করোনার প্রকোপ হঠাৎ মারাত্মক হারে বেড়ে যাওয়াতে দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। গতবছরের আক্রান্তের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে এবছরে এসে। গত সোমবার (২৯ মার্চ) রেকর্ড ৫ হাজার ১৮১ জন শনাক্তের পর মঙ্গলবারও শনাক্তের সংখ্যা ৫ হাজারের ঘরে আছে। আর মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৯৯৪ জনে (৩০ মার্চ)।
এই যখন অবস্থা, তখন সারাদেশের বিভিন্ন সামাজিক-দাপ্তরিক কার্যক্রমে নতুন নির্দেশনা জারির পাশাপাশি গণপরিবহনে ৫০% যাত্রী বহনের বাধ্যবাধকতা দিয়ে ৬০% ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মঙ্গলবার তার সরকারি বাসভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন: “করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে আগামীকাল বুধবার থেকে দেশের সকল গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী নেয়া সাপেক্ষে ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আগামী দুই সপ্তাহ পর্যন্ত এ আদেশ বহাল থাকবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ভাড়া পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে।” অর্থাৎ লোকাল যে বাসের ভাড়া ১০ টাকা ছিল, তা এখন ১৬ টাকা হবে। সেভাবেই দূরপাল্লার যে বাসের ভাড়া ১০০০ টাকা ছিল, তা এখন ১৬০০ টাকা হবে। পাশাপাশি সিট খালি রেখে যাত্রী বহনের কারণের এই নতুন নির্দেশনা।
যদিও ভাড়া বাড়ানো হলো বাসগুলোতে, কিন্তু আসলেই অর্ধেক আসন খালি রাখা হবে কি-না কিংবা স্বাস্থ্যবিধি কতটুকু মানা হবে তা নিয়ে উদ্বেগ আছে অনেকের মধ্যেই। বাসের কর্মীদের আচার-কার্যক্রমের কারণে নিয়ে যুগ যুগ ধরে অসন্তোষ সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে। গত বছরও একই ভাবে ভাড়া বাড়ানো হয়েছিলো আসন খালি রাখার কথা বলে। অভিযোগ রয়েছে, কয়েকদিন পর শুধু ভাড়াই বেশি আদায় হয়েছে কিন্তু বাস ভর্তি করেই যাত্রী উঠিয়েছে চালক ও হেলপাররা। উল্লেখ্য, গত বছর ৩১ মে থেকেও গণপরিবহনে অর্ধেক আসন খালি রাখার নির্দেশ দেয়ার পরেও ৬০ ভাগ ভাড়া বাড়িয়েছিলো সরকার। পরে পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে আবার স্বাভাবিক যাত্রী পরিবহন শুরু হয়েছিলো।
করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করেছিলো সরকার এবং তাতে গণপরিবহনে অর্ধেক আসনে যাত্রী পরিবহনের কথা বলা হয়েছিলো। ইতিমধ্যে গণহতাশা দেখা গেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। আগের বছরের অভিজ্ঞতার বিচারে ক্ষোভের বহি:প্রকাশ হয়েছে সামাজিক মাধ্যমেও। দূর্যোগকালীন সময়ে যখন সবারই আয়-রোজগার সংকুচিত হয়েছে, তখন এই বৃদ্ধি জনজীবনে বেশ প্রভাব ফেলবে বলে অনেকের আশঙ্কা।
১৮ দফা নির্দেশনার মধ্যে কয়েকটি দফা এরকম-
# জরুরি সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি অফিস/প্রতিষ্ঠান/ শিল্প কারখানায় পরিচালনা করতে হবে অর্ধেক জনবল দিয়ে। গর্ভবতী/ অসুস্থ/ ৫৫ বছরের বেশি বয়সী কর্মীদের বাড়িতে থেকে কাজের ব্যবস্থা করতে হবে
# সভা, সেমিনার, প্রশিক্ষণ কর্মশালা যথাসম্ভব অনলাইনে আয়োজনের ব্যবস্থা করতে হবে
# শপিং মলে ক্রেতা-বিক্রেতা সবাইর যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে
# সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকির এলাকায় আন্তঃজেলা যান চলাচল সীমিত করতে হবে; প্রয়োজনে বন্ধ রাখতে হবে
# অপ্রয়োজনীয় ঘোরাফেরা/আড্ডা বন্ধ করতে হবে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া রাত ১০টার পর বাইরে বের হওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে
প্রথম নিয়মটি যদি লক্ষ করি তাহলে দেখা যাবে, অর্ধেক জনবল দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালানোর কথা বলা হয়েছে। তারমানে হয়তো রুটিন করে আজ একজন পরেরদিন আরেকজন, এভাবে প্রতিষ্ঠান চালানোর নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। তারমানে ৫০% জনবল বাসাতেই অবস্থান করছে, যারা সবাই গণপরিবহণে একসাথে চলাচল করতো। যে ব্যক্তি বাসায় অবস্থান করলো, তার ভাড়া আগে যেখানে সপ্তাহে ৬দিন দিতে হতো তাকে এখন ৩দিন ভাড়া দিতে হচ্ছে। এভাবে তার উপরে ভাড়ার চাপ কিছুটা কমে আসছে। কিন্তু অর্ধেক জনবলের এই নিয়মটি কার্যকর করা বলতে গেলে অসম্ভব। এখানে কোন প্রতিষ্ঠান চাইবে তার কর্মক্ষমতা কমে যাক, যেখানে তার আয়-দায় সবই তাকে নিতে হবে। নির্দিষ্ট কিছু সেক্টর ছাড়াতো সরকার কারো দায়িত্ব নেয়নি করোনার দূর্যোগকালে, আবার যাদের প্রণোদনা-সাহায্য সরকার দিয়েছে তারাও এলোমেলো হয়ে গেছে সাপোর্ট পাবার পরেও। এই বিষয়টি সবার সামনে পরিস্কারভাবে ফুটে উঠেছে। এরকমভাবে পরের দফাগুলো দেখলেও নানা কাউন্টার যুক্তি দাঁড় করানো যাবে নিয়মগুলো না মানা বা কার্যকরে অসুবিধার কারণ হিসেবে।
দেশের মানুষের ভাল-মন্দ ও জীবন-নিরাপত্তা দেখভালের জন্য যে সরকার, তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নিয়ম-কানুন ঠিক করে থাকেন জনগণের ভাল’র জন্য। বেশির ভাগ সময় তাদের সিদ্ধান্তে নাখোশ হয়ে বিরোধীতা করতে দেখা যায় অনেককে। এর কারণ হিসেবে বলা কিছু কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে।
১. জনগণের সঙ্গে সরকারের কার্যকর যোগাযোগের অভাব। কোন সিদ্ধান্ত কীভাবে বাস্তবায়ন হবে এবং তা কীভাবে জনকল্যাণ বয়ে আনবে তা ব্যাখ্যা না করার ফলে সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা বোঝা যায় না।
২. কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকারের নিয়মিত মনিটরিংয়ের অভাব। কোনো নিয়ম করা হলো কাগজে কলমে কিন্তু মাঠপর্যায়ে তা বাস্তবায়ন হবার সময়ে জনগণের ভোগান্তি বা কোনো অনিয়ম হচ্ছে কিনা তা দেখার কেউ থাকে না। বিভিন্ন পক্ষ-বিপক্ষ দাঁড়িয়ে গিয়ে জনগণের ভোগান্তি হয়।
৩. সরকারের সিদ্ধান্তের উপরে জনগণের আস্থার অভাব। কোনো নিয়ম করার সময়ে জনগণের বাইরেও যে পক্ষগুলো থাকে, সেগুলো প্রভাবশালী মহল দ্বারা পরিচালিত হয় বা ক্ষমতাসীন নেতাদের সরাসরি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় জড়িত থাকে বলে অনেকসময় সরকারের সিদ্ধান্ত বেশিরভাগ সময় কার্যকর হয় না। যার মাশুল দিতে হয় জনগণকেই।
উপরের বিষয়গুলো ভেবে সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত বা নিয়ম বাস্তবায়ন করলে ভাল হয় বলে আশাবাদ।
গতবছরের মার্চ মাসে জনগণের মধ্যে যে করোনার ভয় ও সচেতনতা ছিল, বর্তমানে তা একেবারেই নেই বললেই চলে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ একবছরের অভ্যাসবশত মাস্ক পরলেও বহু মানুষ তা মানছে না। সাবান-সেনিটাইজার দিয়ে হাত জীবানুমুক্ত করার অভ্যাস প্রায় চলে গেছে, টাকা-পয়সা সাবধানে ব্যবহার করার অভ্যাস চলে গেছে, পর্যটনসহ সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েকগুন বেশি যুক্ত হচ্ছে সবাই। এছাড়া সরকার ও নানা কর্তৃপক্ষ বিদেশ ফেরতদের কোয়ারেন্টিন না মানাতে পারা এবং জনগণকে নিয়ম মানতে বাধ্য না করাতে পারার অভিযোগে অভিযুক্ত। আসলে ধীরে ধীরে এই পরিস্থিতির জন্য আমরা কমবেশি সবাই দোষী, সেজন্য সরকার বা নানা কর্তৃপক্ষ যখন কোনো নিয়ম সামনে নিয়ে আসে তখন তা অযৌক্তিক মনে হয়। এরকম নানা প্রেক্ষাপটে আসলে করোনা ধীরে ধীরে জনজীবনে মিশে গিয়ে নিরব হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে, কেড়ে নিচ্ছে চেনা-অচেনা বহু মানুষের প্রাণ। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও ইচ্ছা ছাড়া এই মহামারী করোনা নিয়ন্ত্রণে আনা একেবারেই অসম্ভব, আশাকরি আমরা সকলে তা দ্রুত উপলব্ধি করবো এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেবো।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)