চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

গুজবে গুজবময় সর্বত্র

সন্ধ্যার পরে গ্রামের রাস্তায় কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে সিএনজি চালিত ট্যাক্সিতে যাচ্ছিলাম, সেখানে ‘গলাকাটা’ ও ‘ঘাড়কাটা’ নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছিল। প্রত্যেক যাত্রীদের মনে ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থা বিরাজ করছিল এবং সকলেই তাড়াতাড়ি বাড়ি যাওয়ার জন্য পায়তারা করছিল। সিএনজি ট্যাক্সি ড্রাইভারের অবস্থা আরো সঙ্কটাপন্ন, তার স্ত্রী একা বাড়িতে এবং কোথাও কোন শব্দ বা আওয়াজ শুনলেই ভয়ে তটস্থ হয়ে পড়েন এবং এই অবস্থায় সে নাকি গলাকাটার ভয়ে ঘরে দরজা লাগিয়ে বসে আছেন সন্ধ্যার সময়ে। সিএনজি ড্রাইভারের দ্রুতগতিতে ট্যাক্সি চালনা বর্তমান গুজবের সংকটময় পরিস্থিতিকে বেগবান করে তোলে গুজবের ফ্যাক্টর ও বিদ্যমান সংকট বিবেচনায়।

ট্যাক্সিতে থাকা অবস্থায় গুজবের উৎপত্তি ও অন্যান্য পরিস্থিতি নিয়ে সবাইকে বলার পরেও তারা নানারকমের উদাহরণ দিয়ে বিষয়টাকে আরও জটিল করে তুলছিল এবং তাদের বদ্ধমূল ধারণাকে আরও জোরালো করে তোলে, পাশাপাশি অমুক তমুকের আত্মীয়রা ঘাড়কাটা মহিলার খপ্পরে পড়েছিল মর্মে বিবৃতিও দেয়। উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে, তাদের নিজেদের আত্মীয়রা মাথাকাটা/গলাকাটার সম্মুখীন হয়নি অবশ্য!

গ্রামে একটা প্রবাদ আছে, ‘বনের বাঘে খায় না কিন্তু মনের বাঘে খায়’। যেকোন কিছু ঘটলেই ঘটনা প্রবাহকে আমরা গুজবের দিকেই ধাবিত করে থাকি, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও বাস্তবতার অবলোকন ব্যতিরেকেই। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে মানুষের মধ্যে এখনো কুসংস্কারের প্রকট/প্রচ্ছন্ন প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে নেত্রকোনার একটি ছেলেকে গলাকাটার ঘটনাটি গুজবের (পদ্মা সেতু সংক্রান্তে) বলে অনেকেই প্রচার করেছে কিন্তু পুলিশের প্রেস ব্রিফিং এর পরে সবকিছু স্পষ্ট হওয়ার পরেও মানুষের মধ্য থেকে গলাকাটার গুজব সম্বন্ধে ধারণা এখনো দূরীভূত হয়নি। হবেই বা কিভাবে প্রতিদিনই উড়োচিঠি এবং বাতাসের বেগে গুজবের গুজব সর্বস্ব খবর বিদ্যুতের বেগে ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র।

গুজব শব্দটির মধ্যে কেমন যেন একটা আতংক, ভয়, বিশৃঙ্খলা, আইন শৃঙ্খলার অবনতি, সমাজের অবক্ষয় সর্বোপরী পিছিয়ে পড়া সমাজব্যবস্থার সচিত্রই বিরাজ করে থাকে। বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজে কুসংস্কারের মাত্রা ও চিত্র ব্যাপক পরিমাণে পরিলক্ষিত হলেও শহুরে সমাজে গুজবের রটনা ও ঘটনা দেখা দেওয়ায় সকলের উৎকলিত কন্ঠ আমাদের বিবেকের তাড়নার স্লেশে কুন্ঠাবোধ করে থাকে। স্বাভাবিকভাবে বলা যায়, শিক্ষার সম্প্রসারণ, আধুনিকায়ন, সমাজব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়ন ইত্যাদি ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন ঘটলে গুজবের মাত্রা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়ার কথা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পদ্মা সেতুর কাজের জন্য শিশুদের মাথা লাগবে, এ গুজবের যে বহুমাত্রিকতা আমরা দেখতে পাচ্ছি তা দেখলে মনে হয় আমাদের সমাজ এখনো অন্ধকারে পড়ে রয়েছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগে বর্তমান জমানায় গুজবের প্রয়োগবিধি সেকেলে চিন্তাভাবনার নামান্তর বৈকি আর কিছু নয়।

গুজব প্রত্যয়টি একটি নেতিবাচক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। নেতিবাচক এই অর্থে যে, গুজবের ভয়াবহতা নানাজনকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে ও দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে পরিবার ও সমাজের উপর গুজবের নেতিবাচকতা ভবিষ্যতের উন্নত বাংলাদেশের অন্তরায়। গ্রামে গঞ্জে এই মর্মে রব উঠে গেছে যে, গলাকাটাদের দলে যোগ দিয়ে সদস্য হলেই ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়ে থাকে। গুজবের নেতিবাচকতা এতটা ভয়াবহ পর্যায়ে গিয়েছে যে, গ্রামে গঞ্জে অপরিচিত কেউ বেড়াতে আসলে তাকেই সন্দেহ করে পিটুনি দেওয়া হচ্ছে এবং এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। গুজবের পরিণতিতে ছেলেমেয়েরা সহজে ঘর থেকে বাইরে বের হতে পারছে না, বাবা মায়েরা সন্তানদের নিরাপদে স্কুলে পাঠাতে পারছে না। ঢাকায় তো আমরা দেখলাম, সন্তানের স্কুলে ভর্তির তথ্যাদি জানার জন্য স্কুলে পরিভ্রমণরত এক মহিলাকে গলাকাটা মহিলা আখ্যা দিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সর্বশেষ জানা যায়, চট্টগ্রামে প্রশাসনিক কাজে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় শিক্ষা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা ছেলেধরা গুজবের শিকার হয়েছেন বলে জানা যায়।

গুজবের গুজবময় পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার জন্য সচেতনতার কোন বিকল্প নেই। প্রত্যেক সমাজে গুজবসহ অন্যান্য সামাজিক সংকট মোকাবেলায় সমাজের সচেতন ও বিজ্ঞ মানুষদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে কাজ করা যেতে পারে। গুজব কিংবা অন্যান্য যে কোন কারণেই হোক না কেন, আমাদের সামনে একজন মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে অথচ আমরা কেউই তার প্রতিবাদ করছি না। অপরাধী হলে প্রচলিত আইনে তার শাস্তি হবে, নিজেরা কেন অপরাধ করছি আমরা?

বাংলাদেশ পুলিশ গুজবের ভয়াবহতাকে অনুধাবন করে নানা মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে ৯৯৯ এ কল দিয়ে পুলিশকে তথ্য দেওয়ার অনুরোধ করেছে। আশা করি, বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ গুজবের বিদঘুটে অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে কল্যাণকর ও ন্যায়নিষ্ঠ সমাজব্যবস্থা বিরাজ করার জন্য একযোগে কাজ করবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)