শুক্রবার রাতে দেশের সবচেয়ে নিরাপদ এলাকা গুলশান লেকপাড়ের অভিজাত হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তারাঁয় বিভীষিকাময় জঙ্গি হামলা সংগঠিত হয়। নৃশংস, পৈশাচিক এই সশস্ত্র হামলায় নিরপরাধ নিরীহ দেশি-বিদেশি ২০ নাগরিকসহ ২ পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে অনন্ত আরো ৩০ জন।
শুক্রবার রাত পৌনে নয়টা থেকে শুরু হওয়া এই হমলার সমাপ্তি হয় শনিবার সকাল আটটায় সেনাবহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত সম্মিলিত অভিযানের সম্পাত্তির মাধ্যমে। ১২ ঘন্টার এই রুদ্ধশ্বাস অভিযানে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের অবস্থান ছিল খুবই তৎপর। অভিযানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সরাসরি সম্প্রচার করেছে দেশি-বিদেশি সম্প্রচার মাধ্যমগুলো। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বারবার অনুরোধ করার পরও সেটিকে আমলে নেয়নি অনেক সম্প্রচার মাধ্যম।
এমনকি, যে দেশ সাংবাদিকতার শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান দান করে স্বয়ং সেই দেশটির সম্প্রচার মাধ্যমটিও। অভিযানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় ১২ ঘন্টায় ঢাকার এই হামলা সরাসরি সম্প্রচার করেছে এই দেশের সম্প্রচার মাধ্যমটি। সম্প্রচার মাধ্যগুলোর এই অতি উৎসাহী মনোভাব হামলাকারীদের আরো উৎসাহিত করার পাশাপাশি হমলা চালাতে সহযোগিতা করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত এই অভিযানের কোন পর্যায়ে কী হচ্ছে? কোন পদ্ধতিতে অভিযান চালানো হচ্ছে? কারা অভিযানে অংশ নিচ্ছে? কখন চূড়ান্ত অভিযান শুরু হচ্ছে? কতদূর পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ঘিরে রেখেছে? হেলিকপ্টার দিয়ে উপর থেকে মনিটরিং করা হচ্ছে কি না? এমনকি অভিযানের জন্য রেস্তোরাঁর কোন পাশে কোন বাহিনী অবস্থান নিয়েছে এমন সব তথ্যের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে ঘটনাস্থালের সরাসরি সম্প্রচার করেছে সম্প্রচার মাধ্যমগুলো।
রেস্তোরাঁর ভিতরে কী হচ্ছে সেটা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শনিবার সকালে চূড়ান্ত অভিযান শেষ করার পূর্ব পর্যন্ত কিছুই জানতে পারেনি অথচ রেস্তোরাঁর ভিতরে অবস্থানকারী হামলাকারীরা রেস্তোরাঁর ভিতর থেকে সম্প্রচার মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে সব তথ্য জানতে পেরেছে প্রতি মুহুর্তে।
হামলাকারীরা দেখতে পেয়েছে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের সম্প্রচার মাধ্যমগুলো গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করছে তাদের এই অভিযান। যেটা তাদের হামলা চালাতে আরো উৎসাহ জুগিয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। একই সাথে অভিযানের কৌশলগুলো সাথে সাথেই হামলাকারীরা জানতে পেরেছে । যুদ্ধে যদি প্রতিপক্ষ নিজের গোপন কৌশলগুলো যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই জেনে যায় তাহলে ঐ যুদ্ধে জয়ী হওয়া যতটাই কঠিন ততটাই কঠিন এই ক্ষেত্রেও সঠিকভাবে অভিজান পরিচালোনা করা।
আর এই অভিজানের বিস্তারিত সব গোপন কৌশল সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে দেশি-বিদেশি সম্প্রচার মাধ্যমগুলোতে। গণমাধ্যমের কাজ দেশ ও জাতির কল্যাণে সহোযোগিতা করা, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা নয়। আর এই কাজটি করতে প্রতিনিয়তই কঠোর পেশাদারিত্বের পরিচয় দিতে হয় সংবাদকর্মীদের। সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্ব, নৈতিকতা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা না থাকলে সেটাকে সাংবাদিকতা না বলে গুপ্তচরবৃত্তি বলাই শ্রেয়। যার কাজ সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা এবং সংগ্রহীত সব তথ্য তার এজেন্টের কাছে প্রকাশ করা।
গণমাধ্যমের প্রধান চারটি কাজ হলো তথ্য সরবরাহ করা, জনগণকে শিক্ষিত করা, জনগণের উপর প্রভাব বিস্তার করা এবং জনগণকে আনন্দ দান করা। পাশাপাশি গণমাধ্যমেরও রয়েছে কিছু সামাজিক দায়বদ্ধতা। এই দায়বদ্ধতা হলো- দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে কাজ করা। গণমাধ্যমের প্রধান কাজ তথ্য সরবরাহ করা।
গণমাধ্যম সেটা করবে অবশ্যই দেশ ও জাতির স্বার্থে- গণমাধ্যমের নিজের স্বার্থে নয়। যেটা দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কল্যাণকর, যে তথ্য দেশের সবার জানা জরুরি এবং যে তথ্য জানার ফলে জনগণ উপকৃত হবে সেই তথ্যই প্রকাশ করবে গণমাধ্যম। একইভাবে যেসব তথ্য দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণ বয়ে আনে সেসব তথ্য গণমাধ্যমে এড়িয়ে যাবে দেশের স্বার্থে এবং গণমাধ্যমের সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে।
প্রধান এই চারটি কাজের পাশাপাশি গণমাধ্যম কোন বিষয়ে ব্যাখ্যাও প্রদান করে থাকে। কোন বিষয়ের ব্যাখ্যা অবশ্যই প্রতিবেদক নিজে দিয়ে থাকে না। এ ব্যাখ্যা- কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মহলের মতামত।
বিডিআর বিদ্রোহ সহ নানা ঘটনার পর প্রতিবেদকের ঠিক-বেঠিক নানা ব্যাখ্যা পাওয়ার অভিজ্ঞতা দর্শকের ছিল। একইভাবে গুলশানে হামলাচালাকালীন আবারো প্রতিবেদকের নানা ব্যাখ্যা পাওয়ার অভিজ্ঞাতা দর্শকের নতুন করে হয়েছে। যেহুতো সমাজের মানুষের উপরর গণমাধ্যমের প্রভাব খুবই বেশি তাই গণমাধ্যমের প্রতিটি বার্তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি ভুল বার্তা একটি জাতির অনেক বড় ভোগান্তির কারণ হতে পারে। তাই গণমাধ্যমের বার্তা সব সময় সঠিকতা ও যর্থাথতার দাবি রাখে।
গণমাধ্যমের ভোক্তা যেমন ১ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ১০০ বছরের বৃদ্ধ। তেমনি, অক্ষর জ্ঞানহীন থেকে শুরু করে সমাজের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী পর্যন্ত সবাই। সংবাদপত্র পাঠের জন্য অক্ষরজ্ঞান ও দৃষ্টিশক্তির প্রয়োজন হয়। কিন্তু, সম্প্রচার মাধ্যমের ভোক্তা হতে অক্ষরজ্ঞান ও দৃষ্টিশক্তি কোনটিরই প্রয়োজন নেই। তাই, সম্প্র্রচার মাধ্যমের প্রভাব সমাজে আরো বেশি। যেহেতু সম্প্রচার মাধ্যমের প্রভাব অন্য মাধ্যমের তুলনায় বেশি তাই তথ্য প্রকাশের সম্প্রচার মাধ্যমকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে।
ভুল তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে কোমলমতি শিশুটি যেমন ভুল তথ্য শিখবে তেমনি বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর দর্শকটি রীতিমত বিরক্তই হবে। যার ফলে কোন নিদিষ্ট গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা কমবে তার দর্র্শকের কাছে।
সম্প্রচার মাধ্যমগুলো শুধু নিজেদের টিআরপি বৃদ্ধির জন্যই কাজ করবে না । জনগণকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যথাসময়ে তথ্য জানানোর পাশাপাশি ঘটনার মূল্যবান ব্যাখ্যা প্রকাশ করে জনগণবে সচেতন করবে এবং প্রতিটিক্ষেত্রেই কঠোর পেশাদারিত্ব, নৈতিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা চিন্তা করবে বলেই প্রত্যশা ।
(এ
বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর
সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)