চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

সাহায্যে নয় গৌরাঙ্গ আদিত্যের চিকিৎসা হোক সম্মানে

প্রতিভাবান, সৃজনশীল ও মেধাবী সংস্কৃতি কর্মীগণ যখন সমাজে করুণার পাত্র হয়ে যান তখনই সংস্কৃতির দায়িত্বশীল দফতরের ব্যর্থতার দিক ফুটে ওঠে।তার এই উদাহরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নতুন নতুন মেধাবী সংস্কৃতি কর্মীর উত্থান। অভিভাবকরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে তার সন্তানকে সংস্কৃতি কর্মী হিসাবে গড়ে তুলতে।অসুস্থ প্রতিভাবানকে নিয়ে হুলস্থুল শুরু হয়।

কেউ ভালবাসায়, কেউ মানবতায় আর কেউ নিজেকে জাহির করার বাসনায়। কাউকে কাউকে মরণোত্তর পুরস্কার দিতেও দেখা যায়। এ যেন সেই কথাটির মতই থাকিতে দিলিনে দুমুঠো ভাত, মরিলে গড়িবি মঠ।একটি ফলবান বৃক্ষের যখন জল, হাওয়া, আলো, উর্বরতা ও পরিচর্যার দরকার সময়মত তা না পেলে বৃক্ষটি শুকিয়ে যেতে বাধ্য। নিজের অস্তিত্ব যেখানে হুমকির চরমে সেখানে ফলদানের কি আর কোন সম্ভাবনা থাকে?

যুগে যুগে দেখা যায় অনেক কবি, গায়ক ও গল্পকারকে তার কর্মক্ষমতা হারাতে। যে জন্য দায়ী রোগ, শোক, অনাদর, অবহেলা ও মানবেতর জীবনযাপন। আমলা, ব্যবসায়ী, কালোবাজারী ও মাফিয়াদের কাউকে বিনাচিকিৎসায় মরতে দেখা যায় না।

তাদের ভোগ করতে হয় না জীবন মৃত্যুর মাঝখানের দূর্বিষহ জীবন যন্ত্রণা। তারা কেউ সংবাদপত্রে বিপন্ন মানবতার চিত্র হিসাবে শিরোনাম হয় না। যুগে যুগে করুণার পাত্র হয়ে উঠছেন প্রতিভাবান, মেধাবী সৃজনশীল মানুষগুলো। এটা আমাদের সাংস্কৃতিক প্রগতিশীলতার চরম বাধা।

বিভিন্ন সংবাদপত্রে ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তেমনই একজন সংগীত সাধক আজ করুণার পাত্র হয়ে শিরোনাম হচ্ছেন। তিনি হচ্ছেন গৌরাঙ্গ আদিত্য। জীবনের প্রতিটি ক্ষণই ছিল তার কেবলই সংগীত সাধনার। সংগীত ছাড়া তার জীবনের বেঁচে থাকার অবলম্বন বলতে কিছু নেই। নব্বই বছর বয়সী গৌরাঙ্গ আদিত্যের জন্ম ভারতের নদীয়া জেলার নবদ্বীপে।বাবার নাম রমেশ চন্দ্র আদিত্য ও মাতার নাম উষারানী আদিত্য।

দেশভাগের অনেক আগেই তার পূর্বপুরুষেরা বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা উপজেলায় ও পরে মোহনগঞ্জ উপজেলার দেওথান গ্রামে বসবাস শুরু করেন। তিনি বর্তমানে পক্ষাঘাত গ্রস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। সংগীত সাধনা বন্ধ তাই জীবনজীবিকার উপায়ও বন্ধ। সকল পেশারই অবসরকালীন অার্থিক সুবিধা আছে কিন্তু সংস্কৃতি কর্মীদের নেই। অবসরকালীন সময়ে তারা হয় মানুষের করুণার পাত্র!

এই অবহেলার দায় কে নেবে? আমরা যদি এজন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে দায়ী করি তা কি অযৌক্তিক হবে? কিছুূদিন আগে কবি হেলাল হাফিজ অসুস্থ হলেন। অসুস্থ কবির চিকিৎসা, খাদ্য, বাসস্থান কোনোটারই ব্যবস্থা নেই। তাকে প্রধানমন্ত্রীর সাহায্যপ্রার্থী হল।তাহলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় রেখে কী লাভ হল?

কবি হেলাল হাফিজের পাশে দাঁড়ানো কি এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল না? যাত্রাশিল্পের বিবেক বলে খ্যাত গীতিকার, সুরকার ও কন্ঠশিল্পী ওস্তাদ গৌরাঙ্গ আদিত্য প্রায় দুই শতাধিক যাত্রা পালায় বিবেকের অভিনয় করেছেন। ওস্তাদ বীরেন্দ্র চন্দ্র গোস্বামীর কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের চর্চার শুরুর মধ্য দিয়েই তার সংগীত সাধনার সূচনা। তিনি সংগীত চর্চার স্বীকৃতি স্বরূপ জাতীয় শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার, অমলেন্দু স্মৃতি পুরস্কার, নেত্রকোনা জেলা শিল্পকলা পরিষদ কর্তৃক সম্মাননাসহ আরও বহুবিধ পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।

তার জীর্ণঘরে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন সম্মাননার ক্রেস্ট। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে এই ক্রেস্ট গুলো কী কাজে লাগছে এই অসুস্থ অসহায় সংগীত শিল্পীর? সোশ্যাল মিডিয়ায় গৌরাঙ্গ আদিত্যের নামে সাহায্য চাওয়া হচ্ছে। চিকিৎসা,অন্ন সংস্থান কোনটারই উপায় নেই এই সংগীত শিল্পীর। তবে কি আজকাল সংস্কৃতি চর্চায় নামলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সৈনিকদের অনুসরন করতে হবে করুণার পাত্র হওয়া হতে বাঁচতে?

এসব সৈনিকরা ইংরেজদের হাতে ধরা পড়লে প্রাণঘাতী ট্যাবলেট খেয়ে মরে যেতেন নিজেদের রক্ষা করতে।সংস্কৃতি কর্মীরাও কি সেই প্রাণঘাতী ট্যাবলেট সঙ্গে নিয়েই তবে সংস্কৃতি চর্চায় লিপ্ত হবে? এ বিষয়ে কী বলবেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়?

দেশের সংস্কৃতি কর্মীদের ব্যাপারে কী ভূমিকা রাখছেন এই মন্ত্রণালয়টি? এদেশে সংস্কৃতি কর্মীদের এই হাল হচ্ছে কেন। একটা মানুষ কৈশোর হতে প্রৌড় পর্যন্ত গান গেয়ে গেল আর শেষবেলায় কেন সাহায্য চেয়ে তার চিকিৎসা ও অন্নজুগানো? আমরা শিল্পী কে করুণার পাত্র করে ও সাহায্য তুলে বাঁচাতে চাই না। চাই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় খরচে। আর কোন গৌরাঙ্গ আদিত্যের এমন করুণ পরিণতি হোক আমরা তা চাই না। চাই সংস্কৃতি কর্মীদের সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার পরিবেশ সৃষ্টি। তাদের এই হাল হলে পরবর্তী প্রজন্ম আর তাদের সন্তানকে সংস্কৃতি চর্চা করতে আগ্রহী হবে না।

এগুলো উদাহরণ হয়ে সংস্কৃতি কর্মী সৃজনে বাধা হিসাবে কাজ করবে। গীতিকার, সুরকার ও কন্ঠশিল্পী ওস্তাদ গৌরাঙ্গ আদিত্যের পাশে সরকার ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় দাঁড়াবে এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করি। আর এই দাঁড়ানোটা হোক অতি দ্রুত।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)