একটি সক্রিয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই পারে সমাজে সুশাসন নিশ্চিত করে জনআকাংখা পূরণ করতে। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাড় করাতে মুক্ত, স্বাধীন ও স্বতন্ত্র গণমাধ্যমের বিকাশ প্রয়োজন। কালন মুক্ত ও স্বাধীন গণমাধ্যমই মানুষকে তথ্যে বিচরণের সুযোগ করে দেয়। জাকার্তায় গত ২১-২৩ সেপ্টেম্বরে গ্লোবাল ফোরাম ফর মিডিয়া ডেভেলপমেন্টের সম্মেলনে বলা হলো কোন দেশে যদি বিভিন্ন মত প্রকাশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে না উঠে তবে গণমাধ্যম তার কাংখিত ভূমিকা রাখতে পারেনা।
সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিরা বলতে চেয়েছেন বাংলাদেশের মানুষের কাছে গণতন্ত্র আরো বেশি কিছু। এদেশের মানুষের কাছে গণতন্ত্র মানে এক উন্নত আর সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন। আর এই যে মানুষের স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে এদেশের মানুষের নিরন্তর সংগ্রামে তাদের সাথী গণমাধ্যম। শত সীমাবদ্ধতা সত্যেও, এদেশের গণমাধ্যম মানুষের মনে একটা বড় জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছে। হয়তো পশ্চিমা দেশের মতো নয়। কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যমের যেটুকু স্বাধীনতা আছে, তা সরাসরি গণতন্ত্রের ফসল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে, নব্বুইয়ের গণ আন্দোলনে, এদেশের আপামর মানুষের সাথে গণমাধ্যম কর্মীরাও ছিলেন রাজপথে। সমাজে যা কিছু ঘটছে, সে নিয়ে মানুষকে সচেতন রাখতে ভূমিকা রাখছে গণমাধ্যম কর্মীরা। একমাত্র না হলেও, আজ বাংলাদেশে মানুষের অনেক বড় বিশ্বাসের জায়গা গণমাধ্যম।
তবে এই পথটুকু কখনোই খুব সহজ ছিলোনা। এখনো নেই। অনেক চাপ, অনেক বন্ধুর পথ সবসময়ই পাড়ি দিতে হয়েছে, এখনো হচ্ছে আমাদের গণমাধ্যমকে। কন্ঠরোধ করার চেষ্টা ছিলো, এখনো আছে, নির্যাতন আছে, এমন কি হত্যার ঘটনাও আছে। শুধু সরকার নয়, এই চাপ আর হুমকি আসে বিরোধী দল থেকেও, আসে আর সব গোষ্ঠি থেকেও। তবে এতসব বাধার মধ্যে সবচেয়ে বড় বাধা সমাজে সক্রিয় প্রতিক্রিয়াশীল চক্র, যারা শুধু গণমাধ্যমের বিরোধিতাই শুধু করেনা, তারা আসলে সমাজের প্রগতিরই শত্রু।
এই আধুনিক যুগে এসে গণমাধ্যম আর শুধু পত্রিকা বা সাপ্তাহিকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। প্রাইভেট টেলিভিশন অনেক আগেই একটি বড় জায়গা করে নিয়েছে। এফএম রেডিও অনেক বড় বাস্তবতা। কিন্তু তার চেয়ে বড় বাস্তবতা হয়ে উঠছে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে পরিচালিত অনলাইন মিডিয়া। আজ প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গণমাধ্যম অত্যন্ত সক্রিয়, সাবলীল।
প্রতিটি মানুষের জীবন ধারণের জন্য যেমন দরকার খাদ্য, কাপড় ও বাসস্থান, তেমনি যোগাযোগও একটি অতি প্রয়োজনীয় উপকরণ তার জীবনে। একুশ শতকের মানুষ চায় প্রতি মুহূর্তে তার কাছে, সর্বশেষ তথ্যটি থাকুক। এই চাওয়াই পূরণ করে গণমাধ্যম। কিন্তু গণমাধ্যমের ভূমিকা শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নেই। সরকার পরিচালনায়, ব্যবসা-বাণিজ্যে, বিনোদনে, সামাজিক যেকোন প্রয়োজনে গণমাধ্যম আজ হয়ে উঠছে অপরিহার্য।
একটি সক্রিয়, কার্যকরী গণমাধ্যম থাকার অর্থ মানুষ অজ্ঞ নয়, সে জানে এবং এই জানার কারণে সমাজে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে পারে সে। গণমাধ্যম তার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করার অর্থ হলো, তাদের কাছে দেয়া জনপ্রতিনিধিরা প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করছেন কিনা, সে বিষয়ে জনগণকে সচেতন রাখা। গণমাধ্যম নিজে সজাগ থাকার অর্থ হলো, আমলাতন্ত্র জনগণের সেবক হিসেবেই কাজ করবে, সেখানে দুর্নীতি কমবে।
গণতন্ত্র চায় ব্যক্তি মানুষের ক্ষমতায়ন। আর গণমাধ্যম তা নিশ্চিত করে যোগাযোগ আর স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের মাধ্যমে। তাই গণতন্ত্র আর গণমাধ্যম, আমাদের জীবনের দুটি অতি প্রয়োজনীয় অংশ।
গণতান্ত্রিক সমাজ মানুষকে দেয় মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এর অর্থ হলো স্বাধীনভাবে চিন্তা করা, স্বাধীনভাবে বলা, স্বাধীনভাবে লেখা, অন্যের সাথে স্বাধীনভাবে আলোচনা করা, স্বাধীনভাবে বিশ্লেষণ করা, স্বাধীনভাবে সমালোচনা করা এবং স্বাধীনভাবে বিরোধিতা করা। গণমাধ্যম মানুষের এই স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখে।
সাধারণভাবে মানুষের মত প্রকাশের একটি বড় প্লাটফর্ম গণমাধ্যম। বাংলাদেশে যেন তার চেয়ে বেশি। আমাদের জাতীয় সংসদ বিরোধী দলের লাগাতার বর্জনের কারণে হতে পারেনি সব বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। সংসদে সক্রিয় বিরোধী দল না থাকায় এখন গণমাধ্যমই হয়ে উঠছে, মানুষের কাছে অন্যতম বড় বিকল্প। আর এই বিকল্প হয়ে উঠার জন্য গণমাধ্যম কর্মীদের হতে হচ্ছে অনেক বেশী দায়িত্বশীল। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ আর তথ্য সমৃদ্ধ মতামত মানুষকে সাহায্য করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে। একজন সংবাদকর্মীর বড় কাজ তার পর্যবেক্ষকের ভূমিকা।
সত্যিকার গণতন্ত্র সচেষ্ট থাকে নাগরিকের অধিকার সংরক্ষণ করতে, আর সরকারের ক্ষমতা কমিয়ে আনতে। মানুষ যেন জাতি, বর্ণ, ধর্ম, সামাজিক মর্যাদা নির্বিশেষে বৈষম্যের শিকার না হয়, তার প্রাপ্যটুকু বঞ্চিত না হয়। সংবাদকর্মীরা এসব কিছু নজরে রাখে। সমাজে নীতি-নৈতিকতা, ন্যায্যতা নিশ্চিত করার অনেক বড় দায়িত্ব গণমাধ্যম আর সংবাদকর্মীরদের উপর।
অনেকেই বলেন এদেশের গণমাধ্যম ইতিবাচক নয় কেন? কেন তারা মানুষের সাফল্য দেখে না, কেন তারা শুধু পত্রিকার পাতা জুড়ে কিংবা টিভি পর্দা জুড়ে নেতিবাচক খবরে পূর্ণ করে রাখে? আমাদের তো অনেক সাফল্য আছে। কথাটা অনেকাংশেই সত্য। প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে গণমাধ্যম শুধু খারাপ খবরই দিবে না, নিশ্চয় ভাল খবর, সাফল্যের খবরও প্রচার করবে। কোন বিষয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করাই সংবাদকর্মীর উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়।
আরেকটি সংশয়ের জায়গা হলো অর্থের কাছে গণমাধ্যমের সমর্পণ। বিজ্ঞাপন দাতারা অনেক ক্ষেত্রেই গণমাধ্যমকে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে বাধ্য করছে। কিন্তু অর্থের এই দাপট শুধু গণমাধ্যমের বেলায় প্রযোজ্য নয়। রাজনীতি, প্রশাসন, বিচারবিভাগ, শিক্ষা সবখানে যখন অর্থ প্রভাব বিস্তার করছে, তখন গণমাধ্যম কি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপে বাস করতে পারে? তাই গণমাধ্যমকে একা দোষারোপ করা যায় না যে সে অর্থ দ্বারা প্রভাবিত। অনেক সীমাবদ্ধতার পরও এদেশের গণমাধ্যম নাগরিক সচেতনতা তৈরীতে ভূমিকা রাখছে। এদেশে যেটুকু গণতন্ত্র এখনো অবশিষ্ট আছে, তা আছে গণমাধ্যমের জন্যই।
গণমাধ্যমে এজেন্ডা সেটিং-এর ধারা যখন আসলো এমনটাই বলা শুরু হয়। এজেন্ডা সেটিং-এর কথা যা বলা হলো, তার অর্থ হলো, মানুষের কাছে কোন একটা বিষয় এমনভাবে নিয়ে আসা যেন তারা মনে করে জাতীয় উন্নয়নের জন্য এই বিষয়টি খুব দরকার, উন্নয়ন নীতিমালা বা আইন প্রণয়নে এই বিষয়টি ভাবতে হবে। জাতীয় উন্নয়নে কিংবা নীতি নির্ধারনে গণমাধ্যমের ভূমিকা নির্ভর করে তথ্যের মাধ্যমে মানুষকে শেখানো, উদ্বুদ্ধ করা ও সচেতন করায় সংবাদকর্মীদের দক্ষতার উপর।
গণমাধ্যম সমাজ ও জাতির প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরীতে ভূমিকা রাখে, যদি সে সমাজে বা রাষ্ট্রে তার জানার অধিকার নিশ্চিত হয়। সামাজিক ন্যায়বিচার হলো আরেকটি বিষয় যা গণমাধ্যমের কাছে প্রত্যাশিত। মিডিয়া মানে কোন ঘটনা বা বিষয় তুলে ধরবে, প্রকাশ বা প্রচার করবে, তা নয়, বরং সে ঘটনা বা বিষয়ের বিশ্লষণ দেবে যেন সমষ্টির কল্যাণে নীতি প্রণীত হয়।
একটি বহুমাত্রিক ও বৈচিত্রময় সমাজে, সরকার ও গণমাধ্যম, সমাজের নেতৃত্ব ও তার অনুসারী, অভিজাত ও তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ, সকালের মাঝে এমন একটা তথ্য প্রবাহ তৈরী হবে, যেন সকলেই সবসময় আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় রাখে। কিন্তু সাংবাদিকরা যেন কখনোই পেশাদারিত্ব ও তাদের জন্য প্রযোজ্য নীতি-নৈতিকতার অঙ্গীকার থেকে সরে না আসে। যখন সমাজ বিপদে পড়ে, সমাজের প্রগতির চাকা থমকে দাড়ায়, তখন গণমাধ্যমকে এজেন্ডা সেট করতে হয়। সেই এজেন্ডা গণমানুষের আশা আকাংখা।
মানুষ থেকে, গণমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা যায় না। গণমাধ্যম সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি ন্যায় বিচার করতে না পারলে, মানুষও তাকে ক্ষমা করে না। সমাজে শান্তি ও প্রগতির স্বার্থে কাজ করতে হয় গণমাধ্যমকে। তাই কোন পত্রিকা, টিভি, রেডিও, অনলাইন যাই বলি না কেন, যদি সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদ, বৈষম্যকে উস্কে দেয়, যদি ব্যাপক জনমানুষের কল্যাণের বিরুদ্ধে থাকে, বা সামরিক শাসন, একদলীয় শাসনের পক্ষে অবস্থান নেয়, তাহলে সংবাদ বা মতামত প্রচার করলেও তা গণমাধ্যম নয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)