ফেরির পাটাতনে বসে ছফেদা ফল বিক্রি করছিলেন বৃদ্ধ। এলুমিনিয়ামের গামলা ভর্তি ফলগুলো অত্যন্ত শৈল্পিকভাবে একটার উপরে আরেকটা বসিয়ে থরে থরে পিরামিড আকৃতির করে সাজানো। মাওয়া-জাজিরা রুটের ফেরি, ঘাট সংলগ্ন দুপারেই পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের বিশাল কর্মযজ্ঞ দৃশ্যমান। যাত্রীবাহী বাস, মালবাহী ট্রাক, প্রাইভেট কার ও মোটর সাইকেলে ফেরিখানা ভরপুর। স্টিলের পাটাতনের মাঝামাঝি খানিকটা খোলা জায়গায় ঝালমুড়ি, পদ্মার ইলিশ, সেদ্ধ ডিম, বাদাম ভাজা, কুলবরই, কলা, ডাব, কমলা, এমনকি ইসলামী বইয়েরও পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা। ফেরির যাত্রাকালের সময়টুকুতে অলস যাত্রীদের প্রয়োজনীয় কেনাকাটার সব উপকরণই আছে এসব দোকানে।
গাড়িখানা ফেরির উপরে পার্ক করেই চালক জানালো পদ্মা পাড়ি দিতে ঘন্টাদুয়েক সময় লাগবে। জানতে চাইলো, মামা কিছু খাইবেন, আইন্যা দিমু। ওকে ইশারায় না বলে আমার ঢাউস সাইজের ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে গাড়ি থেকে নামলাম। উদ্দেশ্য চলতে চলতে পদ্মা নদীর দু’চারটে ছবি তুলবো। কিন্তু মিনিট বিশেক চেষ্টা করে একটাও ছবি তুলতে পারলাম না। কোনটা ঘোলা, কোন ছবি ঝাপসা, কোনটা অতি আলোতে ঝলসে গেল, কোনটা বা অন্ধকারাচ্ছন্ন। একটা ছবিও কোন জাতের না। ক্যামেরা অপারেশনে আমার কারিগরী জ্ঞানের অভাবেই ছবিগুলোর এমন দশা। অনেক আগ্রহ নিয়ে গত বছরের গ্রীষ্মকালের শুরুতে টরন্টো থেকে তিনটে বাড়তি লেন্সসহ এই ডিএসএলআর টেকনোলজীর ক্যামেরাটি বেশ কিছু নগদ কড়ি খরচ করে কিনেছিলাম। এ ধরনের প্রফেশনাল ক্যামেরা আমি চালাতে জানি না। আমার এক ঘনিষ্টজন এমনই একটি ক্যামেরা চালায়। ক্যামেরার অপারেশন, ছবি তোলার দক্ষতা ও বোধ তাঁর অবিশ্বাস্য রকমের ভাল। ভেবেছিলাম ওর থেকে ক্যামেরা চালানোটা শিখে নেব। কিন্তু সেই থেকে আজ অব্দি তাঁর সাথে সম্পর্কের বেজায় টানাপোড়েন চলছে, ক্যামেরা চালানোটা আর শেখা যায়নি। অগত্যা কি আর করি, ছবি তোলা বন্ধ রেখে বাস-ট্রাকগুলোর ফাঁক গলে ফেরির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত হাঁটাহাটি করছিলাম।
ছফেদা ফলের দোকানের পাশে এসে দাঁড়ালাম। দোকানদারের মুখভর্তি চাপ দাঁড়ি, মাথায় শীতের টুপি, পেটা শরীর, বয়স আন্দাজ করি পয়ষট্টি থেকে সত্তরের মধ্যে হবে। একগাল হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বাজান ফল খুবই মিষ্ট দুএক ডজন লইয়া লন। আমি নিরুত্তর, ফলগুলো একটার উপর আরেকটা থরে থরে সাজানোর শৈল্পিক পারদর্শিতা বোঝার চেষ্টা করছি। জানতে চাইলাম, চাচাজান কে এত সুন্দর করে ফলগুলো সাজিয়েছে? বাজান কয় কি, কে আবার সাজাইবো, আমিই সাজাইছি! দোকানি বললেন, আমার গাছোর ফল, এক্কেরে গাছপাকা, নিচিন্তে লইয়া লন যে কয় ডজন লাগে। একশ ট্যাকা ডজন রাইখতে পারুম। বেশ বড় সাইজের ফলগুলো, দেখতেও টসটসে। বললাম, একহালি কিনলে কত রাখবেন? হালি পঞ্চাশ ট্যাকা, তয় আফনে চল্লিশই দেন। বেছে বেছে চারটে ছফেদা একটা কাগজের ঠোঙ্গায় ভরে আমার হাতে দিলেন। ওখানে দাঁড়িয়েই আমি ফল খাওয়া শুরু করলাম।
মাথার উপরে তীব্র রোদ কিন্তু পদ্মার ঝিরিঝিরি বাতাসে বেশ শীতশীত করছিলো। দাঁড়িয়ে ছফেদা খাচ্ছি আর দুরে তাকিয়ে নদীর দৃশ্য দেখছি। ভাবছি, কতটা অর্বাচীন আমি, এত ভাল একটা ক্যামেরা ঘাড়ে ঝুলছে, অথচ তা চালানোর মুরোদ নেই। হঠাৎ কান্না মাখানো শিশু কন্ঠ কানে এলো। বাবা সফেদা খাবো, সফেদা খাবো! তাকিয়ে দেখি পাঁচ ছয় বছরের ফুটফুটে একটি মেয়ে বাবার হাত ধরে টানছে আর ছফেদা খেতে চাইছে। বাবা গম্ভীর প্রকৃতির, একেবারে স্যুটেড বুটেড সাহেব গোছের আদল। মেয়েকে মৃদু ভর্ৎসনা করছেন, না এই ধুলোবালির মধ্যে তোমার ছফেদা খেতে হবে না, গাড়িতে চলো। মেয়েটা বাবার হাত ধরে দোকানের দিকে টানে, আর রক্তচক্ষু বাবা মেয়েকে গাড়ির দিকে নেবার চেষ্টা করছে। বাবারই জয় হলো, ভিড় ঠেলে স্যুটেড বাবা কন্যাকে নিয়ে গাড়ির দিকে এগুতে থাকলেন।
ফলের দোকানদার এক দৃষ্টিতে বাবা মেয়ের এই টানাটানি দেখছিলেন। কি মনে করে বৃদ্ধ হঠাৎ উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, একডু খাঁড়াও মা! বড়সড় সাইজের একটি সফেদা দু আঙ্গুলের চাপে ফাটিয়ে দুভাগ করে ফেললেন। খানিকটা দৌঁড়ে গিয়ে মেয়েটির কাছে পৌছেই ভাগ হওয়া ফলটি ওর হাতে দিলেন। মুহুর্ত বিলম্ব না করেই মেয়েটি ছোবলাসহ ওই ছফেদা ফলে কামড় বসিয়ে দিয়ে দোকানির পানে তাকিয়ে একগাল হেসে দিলো। বৃদ্ধও এক পলকে তাকিয়ে মেয়েটির ফল খাওয়া দেখছিলেন, আত্মতৃপ্তির হাসি তাঁর মুখেও। বালিকা ও বৃদ্ধের সেই আনন্দক্ষণটি তুলনাবিহীন। দুর্ভাগা আমি, ক্যামেরা চালাতে পারি না বলে বিরল এই দৃশ্যটি ধারণ করতেও পারলাম না।
বৃদ্ধ দোকানি আবার এসে বসলেন তাঁর পুরোনো জায়গায়, মনোযোগী হলেন ব্যবসার কাজে। দু’চার মিনিটের মধ্যেই সেই মেয়েটির বাবা এসে পঞ্চাশ টাকার একখানি নোট দোকানির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ফলের টাকাটা রাখুন। বৃদ্ধ হাঁ করে খানিক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ভদ্রলোকের দিকে! খানিকটা পরে বললেন, ট্যাকা দিতাছেন ক্যান বাজান! আমিতো ফল বেচি নাই! আফনের মাইয়াডারে খাইতে দিছি, হ্যার জন্নি আবার ট্যাকা লাগবো ক্যান? ভদ্রলোক বোধকরি বুঝে উঠলেন না এ কথার মর্মার্থ। প্রমিত বাংলায় বললেন, এত কথার প্রয়োজন নেই, ফলটির দাম যা তা রাখুন। বৃদ্ধ বললেন, না না বাবা ট্যাকা লাগবো না, এইডা কি কইত্যাছেন আফনে? এবার ভদ্রলোক উচ্চস্বরে বললেন, বয়স্ক মানুষ আপনি একটু বেশি কথা বলেন! ফল দিয়েছেন, টাকা রাখবেন এটাই শেষ কথা! এটুকু বলেই নোটখানা ছুড়ে দিলো বৃদ্ধের কোলের উপর।
বৃদ্ধ এবার গর্জে উঠলেন! নোট হাতে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোকের হাতে তা মুহুর্তেই গুঁজে দিলেন। বাঁধভাঙ্গা আবেগ তাঁর, চিৎকার করে বলছেন ট্যাকার গরম দেহান! গরীবগোরে মানুষ মনে করেন না! ছোড্ড এইডা মাইয়্যারে ফল খাওয়াইয়া ট্যাকা নিমু আমি? আমার নাম গোলজার মাতুব্বর! মানুষের বাইচ্চা আমি! ভদ্রলোকের মুখের উপরে তর্জনি উঁচিয়ে আবারো চেঁচিয়ে বললেন, বুইচতে পারিচেন মানুষের বাইচ্চা আমি!
অপমানে ক্ষোভে যেন দিশেহারা বৃদ্ধ, পাগলের মত পাটাতন জুড়ে ছটফট করছিলেন। উপস্থিত যাত্রীদের উদ্দেশ্য করে বলছিলেন, দ্যাখছেন আফনেরা কি কয়, আমি নাকি হ্যার কাছে ফল বিক্রি করছি? আমি কি হ্যার মাইয়াডারে একটা ফল খাইতে দিতে পারি না? আমার কি এতই অভাব? তাঁর দুগাল বেয়ে চোখের জল ঝরছে। তিনি তার মাজায় প্যাচানো গামছাখানা খুলে ফলের গামলা ঢেকে দোকান গুটিয়ে ফেললেন। চোখের জল মুছতে মুছতে একেবারে ফেরির সামনে গিয়ে একাকি দাঁড়িয়ে রইলেন যাত্রার বাকিটা সময়। ঘাটে ভিড়লো ফেরি। আমরা যার যার গন্তব্যে রওনা হলাম। গোলজার মাতুব্বর রয়ে গেলেন ফেরি ঘাটেই, হয়তো ফিরতি ফেরির জন্য অপেক্ষা করবেন! পুরো ঘটনার মানবিক দিকটি ভাবছিলাম আমি। দরিদ্র এই ফল বিক্রেতার মানবিকতায় মুগ্ধ আমি, আপ্লুত আমি। শ্রদ্ধায় নত আমি তাঁর প্রতি! খুউব মনে পড়ছিলো গানের সেই চরণটি, “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি”। কেবলমাত্র বাংলাদেশই বোধকরি এমন গোলজার মাতুব্বর জন্ম দিতে সক্ষম!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)