চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘গণপিটুনিতে মৃত্যু’ যত মব, তত রব

আগে মানুষ দৌঁড়ে গিয়ে মানুষের বিপদে ঝাঁপ দিতো। আর এখন? দৌঁড়ে গিয়ে অন্যকে পিটিয়ে মারে। গণপিটুনি ও প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা এবং এসব ঘটনায় জনতার প্রতিরোধহীনতা তথা নিষ্ক্রিয়তা বাংলাদেশসহ উপমহাদেশীয় সমাজে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। যদিও সচেতন জনপরিসরে এটি নিয়ে উদ্বেগও লক্ষ্যণীয়। প্রাচীন মার্কিন সমাজে কৃষাঙ্গদের ওপর একদিন এভাবেই পপুলার হয়ে ওঠেছিলো উন্মত্ত জনতার আদালত। সমাজে যখন বলপ্রয়োগ এবং আধিপত্যই হয়ে ওঠে স্বাভাবিক প্রবণতা, তখন মানুষ যুক্তি আর সহিষ্ণুতা ভুলে যায়। আইন ও বিচারব্যবস্থার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে উত্তেজিত জনতা সম্মিলিতভাবে বিচার হাতে তুলে নেয়। শুরু হয় মব লিঞ্চিং বা গণপ্রহার।

মব (Mob) মানে উত্তেজিত জনতা। যাদের বলা হয় হুজুগে জনতা। লিঞ্চিং (Lynching) অর্থ বিচার বহির্ভূত হত্যা। মব-লিঞ্চিং এর আভিধানিক বাংলা গণপ্রহার; প্রচলিত অর্থে গণধোলাই। লিঞ্চিং মানে শুধু মারধর বোঝায় না। উত্তেজিত জনতা দ্বারা কোন একক ব্যাক্তিকে বা একদলকে পেটানো, কোপানো, পোড়ানো বোঝায়। এই উত্তেজিত জনতার আচরণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সমাজ মনোবিজ্ঞানী গুস্তাভ লে বোঁ (Gustave Le Bon) বলেন, জনতার ভিড়ে ব্যক্তির ব্যক্তিসত্ত্বার বিলুপ্তি ঘটে এবং প্রতিজন ব্যক্তি মিলে উত্তেজিত জনতার সমষ্টি তৈরি হয়। জনতার ‘সম্মিলিত মন’ তখন বিপদজনক সিদ্ধান্ত নেয়। এর পেছনে কাজ করে আরেকটি বিষয়, তা হলো গুজব। গুজব নিয়ে সারা দুনিয়ার অন্যতম আলোচিত উক্তিটি হলো- ‘সত্য যখন কেবল জুতায় পা ঢোকাচ্ছে, গুজব ততক্ষণে গোটা দুনিয়া টহল দিয়ে ফেলেছ’ [টেরি প্রাচেত: দ্য ট্রুথ]। পদ্মাসেতুতে রক্ত লাগার গুজবের তরকারিতে ঘি ঢেলেছে ছেলেধরার গুজব, সেই ছেলেধরার গুজবের চুলার আগুনের হাওয়া দিয়েছে চট্টগ্রামের ইসকন-হেফাজত, সেই গুজবের সর্বশেষ পরিণতি ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার ‘সরল’ তথ্যবিকৃতি। সবমিলে সারাদেশ এখন পাকা-গুজবের কারখানা!

গুজব হলো তাই, যা সত্য নয়; নিশ্চিত তথ্য দ্বারা অসমর্থিত। গণযোগাযোগ তাত্ত্বিকদের মতে, যেকোন সমাজেই গুজব ঘটতে পারে। তবে গণসমাজে যেহেতু একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন সেহেতু এই সমাজে গুজবের প্রবণতাও বেশি। সাংবাদিকতায় ‘গুজব’ কখনোই সংবাদ নয়। কিন্তু, সমাজে কোন গুজব চাউর হলে, সেই গুজবের উৎস চিহ্নিত করা সাংবাদিকের কাজ।

সম্প্রতি দেশে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। রাজধানীসহ সাত জেলায় ১৩ দিনে অন্তত ৫ জন নিহত ও ২০ জনের মতো ব্যক্তিকে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে [আমাদের সময়, ২০ জুলাই, ২০১৯]। গত ২০১৮ সালের মে-জুন মাসে ভারতের নানা প্রান্তে ছেলেধরার গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনি দিয়ে অন্তত ১৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে [বিবিসি বাংলা, কলকাতা, ৫ জুলাই]। এভাবেই দেশে দেশে ছেলেধরা গুজব তৈরি হয়ে আসছে। সফল গুজবের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই হল, মানুষ সেটা বিশ্বাস করতে চাইবে কিন্তু পুরোপুরি বিশ্বাস না করে অন্তর্গত টানাপোড়েনে ভুগবে। ‘নিউমিডিয়ার দাপুটে চেহারা দেখার আগে, ওয়ার্ডস অব মাউথ বা মুখে মুখে গুজব ছড়ানোর সংস্কৃতি ছিলো। আজ মধ্যম আয়ের এই পোড়া দেশে হোয়াটসএপ, ফেসবুক আর মেসেঞ্জারে ভালো খবর ছড়াতে সময় লাগে, কিন্তু গুজব বা ভুয়া খবর হু হু করে ছড়ায় দাবানলের বেগে।

বাংলাদেশে ২০১৫ সালে আলোচিত গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। সারাদেশে একদিনে নয় ডাকাত নিহত হওয়ার ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়। এর কিছুদিন পর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় পুলিশের গাড়ি থেকে ডাকাত বলে নামিয়ে দেওয়ার পর কিশোর শামসুদ্দিন মিলনকে (১৬) জনতা গণপিটুনি দিলে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। পৃথক আরেক ঘটনায় সিলেটের চেঙ্গেরখালে ফেলে পিটিয়ে শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র হত্যা করা হয়। ২০১১ সালের জুলাই মাসে ঘটে পৃথক দু’টি মর্মান্তিক গণপিটিুনির ঘটনা। শবেবরাতের রাতে ডাকাত আখ্যা দিয়ে আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামে ছয় কলেজ ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। এর রেশ না কাটতেই নোয়াখালীর চরকাঁকড়া টেকারবাজার এলাকায় শামছুদ্দিন মিলন নামের এক কিশোরকে ডাকাত আখ্যা দিয়ে নিজেদের ভ্যান থেকে জনতার হাতে তুলে দেয় পুলিশ। তখন পুলিশের সামনেই জনতা নিরপরাধ মিলনকে পিটিয়ে হত্যা করে। জানা গেছে, গত আট বছরেও এইসব গণপিটুনি ও খুনের মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ হয়নি।

ভারত-বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, সমাজে জনতার হাতে আইন তুলে নেয়ার প্রবণতা দিনদিন ভয়াবহ হচ্ছে। কোন কোন মব লিঞ্চিং পূর্বপরিকল্পিতও বটে। মবলিঞ্চিংয়ে রাষ্ট্র পরোক্ষভাবে এমন একটি অবস্থা সৃষ্টি করবে, যখন উন্মত্ত জনতার আদালত সর্বস্তরে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। যদিও কোন কোন গণপিটুনির ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গণপিটুনির পর জনতা নিজ উদ্যোগে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছে ভিকটিমকে! ভারত ও বাংলাদেশে গত ১০ বছরে চাঞ্চল্যকর ২০টি গণপিটুনির কোন বিচার হয়নি এবং সঠিক তদন্তও হয়নি। এরকম বেশকিছু ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশি ভিকটিম হচ্ছে এবং ভারতের ভিকটিম মুসলিম সম্প্রদায় যারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু। দুই দেশে গণপিটুনি বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে দেখা যায়, রাষ্ট্র পরোক্ষভাবে এমন একটি অবস্থা সৃষ্টি করবে, যখন উন্মত্ত জনতার আদালত সর্বস্তরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠবে। যদিও কোন কোন গণপিটুনির ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গণপিটুনির পর জনতা নিজ উদ্যোগে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছে ভিকটিমকে! সহিংসতার আড়ালে ভারত-বাংলাদেশের সমাজে যে গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে এবং যে আকারে তা বিকশিত হয়েছে তাতে সমাজ যাত্রা করেছে দীর্ঘমেয়াদী ভয়ের সংস্কৃতির পথে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ এক নিবন্ধে (মর্জিনা আক্তার ও ভয়ের সংস্কৃতি, আলী রীয়াজ, এইদেশ, জানুয়ারি ২০, ২০১৩) লিখেছিলেন, ‘যে সমাজে হত্যাকাণ্ডের বিচার হয় না, এক শ্রেণীর মানুষ একধরণের দায়মুক্তি ভোগ করেন, সরকারের পক্ষ থেকে হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনার চেয়ে রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণের প্রবণতা স্পষ্ট সেখানে এ ধরণের প্রবণতা আগামীতে আরো বাড়বে বলে আশংকা করতে পারি। সেটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য কোনো অবস্থাতেই ইতিবাচক কিছুর ইঙ্গিত দেয়না। বরঞ্চ সমাজে যে ভয়ের সংস্কৃতি তার আধিপত্য বিস্তার করেছে এটি তার আরেকটি প্রমাণ’। ভারত ও বাংলাদেশের সমাজে ক্রমবর্ধমান গণপিটুনি নিয়ে উদ্বেগের শেষ নেই। গণপিটুনির পাশাপাশি প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা এবং এসব ঘটনায় জনতার প্রতিরোধহীনতা তথা নিষ্ক্রিয়তাও দৃশ্যমান। সচেতন জনপরিসরে এই উদ্বেগ লক্ষ্যণীয়। প্রাচীন মার্কিন সমাজে কৃষাঙ্গদের ওপর এভাবেই পপুলার হয়ে ওঠেছিলো উন্মত্ত জনতার আদালত। সমাজে যখন বলপ্রয়োগ এবং আধিপত্যই হয়ে ওঠে স্বাভাবিক প্রবণতা, তখন মানুষ যুক্তি আর সহিষ্ণুতা হতে ভুলে যায়। আইন ও বিচারব্যবস্থার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে উত্তেজিত জনতা সম্মিলিতভাবে বিচার হাতে তুলে নেয়, যার নাম- গণপিটুনি। গণপিটুনির পাশাপাশি সমাজে চলছে সহিংসতা। সম্প্রতি বাংলাদেশের বরগুনায় এক যুবককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা এবং ভারতের ঝাড়খণ্ডে প্রকাশ্যে আরেকজন যুবককে পিটিয়ে মারার ঘটনা দুই দেশে আলোড়ন তুলেছে। দুই দেশের মানবাধিকার কর্মী এবং গবেষকরা বারবার বলে আসছেন যে, সামাজিক অসহিষ্ণুতা, মত প্রকাশ, সরকারের সমালোচনা এবং ধর্মীয় সমালোচনা এসব বিষয় এখন বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

‘গণপিটুনি’ বলে গণমাধ্যমে বর্ণিত আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আস্থার অভাবকে ইঙ্গিত করা হয়। যখনই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আস্থা হ্রাস পায় এবং প্রচলিত আইনে অপরাধীদের বিচারের সম্ভাবনা না থাকে, তখনই এ ধরনের ঘটনাবলি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে দেশে এ ধরনের কার্যকলাপের ভয়াবহভাবে শুরু হয়। যেমন: বাংলাদেশের স্বাধীনতাত্তোর ঢাকা ফুটবল লীগে জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী দুই দল মোহামেডান-আবাহনীর খেলার সুচনাটাই হয়েছিলো গণপিটুনির মাঝে। খেলোয়াড়দের হাতাহাতির রেশ গ্যালারিতে ছড়িয়ে পড়লে খেলা আর শেষ হতে পারেনি। পণ্ড হয়ে যায় খেলাটি বিরতির কিছু পরেই। আক্রমণমুখী জনতার হিংস্রতা থেকেই মবলিঞ্চিং এর উৎপত্তি। এর ইতিহাস দীর্ঘ।

‘লিঞ্চ’ শব্দটি এসেছে মার্কিন মুলুক থেকে। সমাজতাত্ত্বিক জেমস কাটলার বলেছিলেন, ‘লিঞ্চিং’ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় অপরাধ। মার্কিন রেভোলিউশনের সময় ‘লিঞ্চ ল’ (বিচার ছাড়াই শাস্তি) থেকেই ‘লিঞ্চিং’-এর উৎপত্তি। কাউকে লিঞ্চ করে মারাটা একটা উৎসবের চেহারা নিত সে সময়। পিটিয়ে, খুঁচিয়ে, পুড়িয়ে, শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে, শহর জুড়ে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে, গাছে ঝুলিয়ে চলত নানা রকম অত্যাচার। ঘটনার সাক্ষী থাকত কয়েকশো থেকে কয়েক হাজার শ্বেতাঙ্গ। কখনও সখনও লিঞ্চিং-এর আগাম নোটিশ ছাপা হতো (সূত্র: জনতা ঈশ্বরকেও গণপ্রহার দিতে ছাড়ে না, ২৯ জুলাই, ২০১৭; আনন্দবাজার পত্রিকা)।

আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদ থেকে জানা যায়, ২০১৬ থেকে এই নিয়ে ১৩ জনকে পিটিয়ে মারা হয় ঝাড়খণ্ডে। এর প্রায় প্রত্যেকটি ঘটনাতেই আঙুল উঠেছে হিন্দুত্ববাদী বা গোরক্ষকদের দিকে। গোরক্ষকদের তাণ্ডবলীলা দেখে রীতিমতো শিহরিত ভারতীয় সর্বোচ্চ আদালতও। মালদহ, দুই দিনাজপুর, বীরভূম,পশ্চিম মেদিনীপুরসহ রাজ্য়ের বিভিন্ন জায়গায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনা বেশ আলোচিত ছিলো। ফলে রাজস্থান থেকে পশ্চিমবঙ্গ, হরিয়ানা থেকে কর্নাটক— সর্বত্র একই ছবি, হিংসা। গোরক্ষার নামে একের পর হামলা চলছে সংখ্যালঘুর ওপরে, বিশেষত মুসলিমদের ওপরে। ২০১৫ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আখলাখ থেকে শুরু করে ২০১৭ সালের ২২ জুন হাফিজ জুনায়েদ খান পর্যন্ত অগনিত মুসলমানকে গো-রক্ষকরা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। এসব ঘটনা ভারতের সর্বত্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মনে ভীতি সঞ্চার করেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আসাম থেকে তামিলনাড়ু, গত এক বছরে নয় রাজ্যে ছেলেধরার গুজবে ১৫টির মতো গণপিটুনির ঘটনায় ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। আনন্দবাজার পত্রিকার আরেকটি সংবাদ থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি দেশের মসনদে বসার পর থেকেই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এবং অসহিষ্ণুতার ঘটনার সংখ্যা যেন লাফিয়ে বেড়েছে। ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে দেশে গো-রক্ষার নামে হিংসার ঘটনা ঘটেছিল ২টি। ২০১৪ থেকে ২০১৮, এই সংখ্যা এক লাফে বেড়ে হয়েছে ৮৫। মোদী জমানায় ৪,১৫০ শতাংশ বেড়েছে এমন ঘটনা। তার সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছে আর এক বিপদ— গুজবের ভিত্তিতে গণপ্রহার। গত দেড় বছরে শুধু ছেলেধরা গুজবে ৬৯টি হামলা হয়েছে। তাতে মৃত্যু হয়েছে ৩৩ জনের। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে আঁচ করাই যায়। ২০১০ থেকে ২০১৪-র আগে পর্যন্ত দেশে গোরক্ষার নামে হামলার ঘটনা মাত্র ২টি। আক্রান্ত ৪ জন। তবে সে সব হামলায় কারও মৃত্যু হয়নি। আর ২০১৪ থেকে ২০১৮-র জুলাই পর্যন্ত হামলার সংখ্যা ৮৫। আক্রান্ত হয়েছেন ২৮৫ জন। মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৩৪ জনের। (সূত্র: গো-রক্ষার নামে হিংসা ৪১৫০% বাড়ল এই জমানায়! আনন্দবাজার পত্রিকা, ১ অাগস্ট, ২০১৮)

ভারত ও বাংলাদেশে গত ১০ বছরে চাঞ্চল্যকর ২০টি গণপিটুনির কোন বিচার হয়নি এবং সঠিক তদন্তও হয়নি। ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশি ভিকটিম হচ্ছে এবং ভারতের ভিকটিম মুসলিম সম্প্রদায় যারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু। গণপিটুনি এবং সামাজিক সহিংসতার জন্য মানুষের নির্বিকার হিংস্র মনোভঙ্গি এবং অপরাপর মানুষের নিষ্ক্রিয়তা অন্যতম দায়ী। রাষ্ট্র কখনোই এই গণপিটুনির দায় এড়াতে পারে না।

বাংলাদেশে গত জানুয়ারি মাসে ঝালকাঠি এবং নোয়াখালীতে গরু চুরির অভিযোগে দুই ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। এ দুটি ঘটনা আলাদা হলেও এর ধরণ এবং ফলাফল ছিলো একই। গ্রামবাসীর অভিযোগ তারা দু’জনই গরু চুরি করতে এসেছিল। তাদের দাবি, গ্রামের অনেকের বাড়ি থেকে প্রায়ই গরু চুরির ঘটনা ঘটছে। ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ তারিখ চ্যানেল আই অনলাইনে প্রকাশিত ‘গণপিটুনিতে হত্যা: আড়ালে কী ঘটছে, তদন্ত করতে হবে’ প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ধরনের ঘটনা যে শুধু শুক্রবার দিবাগত রাতেই ঘটেছে – তা নয়, গত ১১ দিনের মধ্যে আরও দুটি ঘটনায় অন্তত চারজনকে একইভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এই দুটি ঘটনাই ঘটে গাজীপুরে। এর একটি ১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতের। গরু চোর সন্দেহে কালিয়াকৈরের নাওলা এলাকায় দুইজনকে হত্যা করা হয়। এর ঠিক একদিন আগে ৩০ তারিখ রাতে কালীগঞ্জ উপজেলায় এক বাড়িতে ডাকাতির পর সন্দেহভাজন দুইজন ধরে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয়রা।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের  অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ তার এক লেখায় (বন্ধ হোক ‘পিষে মারার সংস্কৃতি’, প্রথম আলো, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৫) বলেছেন, ‘কখনো কখনো একটি-দুটি ঘটনা সমাজের ভেতরের অদৃশ্য প্রবণতাকে তুলে ধরে। কিন্তু যখন একই ধরনের ঘটনা উপর্যুপরিভাবে ঘটে, তখন একে আমরা অদৃশ্য প্রবণতা না বলে সমাজের ছবি বলেই গণ্য করি‘। এইভাবে বছরের পর বছর ধরে গণপিটুনির ঘটনা চলে আসছে এবং তা সাম্প্রতিক সময়ে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। গণপিটুনি এবং সামাজিক সহিংসতার জন্য মানুষের নির্বিকার হিংস্র মনোভঙ্গি এবং অপরাপর মানুষের নিষ্ক্রিয়তা অন্যতম দায়ী। রাষ্ট্র কখনোই এই গণপিটুনির দায় এড়াতে পারে না। সহিংসতার আড়ালে ভারত-বাংলাদেশের সমাজে যে গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে এবং যে আকারে তা বিকশিত হয়েছে তাতে সমাজ যাত্রা করেছে দীর্ঘমেয়াদী ভয়ের সংস্কৃতির পথে। সমাজে সহিংসতা ঘটছে, যার ফলে ভয়, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বাড়ছে। ভয়ের সংস্কৃতির প্রাবল্য বোঝার জন্য আজকের দুনিয়াতে ভারত-বাংলাদেশ চমৎকার দুটি উদাহরণ। এই দুই সমাজেই অসহিষ্ণুতা বেড়েছে। ফলে এসব গণপিটুনির সহজলভ্যতা আমাদেরকে স্পষ্টত দেখিয়ে দিচ্ছে যে, আমরা হয়তো চূড়ান্ত ক্রান্তিকালের ভেতর যাত্রা করছি।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)