিতে হয়তো সমস্যা থাকতে পারে।
‘অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় শাখা ও গ্রাহক বিবেচনা করলে আমি মনে করি গ্রাহকদের অভিযোগ সবচেয়ে কম এই ব্যাংকে।’
অভিযোগ কমিয়ে আনতে ব্যাংকে একটি সেবামূলক সেল গঠন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংকটির প্রায় সব কাজ অনলাইনমুখী করা হচ্ছে। আশাকরি ভবিষ্যতে গ্রাহকদের অভিযোগ শূন্যের কোটায় নেমে আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, সিআইপিসি চালুর পর থেকে গত বছর পর্যন্ত এফআইসিএসডিতে অভিযোগ করেছেন ২৫ হাজার ৬৫৬ গ্রাহক। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ২৫ হাজার ৬৪৮টি অভিযোগ।
অভিযোগ নিষ্পত্তির হার ৯৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এসময় ১৪ হাজার ৮৬১টি লিখিত অভিযোগের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১৪ হাজার ৮৫৩টি। অার টেলিফোনে আসা ১০ হাজার ৩৯৬টি ও অনলাইনে প্রাপ্ত ৩৯৯টি অভিযোগের সবকটিই নিষ্পত্তি হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর মাসে প্রাপ্ত অভিযোগের সংখ্যা ছিল ৪৯৫টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৮৭টি। নিষ্পত্তির হার ৯৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এসময়ে লিখিতভাবে ১৯৭টি, টেলিফোনে ২৮৯টি ও অনলাইনে ৯টি অভিযোগ আসে। এর মধ্যে অনলাইন ও টেলিফোনে পাওয়া অভিযোগের শতভাগ নিষ্পত্তি হলেও লিখিত অভিযোগের ৮টি অনিষ্পন্ন ছিল।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ডিসেম্বর মাসে প্রাপ্ত অভিযোগের মধ্যে সাধারণ ব্যাংকিংসংক্রান্ত অভিযোগ ছিল ১৭১টি। ঋণ ও অগ্রিম সংক্রান্ত ৬১টি, এলসির বিপরীতে আমদানি বিল পরিশোধ না করা সংক্রান্ত ৫০টি, কার্ড সংক্রান্ত ৫৮টি, নোটস অ্যান্ড কয়েনস সংক্রান্ত ১৭টি, যথাযথ সেবা না পাওয়া সংক্রান্ত ৪০টি, ফিজ অ্যান্ড চার্জেস সংক্রান্ত ১৮টি, চেক জালিয়াতি সংক্রান্ত ১টি, রেমিটেন্স সংক্রান্ত ৫টি, ব্যাংক গ্যারান্টি সংক্রান্ত ৯টি, মোবাইল ব্যাংকিং সংক্রান্ত ৪টি ও অন্যান্য অভিযোগ রয়েছে ৫৭টি।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র দেবাশিস চক্রবর্ত্তী চ্যানেল আই অনলাইকে বলেন, গ্রাহকদের হয়রানির অভিযোগ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস (এফআইসিএসডি) নামে একটি শাখা রয়েছে। সেখানে অভিযোগ করলে অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে অভিযুক্ত ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
তিনি বলেন, তাই হয়রানি মুক্ত হতে হলে গ্রাহকদের অবশ্যই সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করতে হবে।
গ্রাহক অভিযোগের সার্বিক দিক নিয়ে এফআইসিএসডি থেকে প্রতি অর্থবছরে একটি প্রকাশনা বের করে বাংলাদেয় ব্যাংক।
যদিও গত অর্থবছরের প্রকাশনা এখনও প্রকাশ করা হয়নি। তবে সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রকাশনা বের করা হয়।
ওই প্রকাশনার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিভিন্ন ব্যাংকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকে ৪ হাজার ৫৩০টি অভিযোগ করেন গ্রাহকরা। এর মধ্যে ২ হাজার ৩৮৪টি অভিযোগ ফোনে ও ২ হাজার ১৪৬টি লিখিতভাবে।
এসব অভিযোগের শতভাগই নিষ্পত্তি করা হয়েছে বলে দাবি করা হয় ওই প্রকাশনায়।