ভাষার মাস অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি এলে কিছু ‘চেতনা’ আমাদের উদ্দীপ্ত করে, জাগ্রত করে। সঙ্গত কারণে এই চেতনা নিয়ে কিছু ব্যবসাও শুরু হয়। কিছু লোক চেতনাজীবী হয়ে ওঠেন।
প্রমিত বাংলায় কথা বলার চেষ্টা না থাকলেও তারা একুশের প্রথম প্রহরে কিংবা ভোরে প্রভাতফেরিতে শহীদ মিনারে ফুল দেন। কোনো না কোনোভাবে টেলিভিশনের ক্যামেরায় ধরা দেয়ার চেষ্টা করেন।কেউ কেউ অতি আবেগে বলে ফেলেন, তিরিশ লাখ শহীদের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের ভাষা। অর্থাৎ যে কারণে শহীদ মিনারে গেলেন, সেই ইতিহাসটুকু জানারও কোনো তাগিদ নেই।
বাংলা একাডেমির ভেতরে যখন পাঁচ ভাষাশহীদের ভাস্কর্য স্থাপন করা হলো, ওই বছরের একুশে গ্রন্থমেলায় আসা কয়েকজন তরুণ যারা রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাধ্যমিকে বা তারও উপরের ক্লাসে পড়েন, তাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই পাঁচজনকে তারা চেনেন কি না। দুয়েকজন সঠিক জবাব দিলেও অধিকাংশই বলেছেন, ওই পাঁচজন হলেন মু্ক্তিযোদ্ধা। কেউ কেউ একটু হেসে দিয়ে বলেছেন, না ভাইয়া, জানা নেই।…
তো ভাষার চেতনাটা কী? একুশে ফেব্রুয়ারি সাদাকালো পোশাক পরে, মাথায় ফুল গুঁজে প্রিয়জনের সাথে রিকশায় ঘুরে বেড়ানো? ব্যবসা এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে, এখন পয়লা বৈশাখের মতো একুশের পোশাক বলে আলাদা জিনিসও বাজারে বিক্রি হয়। ফেসবুকে একজন লিখেছেন, হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আমরা টেলিভিশনে একুশের রান্নাও দেখতে পাব।
আমরা যদি গণমাধ্যমের ভাষার দিকে নজর দিই, বিশেষ করে বেসরকারি এফএম রেডিওগুলোর কথাবন্ধু বা আরজে’রা (দু চারজন ব্যতিক্রম বাদ দিলে) যে ভাষায়, যে টোনে এবং যে স্টাইলে বাংলা বলেন, তাতে শ্রোতাদের পক্ষে অনেক সময়ই এটা বোঝা মুশকিল হয় যে, এটা বাংলা না ইংরেজি নাকি অন্য কোনো নতুন ভাষা?
একটি নতুন ভাষা নির্মাণের এই চেষ্টা অনেকদিন ধরেই করে যাচ্ছেন কিছু সেলিব্রিটি। যারা বলেন এটি নাগরিক জীবনের ভাষা। গেছি, খাইছি, হাই ইত্যাদি। অসুবিধা নাই। আপনি আপনার বক্তিগত কিংবা সামাজিক যোগাযোগে যে কোনো ভাষায়ই ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু গণমাধ্যমের ভাষা কী হবে? নাটক-সিনেমা বাদ দিলে সংবাদ ও সিরিয়াস অনুষ্ঠানের ভাষা কী হবে? সেখানে কি প্রমিত বা একটি অভিন্ন ভাষারীতি থাকা উচিত নয়?
এ নিয়েও বিতর্ক আছে। কেউ কেউ বলেন, ভাষা হচ্ছে নদীর মতো। তাকে বইতে দাও। কারণ আঠারো শতকে বাংলা ভাষায় যা ছিল প্রমিত বা মানভাষা, বিশ শতকে তা বদলে গেছে, সুতরাং একুশ শতকে তা আরও বদলাবে। আগামী শতকে বাংলার মানভাষা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আমরা জানি না। ফলে বিষয়টা নিয়ে এখন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আলোচনারই সময় এসেছে।
কে করবে এই আলোচনা? সংবিধানে আমরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা বলে উল্লেখ করলেও স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও আমরা একটি ভাষানীতি বা ভাষাপরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারিনি।এখনও উচ্চ আদালতের রায় লেখা হয় ইংরেজিতে। কখনো বাংলা-ইংরেজির মিশ্রণে। যদিও এবার একুশে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, শিগগিরই উচ্চ আদালতেও বাংলায় রায় লেখার প্রক্রিয়া শুরু হবে। এজন্য সহায়তা নেয়া হবে বিশেষ ডিভাইস বা যন্ত্রের, যাতে করে ইংরেজিতে লিখলেও সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলায় অনূদিত হয়ে যাবে।
আদালতের রায় লেখা বা যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের ক্ষেত্রে একটা বড় জটিলতা হলো আইনের ভাষা ও বহু শব্দের উপযুক্ত বাংলা না থাকা। যে কারণে বহুদিন ধরেই এই দাবিটিও রয়েছে যে, সব আইন বাংলায় করতে হবে। এরই মধ্যে বেশকিছু আইন, বিশেষ করে পুলিশ আইনও বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। এখন আদালত বা বিচার বিভাগ সম্পর্কিত সব ইংরেজি ও বিদেশি শব্দের যুৎসই বাংলা করতে হবে। সেই চেষ্টা অবশ্য চলছে।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি ভাষার এসব বিবিধ বিষয় নিয়ে পিআইবি মহাপরিচালক, আমাদের অগ্রজ সাংবাদিক শাহ আলমগীরের সঙ্গে আমার কিছু ভাসা ভাসা কথা হয়। তিনি জানান, তারা গণমাধ্যমে বাংলা ভাষার ‘বিকৃতি’ ও ‘নৈরাজ্য’ ঠেকাতে একটি জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করছেন। যেখানে পিআইবি ছাড়াও থাকবে বাংলা একাডেমি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
দু’দিনব্যাপী ওই সেমিনারে গণমাধ্যমের ভাষা নিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ উপস্থাপিত হবে এবং পুরো আলোচনা রেকর্ড করা হবে। পরে সেগুলোর একটি সংকলন বের করবে পিআইবি।
এখানেই শেষ নয়; গণমাধ্যমে প্রমিত বাংলার চর্চা নিশ্চিত করতে ওই সেমিনার থেকে কিছু প্রস্তাব পেশ করা হবে এবং একটি কমিটি করে দেয়া হবে যারা বিষয়গুলো নজরদারি বা তদারক করবে। ওই কমিটি প্রতি মাসে একটি সংবাদপত্রের সব খবর ও লেখায় টানা এক মাস খেয়াল রাখবে, নোট করবে এবং যেসব বানান তারা ভুল করেছে বা বিকৃত করেছে সেগুলো চিহ্নিত করে একটি চিঠি দেবে ওই পত্রিকার সম্পাদককে। যেখানে ভবিষ্যতে এসব বানান প্রমিত/শুদ্ধভাবে লেখার অনুরোধ থাকবে।
তবে আলমগীর ভাইয়ের কাছে আমার প্রশ্ন ছিল, সংবাদপত্রে প্রকাশিত অনেক শব্দের বানান বাংলা একাডেমির সঙ্গে মেলে না। কারণ প্রথম আলোসহ আরও কেউ কেউ তাদের নিজস্ব বানান-রীতি অনুসরণ করে। সেক্ষেত্রে কমিটি কীভাবে বিষয়টি মনিটর করবে। এর জবাবে তিনি বলেন, সংবাদমাধ্যমের নিজস্ব বানান-রীতি থাকতে পারে। কিন্তু সেটি যাতে কোনোভাবে ভাষার বিকৃতি না ঘটায় এবং যাতে সবাই একটি অভিন্ন বানান অনুসরণ করতে পারে, সেই প্রচেষ্টা থাকবে এই কমিটির।
আমাদের কেন একটি রাষ্ট্রীয় ভাষানীতি বা ভাষাপরিকল্পনা প্রয়োজন? কারণ, আমাদের শিক্ষার মাধ্যম বহুবিভক্ত এবং চরম বৈষম্যপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার কারণে ভালো ইংরেজি জানা লোকের চাকরির বাজার বড়। ফলে ভালো বাংলা জানা লোক যত মেধাবীই হোক, ইংরেজি জানা লোকের সঙ্গে সে প্রতিযোগিতায় টেকে না। এজন্য অর্থনীতির বিশ্বায়নকে দায়ী করা হলেও এটি স্পষ্টতই রফিক-সালাম-বরকতের রক্তের অবমাননা।
কোনো গণমাধ্যম নিজস্ব স্টাইলের নামে যা খুশি এবং যেভাবে ইচ্ছা বাংলা লেখার বা বলার অধিকার রাখে কি না, সেটি রাষ্ট্রকেই ঠিক করতে হবে। আর এজন্যই প্রয়োজন ভাষানীতি ও ভাষাপরিকল্পনা।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয়, বিশেষ করে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের বাংলা অর্থাৎ মাতৃভাষা শেখানোর কী আয়োজন আছে? সব পড়লেখার চূড়ান্ত লক্ষ্য ভালো চাকরি। পড়ালেখা এখন আর জ্ঞান অর্জনের বিষয় নয়। এটা এখন প্রতিযোগিতা। সুতরাং এই বাজার অর্থনীতি আর চাকরি পাওয়ার প্রতিযোগিতায় ভাষাপরিকল্পনা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক এ কারণে যে, সার্টিফিকেটসর্বস্ব পড়ালেখার কারণে এখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনের পরও অধিকাংশ লোক তার নিজের ভাষায় অর্থাৎ বাংলায় পাঁচটি নির্ভুল বাক্য লিখতে পারে না। সেখানে তিনটি বানান ভুল থাকবে, দুটি বাক্য অসংলগ্ন থাকবে। সুতরাং শুধু গণমাধ্যমের ভাষাই নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রমিত বাংলা শেখানোর জন্যও একটা বড় পরিকল্পনা নিতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)