পৃথিবী কাঁপানো গুগল, আমরা সবাই যার কাছে নিজেদের বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞানগম্যি জমা দিয়ে বসে আছি। মনে করি, গুগল যা জানে তা আমরা কেউ জানি না। আমাদের সবার প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে গুগলে। বাচ্চা থেকে বুড়ো সবার অন্যতম তথ্যভাণ্ডার গুগল। বইপড়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছি আমরা। কারণ আমরা তো গুগল পড়ি বা গুগল করি। সেদিন পত্রিকায় দেখলাম যৌন হয়রানির প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে গুগলের অফিসগুলোতে শত শত কর্মী গত বৃহস্পতিবার কর্মবিরতি পালন করেছেন। অথচ দুনিয়া জুড়ে কোথায়, কতজন নারী, কিভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে এ তথ্যও আমরা পাচ্ছি গুগল থেকেই।
আন্দোলনকারীরা গুগলে নারীকর্মীদের উপর যৌন হয়রানির অভিযোগ যেভাবে মিটমাট করা হয়, এর প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। প্রতিবাদে অংশ নেয়া কর্মীরা চাইছেন, যৌন অসদাচরণের অভিযোগ যেন তারা চাইলে আদালতে নিয়ে যেতে পারেন। বর্তমান ব্যবস্থায় এরকম অভিযোগ বাধ্যতামূলকভাবে সালিশের মাধ্যমে নিস্পত্তি করা হয়। প্রধান নির্বাহী নিজে স্বীকার করেছেন, গুগল থেকে অন্তত ৪৮ জন কর্মীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে ছাঁটাই করা হয়েছে ।
ভেবে অবাক হয়ে গেলাম আমাদের গ্রামেগঞ্জে যেভাবে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনায় সালিশের মাধ্যমে সবসময় আপোষ রফার চেষ্টা করা হয়, গুগলেও তেমনটা হচ্ছে। গ্রামের এসব মানুষকে আমরা বোঝানোর চেষ্টা করি ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনার কোনো আপোষ হয় না। অথচ গুগলের মতো প্রথম শ্রেণীর একটি অফিসেও এরকম অভিযোগ বাধ্যতামূলকভাবে সালিশের মাধ্যমে নিস্পত্তি করা হয়। তাহলে আর পার্থক্যটা কোথায়? বরং গুগলে যেটা হচ্ছে, সেটা আরো বড় আপরাধ ।
মাত্র গত বছরই কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে লিখতে গিয়ে আমি গুগলের কর্মপরিবেশ উদাহরণ হিসেবে দিয়েছিলাম। এখানে কাজের পরিবেশ এতটাই ভাল এবং স্টাফ ফ্রেন্ডলি যে সবার ঈর্ষা করার মতো। কিন্তু দেখলাম মাত্র এক বছর পরই এই তথ্য, যা আমাদের চমকে দিলো। প্রমাণিত হল নারীর জন্য কোন কর্মক্ষেত্রই নিরাপদ নয়। সে আপনি গৃহকর্মী হন, গুগলের গবেষক হন, নাসার বিজ্ঞানী হন, সাংবাদিক, নায়িকা, গায়িকা, মডেল, চিকিৎসক, এনজিও কর্মী, শিক্ষিকা বা ছাত্রী বা অন্য যেকোন পেশাতেই থাকুন না কেন, যৌন হয়রানির হাত থেকে নিষ্কৃতি নেই।
পুরুষতন্ত্রের কারণে নারীর নারী হওয়াটাই যেন একজন নারীর জন্য সবচেয়ে বড় বিপদের কারণ। বিভিন্ন ঘটনায় বারবার দেখে আসছি নারীর শরীর জিনিসটা এতটাই ঠুনকো যে কেউ, যেকোনো সময় এর উপর থাবা বসাতে পারে, বসানোর চেষ্টা করতে পারে বা বসাবে বলে হুমকি দিতে পারে। এই বিষয়টা দিনে দিনে আরো বেশি প্রকট হয়ে উঠছে দুনিয়াজুড়ে। নারীর শরীরের উপর থাবা বসাতে পুরুষের কোন বিশেষ কিছু লাগে না। একমাত্র যোগ্যতা সে পুরুষ। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মাস্তান, আইন রক্ষাকারী সংস্থার সদস্য, সাংবাদিক, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, নায়ক, পাচক, গায়ক, কবি, সাহিত্যিক সবার মধ্যে নারীকে হেনস্তা করার প্রবণতা আছে। এদের কেউ কেউ চুপিসারে কাজটি করে, কেউ কেউ সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলে এটা করে, কেউ নারীর অর্থনৈতিক দুর্বলতাকে পুঁজি করে অভব্য আচরণ করে। অনেকে বলেন, কোনো কোনো নারী বাড়তি সুবিধা নেয়ার জন্য বা দ্রুত উপরে ওঠার জন্য বা নিজের অদক্ষতা ঢাকার জন্য তার নারীত্বকে ব্যবহার করেন। খুব মুষ্টিমেয় কিছু নারীর আচরণের এই দায় সবার উপরে চাপিয়ে দিয়ে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করাটাও একটি অপরাধ।
ওই মানুষগুলো নারীকে যেখানেই দেখে, সেখানেই ভোগের সামগ্রী মনে করে। আর তাইতো যানবাহনে, বাজারে, সিনেমা হলে, রাজপথে, আন্দোলনের ময়দানে, কর্মক্ষেত্রে, হাসপাতালে, পুলিশী হেফাজতে এবং পরিবারের ভেতরে কোথাও নারী নিরাপদ নয়। নিরাপদ নয় ২ বছরের কন্যাশিশু, নিরাপদ নয় কিশোরী, তরুণী, এমনকি ৫০/৬০ বছরের নারীও। এসব বলতে বলতে, লিখতে লিখতে আমরা হয়রান। প্রতিবাদ করেও কোনো লাভ হয় না। দুনিয়াজুড়ে একই অবস্থা। আর তাইতো শুরু হয়েছে #MeToo আন্দোলন। বাংলাদেশেও এই #MeToo আঘাত করেছে। এই আন্দোলন কতদূর এগুবে, কয়জন মুখ খুলবে, কতজন এই আন্দোলনে পাশে থাকবে, কতটা সত্যি হবে, কতটা মিথ্যা হবে, আমরা জানি না। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মানুষের বিরুদ্ধে কতটা মুখ খোলা যায়, খুললেও কোনো কাজ হয় কিনা এসব নানা প্রশ্ন আমাদের তাড়িত করছে। আমরা অনেকেই বিষয়টি নিয়ে নিজেরা কথা বলছি, ছোট গ্রুপে কথা বলছি, কেউ কেউ স্ট্যাটাস দিচ্ছি। কিন্তু আসলে কতদুর কী হবে?
গত বছর আইএলও এবং গ্যালাপের করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শতকরা ৫০ ভাগ মানুষ চান নারীরা চাকরি করুক। লিঙ্গভেদে হিসাব করলে ৪২ শতাংশ পুরুষ ও ৫৬ শতাংশ নারীই এমনটি চান। নারীর চাকরির বিষয়ে নেপালে এই হার ৮১ শতাংশ, ভারতে ৭০ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা এই ৫০ ভাগ হারকে সন্তোষজনক মনে করেন না। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে পরিবারের সদস্যদের সম্মতি ও অসম্মতির বাইরে সংসার ও অফিসের কাজের সমন্বয়, সন্তানের লালন পালন, পুরুষ সহকর্মীর অশোভন আচরণ ও হয়রানি, কাজের সময় অনমনীয় আচরণ, একই কাজ করে পুরুষের চেয়ে কম বেতন, অনিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা এইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই একজন নারীকে কাজ করতে হয় ।
আমি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চাকুরিজীবি নারীর সাথে কথা বলেছি, তাদের কাছে জানতে চেয়েছি এতসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে কোনটাকে আপনি বড় চ্যালেঞ্জ মনে করেন? প্রায় প্রত্যেকেই বলেছেন, পুরুষ সহকর্মীর অশোভন আচরণ ও হয়রানি এবং এরপর আছে অনিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা। তারা প্রত্যেকেই বলেছেন, কাজের জায়গায় আমরা সবচেয়ে বেশি সময় কাটাই। এখানে যদি পুরুষ সহকর্মী ও বসদের অশালীন আচরণ, মন্তব্য ও আচরণের সম্মুখীন হতে হয়, তাহলে এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে? আমরা অনেক ঝামেলা সহ্য করে চাকরি করি, কাজেই কাজের জায়গায় ভাল পরিবেশ আমাদের অধিকার ।
এককথায় বলা যায়, নারী কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ নয়, নিরাপদ নয় পথঘাট এবং সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে নারী তাদের ঘরেও নিরাপদ নয়। তবে কি আমরা থেমে যাবো? নেতিয়ে পড়বো নাকি আত্মসমর্পণ করবো? একজন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার, যিনি সমাজ-সংসার নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেন, তিনি তার এক লেখায় লিখেছেন: ‘মুরগির মতো নিরীহ পাখি কুট। কুটটা আটকে গেছিল, হয় কোনো ডালে নয়তো মাছ চোরদের পাতা জালে। শক্তিশালী শিকারী পাখি ইউরেশিয়ান মার্শ হ্যারিয়ারটি কয়েকবার চেষ্টা করে ছোঁ মেরে ধারালো থাবায় কুটটাকে তুলে নিতে। কিন্তু প্রতিবারই কুটটার প্রচন্ড ডানা ঝাপটানো প্রতিবাদে ব্যর্থ হয় মার্শ হ্যারিয়ারটি। ক্ষ্যান্ত দেয় সে। বেঁচে যায় কুটটি। ক্ষমতা নয়, অ্যাটিচিউড শারিরীকভাবে দুর্বলদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। মি-টু’র যুগে প্রকৃতি হতে পারে সবচেয়ে বড় শিক্ষক।’
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)