আমাদের অনুভূতিগুলোও অভিনয় করা শিখে গেছে। ভান করা শিখে গেছে বললেও অত্যুক্তি করা হবে না বোধ করি। যেমন স্মৃতিসৌধের মান মর্যাদা নিয়ে সচেতন হয়ে যাই ২৬ মার্চ বা ১৬ ডিসেম্বর এলে। এর পরিষ্কার-পরিছন্নতার ব্যাপারে পুরো জাতি যেন মেতে ওঠে। অন্যসময় যেন কোনো খেয়াল রাখার প্রয়োজন নেই! দেশের শহিদ মিনারগুলো কী অবস্থায় আছে সারা বছর খেয়াল না থাকলেও ২১ ফেব্রুয়ারির আগে ঠিকই সচেতন হয়ে পড়ি। এর মধ্যে দিয়ে আমাদের কৃত্রিম শ্রদ্ধাপ্রকাশই ফুটে ওঠে।
লোকদেখানো এই শ্রদ্ধার মতো পরীক্ষার সময় আমাদের মনে পড়ে গাইড বই নিষিদ্ধ করার কথা। এর দ্বারা শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে- ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক লেকচার পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু হয়ে যায়। সম্প্রতি তাই হয়েছে। তাও হতো কিনা কে জানে। যদি না গাইড বইয়ের প্রশ্নপত্রের সাথে এসএসসির বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্ন হুবুহু মিলে না যেত। টনক তখনই নড়া শুরু হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, কোনো কোনো গাইড ও নোট বই মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান অনৈতিকভাবে কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের আর্থিকভাবে প্রলুব্ধ করে শিক্ষার্থীদের নোট ও গাইড কিনতে বাধ্য করে। এই নোট বই বন্ধে জেলা প্রশাসকের সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।
প্রশ্ন হচ্ছে কেন জেলা প্রশাসকের সহযোগিতা চাইতে হবে। কারা নোট বই বের করে? এটা জানা কি খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার? দেশের বড় বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গাইড বই বিক্রি করে আজ কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। তারাই এখন দেশের বুদ্ধিজীবীদের মাথা কিনে পায়ের ওপর পা উঠিয়ে সৃজনশীল বই বের করার পাশাপাশি গাইড বইয়ের রমরমা ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। কারা গাইড বই প্রকাশ করছে-এটা না জানতে চেয়ে শিক্ষামন্ত্রী কেন জেলা প্রশাসকদের সহযোগিতা চাইলেন বোধগম্য না।
এসব গাইড বইয়ের প্রকাশকরা আজ দেশের হোমড়াচোমড়াদের খুব কাছের মানুষ। যারা সমাজের মাথা তাদের মাথাটা অর্থের বিনিময়ে কিনে নিয়ে ফ্রিজে রেখে দিয়েছেন। সুতরাং ওই গাইড বই বন্ধ করার কথা এখন হাসির খোরাক ছাড়া আর কিছু না তাদের কাছে।
ঢাকা শহরের সব স্কুল কলেজের গভর্নিং বডিতে কারা আছেন? তারা রাজনৈতিকভাবে পদ নিয়ে থাকেন। তাদের ম্যানেজ করেই গাইড বই চলে যাচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাছে। একেকটা বইয়ের দাম ৬০০/৭০০ টাকা। কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে অভিভাবকদের। এসব গাইড বইয়ের সাথে জড়িতদের টিকিটি ধরার সাহস নেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। তাই শিক্ষামন্ত্রী জেলা প্রশাসকদের সহযোগিতা চেয়েছেন, এর চেয়ে সেরা কৌতুক আর কি হতে পারে?
আমাদের সবকিছুতেই গোড়ায় গলদ থেকে যায়। আর তা না খুঁজে আমরা ছুটি শাখা-প্রশাখার দিকে। গোড়ায় কুড়াল চালাতে আমাদের যত ভয়, যত ব্যর্থতা।
একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে- দেশের সেরা গাইড বই কারা বের করছে, যারা এটাকে পুঁজি করে সৃজনশীল বই অর্থাৎ গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এসব বের করছে। আর এখন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বর্ষ উপলক্ষে সরকারের প্রিয়ভাজন হবার জন্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শত শত বই বের করছে তারা। কারণ তাদের সাত খুন মাফ হয়ে যাবে এটা করলে।
এসব গাইড বইয়ের প্রকাশকদের পারলে ধরেন, শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হওয়ার শঙ্কায় আপনি অন্যপথে সাহায্য চেয়েছেন।
আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কত সহজেই কেনা যায়! টাকা পেলে তারা কত কথা বলে। আর মঞ্চে উঠে কত সুন্দর নীতি নৈতিকতার কথা শেখায়। ধিক্ তাদের।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)