একজন সাংসদ বিক্ষুব্ধ জনতার তাড়া খেয়ে দৌড়ে পালাচ্ছেন, একজন সাংসদ বিক্ষুব্ধ জনতার ক্ষোভের আগুনে কাদামাখা অবস্থায় অসহায়; সাংসদের দিকে ছুটে আসছে অসংখ্য কাদামাখা মাটির দলা। এ থেকে বাঁচতে সাংসদ যে ট্রলার নিয়ে এসেছিলেন সেটার দিক ঘুরিয়ে স্থানত্যাগ করছেন। দৃশ্যগুলো অমানবিক হলেও বাস্তব। ঘটনাগুলো আইন হাতে তুলে নেওয়ার মত হলেও শোষিত-বঞ্চিত-বিক্ষুব্ধদের কাছে আইন লঙ্ঘনের মত মনে হচ্ছে না। স্থির চিন্তায় এসব ঘটনা সমর্থনের মত নয় যদিও, তবু বিক্ষুব্ধ আর বঞ্চনায় ক্লিষ্ট মানুষদের আবেগে আর বঞ্চনাকে মূল্য দিতেই হয়। কেন ঘটল এসব? কারা এসবের শিকার, কেন শিকার? প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজাও জরুরি একইভাবে।
জনতার ধাওয়ায় দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার যে ঘটনাটি সেটা বিএনপি সরকারের আমলের। ঢাকার সাংসদ সালাউদ্দিন আহমেদ পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসা জনতাকে আন্দোলন বন্ধের হুমকি দিলে বিক্ষুব্ধ জনতা তাকে ধাওয়া দেয়। অনন্যোপায় সালাউদ্দিন গণরোষ থেকে বাঁচতে দৌড়ে সেই স্থান ত্যাগ করেন। পরেরদিন তার দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। সাধারণ নাগরিকের এই রুদ্রমূর্তির ঘটনা আরও একবার ঘটল। এবার এর শিকার সাংসদের নাম মো. আক্তারুজ্জামান বাবু, তিনি খুলনা-৬ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য।
স্থানীয়দের ভাষ্যে গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার (১ জুন ২০২১) কয়রার মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়া এলাকায় কপোতাক্ষ নদের ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামতে স্বেচ্ছাশ্রমে কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। সাড়ে ১১টার দিকে সেখানে একটি ট্রলার নিয়ে এমপি মো. আক্তারুজ্জামান ও কয়রা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ আরও কয়েকজন সেখানে যান। কাজে ব্যস্ত হাজারও জনতা এমপিকে দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তারা এমপির ট্রলারের দিকে কাঁদা ছুড়ে তাকে ফিরে যেতে বলে। একে একে ক্ষিপ্ত এলাকাবাসী নদীতেও নেমে আসেন। বিক্ষুব্ধ জনতার ছোঁড়া কাদা গিয়ে লাগে সাংসদের গায়েও। অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি ট্রলার নিয়ে ফিরে যান। কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিনি ফের ভাঙনস্থলে ফিরে আসেন। ওই সময় সাংসদ নিজেও ভাঙন মেরামতে অংশ নিতে চাইলে স্বেচ্ছাশ্রমের নিয়োজিত অধিকাংশ জনতা ক্ষুব্ধ হয়ে স্থান ত্যাগ করেন।
উপকূলের দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ খুলনার কয়রা উপজেলা ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে এবারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিবারই এমন ভাঙনের মুখে পড়ে উপকূলবাসী। এলাকার জনতার দাবি টেকসই বাঁধের, কিন্তু স্থানীয় সাংসদের আস্থাভাজন লোকেরা ঠিকাদারি কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয় বলে প্রতিবারই কাজের চাইতে লুটপাট বেশি হয় বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। এনিয়ে এলাকাবাসী বারবার স্থানীয় সাংসদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেও তিনি সেগুলো আমলে নেন না। এবার ফের উপকূলবাসী যখন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তখন এমপিকে সামনে পেয়ে তাদের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছে। যদিও সাংসদ বলছেন তাকে কেউ কাদা ছুঁড়ে মারেনি। তিনি নিজে কাদা মেখেছেন বলে একটি ইংরেজি দৈনিকের সঙ্গে আলাপকালে দাবি করেছেন। সাংসদের অদ্ভুত দাবি, ‘‘আসলে এলাকার লোকজন কাদা মেখে ছিল। কারণ ওই এলাকায় কাদা ছাড়া আর কিছু নেই। চারিদিকে শুধু পেরি কাদা। তারা চেয়েছিল আমি কাদা মাখি। এতে তারা খুশি হয়। সে কারণে আমার গায়ে কাদা। তারা যে আমার গায়ে কাদা ছুঁড়েছে, সে কারণে নয়।’’ কী হাস্যকর!
সালাউদ্দিন আহমেদ ও আক্তারুজ্জামান বাবু যখন জনতার রুদ্ররোষের কবলে পড়েন তখন তাদের সঙ্গে পুলিশ ছিল, কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতা সেগুলো পাত্তা না দিয়ে তাদের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছে। কতখানি বঞ্চিত-নিপীড়িত হলে মানুষ পুলিশি প্রহরায় থাকা একজন এমপির বিরুদ্ধে এমন আক্রমণাত্মক হয়?
সালাউদ্দিন আহমেদ ও আক্তারুজ্জামান বাবুর প্রতি মানুষের এই অবস্থানকে আমরা নৈতিকভাবে হয়ত সমর্থন দিতে পারি না, কিন্তু একই সঙ্গে গণরোষের ভাষাকেও অস্বীকার করতে পারি না। জনতার শক্তি, প্রতিবাদের ভাষা ত সবসময়ই শাসকের বিরুদ্ধে হয়ে থাকে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ কোনোসময়ই ব্যাকরণ মেনে হয় না। মানুষ তখনই বিক্ষুব্ধ হয় যখন দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়, মানুষের যৌক্তিক দাবিগুলো যখন দায়িত্বশীলেরা মেনে নেয় না, এড়িয়ে যায় বা অস্বীকার করে তখন বাধ্য হয়ে মানুষ প্রতিরোধের পথে পা বাড়ায়। আক্তারুজ্জামান বাবুর সঙ্গে পুলিশ সদস্য থাকা সত্ত্বেও সেগুলোকে পাত্তা দেয়নি মানুষ কারণ এই বেড়িবাঁধ তাদের কাছে জীবন-মরণের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জনতার ধাওয়া খাওয়া সাংসদ আক্তারুজ্জামান বাবু যতই অস্বীকার করুন না কেন এটা তার এবং অন্য সকল জনপ্রতিনিধিদের কাছে বার্তাবিশেষও। সাধারণেরা সারাজীবনই নিরীহ ও সাধারণ হয়ে থাকে তবে যখন ক্ষেপে যায় তখন জনপ্রতিনিধিদের ইজ্জত নিয়েই টান দিয়ে দেয়। খুলনার একটি আসনের সাংসদ আক্তারুজ্জামান বাবু জাতীয় পর্যায়ের পরিচিত ব্যক্তিত্ব না হলেও অদ্যকার ঘটনায় সারাদেশে তার নাম ও চেহারাকে পরিচিত করে দিয়েছে। যদিও এটা তার জন্যে সুখের খবর নয়, তবু চাইলেও তিনি এই ঘটনাকে অস্বীকার করতে, আড়াল করতে পারবেন না। ন্যায়-অন্যায়ের নিক্তিতে না মেপে মানুষ তাকে এক ব্যর্থ সাংসদ হিসেবেই এখন থেকে দেখছে। এখানে তার প্রতি কোথাও থেকে কোন সহানুভূতির বার্তা আসছে না, আসছে ধিক্কার; যা তার কৃতকর্মের ফল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
এই ঘটনার পর আমরা আশা করেছিলাম কেন্দ্রে তার ডাক পড়বে, কারণ দর্শাতে বলা হবে, অথবা ঘটনার পূর্বাপর জানার চেষ্টা হবে। কিন্তু ঘটনার চব্বিশ ঘণ্টা পরও এমন কোন সংবাদ চোখে পড়েনি। যে দলের মনোনয়নে তিনি সংসদ সদস্য হয়েছেন সেই দল তার বক্তব্য জানতে চায়নি, দলের পক্ষ থেকে কোন তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়নি। অথচ এসব জরুরি ছিল। জনকল্যাণকামী যেকোনো রাজনৈতিক দলের এমন উদ্যোগ দৃশ্যমান হলে অন্তত সাংসদদের ওপর অদৃশ্য এক চাপ থাকত এলাকার সেবার জন্যে। আওয়ামী লীগ এই পথে যায়নি। দল হিসেবে এখানে কি আওয়ামী লীগের কোন দায়িত্ব নাই, প্রশ্ন!
আমরা বলছি, এটা জনতা থেকে জনপ্রতিনিধির প্রতি একটা বার্তা। কিন্তু এই বার্তাকে গ্রহণ করেনি আওয়ামী লীগ। জনতার দল হিসেবে যে রাজনৈতিক দলের বিকাশ ও পথচলা সেই দলের পক্ষ থেকে জনতার ভাষাকে অগ্রাহ্য করার এই প্রবণতা দুঃখজনক।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন- ‘দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি’। আক্তারুজ্জামান বাবু এমপির প্রতি বিক্ষুব্ধ মানুষের কাদা ছোড়ার ঘটনার জানাজানি হওয়ার পর তিনি ওই ভিডিওচিত্র সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘ভিডিওতে যা দেখা যাচ্ছে তা ঠিক না।’’ তার প্রশ্ন, ‘‘আমাকে কি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে আমাকে কাদা মারা হচ্ছে?’’ আবার এই সাংসদ বলছেন, ‘‘তারা (জনতা) চেয়েছিল আমি কাদা মাখি। এতে তারা খুশি হয়। সে কারণে আমার গায়ে কাদা। তারা যে আমার গায়ে কাদা ছুঁড়েছে, সে কারণে নয়।’’ অসত্যের কুহকে আটকা আমাদের সম্মানিত সাংসদ। রবীন্দ্রনাথের লেখায় উল্লেখিত দ্বার বন্ধ রেখে তিনি জনতার চাওয়া-পাওয়ার দাবিকে অগ্রাহ্য করার মত ভ্রমটাকে রুখতে চান, তার দলও দ্বার বন্ধ রেখে, চোখ বন্ধ রেখে নিজ দলের সাংসদের প্রতি গণরোষকে আড়াল করতে চায়। কিন্তু এ কি সম্ভব? তথ্য-প্রযুক্তির যুগে সত্য ঘটনা ঠিকই মানুষের সামনে প্রকাশ হয়ে যায়, প্রকাশ হয়ে গেছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)