চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

খেলা নিয়ে সাংবাদিকতা

আধুনিক বিশ্বে ক্রীড়া সাংবাদিকতার ভূমিকা এবং গুরুত্ব কারো অজানা নয়। বর্তমান সময়ে খেলাধুলা হচ্ছে একটি বড় ধরনের সংবাদ যৌগ। ক্রীড়া সাংবাদিক এবং লেখকরা হলেন ক্রীড়াঙ্গনের চোখ, মানুষের শব্দ এবং কণ্ঠস্বর। খেলাধুলা এখন তো আলাদা একটা জগৎ। আর এই বর্ণময় জগতের গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। ক্রীড়া সাংবাদিকতা আর ক্রীড়াঙ্গন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একটি বাদ দিয়ে অন্যটি ভাবা যায় না।

‘নো নিউজ ইজ গুড নিউজ’ – ফরাসি লেখক লুডোভিচ হেলভির শতাব্দি প্রাচীন বক্তব্যটি একজন সাংবাদিকের জন্য সত্য হলেও একজন দর্শক-শ্রোতা-পাঠকের জন্য তা মোটেই নয়। ১৯৫২ সালে কাছাকাছি একটি কথা বলেছিলেন অ্যামেরিকান সাংবাদিক গ্লোরিয়া বোর্গার – ‘কোনো সংবাদই সুসংবাদ নয়, আর সুসংবাদ কখনোই সংবাদ নয়।’ এই বক্তব্যেরও সারকথা ওই একই। বিষয়টা অনেক সময় ধাঁধা লেগে যায় ক্রীড়া সাংবাদিকতায়। স্পষ্ট করে বলতে গেলে প্রিন্ট মিডিয়ার স্পোর্টস রিপোর্টিংয়ে। রিপোর্টিং কে সাধারণ ভাষায় বলা যায়, কোনো সংবাদ যোগ্য ঘটনাকে পক্ষপাতশূণ্য, সঠিক, তথ্যবহুল, বস্তুনিষ্ঠ ও ডেডলাইনের মধ্যে থেকে একটি নির্দিষ্ট কাঠামোতে প্রকাশ করা।

অন্য সব রিপোর্টিংয়ের সুবিধা হলো সেখানে মূল ঘটনাটা অডিয়েন্সের চেয়ে রিপোর্টার কিছুটা হলেও বেশি জানেন। কিন্তু, লাইভ সম্প্রচারের যুগে একজন স্পোর্টস রিপোর্টারের এগিয়ে থাকার সুযোগ কই! যে তথ্য ভাণ্ডার নিয়ে তিনি লিখতে বসেছেন সেই একই তথ্যভাণ্ডার মাথায় নিয়েই যে পরদিন পাঠক খেলার পাতা পড়তে বসবেন।

একটা কথা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায় স্রেফ ম্যাচ রিপোর্ট, কে কত মিনিটে গোল করলো, কে কত রান করলো, কে কোন রেকর্ড করলো, কে কার সাথে কত ব্যবধানে জিতলো এটা জানতে কেউ পকেটের পয়সা খরচ করে পত্রিকা কিনে না। মূল ব্যাপারটা হচ্ছে, ‍ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মজার কিছু পরিসংখ্যান যা পাঠককে আগ্রহী করে তুলতে পারে, শব্দ নিয়ে খেলতে পারার ক্ষমতা ও সাইড স্টোরি! আর তাই একটা ব্যাপার নি:সন্দেহে বলে দেয়া যায় যে, ক্রীড়া সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতা (Objectivity) একটা মিথ ছাড়া কিছুই না। বস্তুনিষ্ঠতা হলো নিরপেক্ষতা। মোদ্দা কথা হলো– নিউজ অ্যাঙ্গেল। ক্রীড়া সাংবাদিকতায় অনেক ক্ষেত্রেই একটা পক্ষ ধরে নিয়ে রিপোর্টিং করে যেতে হয়।

এটা শুধু বাংলাদেশের বেলায়ই প্রযোজ্য নয়। ব্রিটিশ, অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়াও তাই করে। নৈকট্য (Proximity) বিবেচনা করেই ইংল্যান্ডের গার্ডিয়ান, ডেইলি মেইল, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি হেরাল্ড মর্নিং। মূল বিষয়টা খেলা হলেও ঝামেলা অনেক। এখানে একজন রিপোর্টারকে রিপোর্টিংয়ের বাইরে একজন সাহিত্যিক হয়ে উঠতে হয়। এখানে ভাষা, শব্দের খেলা আর নানা উপমা ব্যবহার করে ম্যাচের বর্ণনা দিতে হয়। এখানে ‘কভার ড্রাইভ থেকে চার রান’ আর ‘চোখ-ধাঁধানো কভার ড্রাইভ থেকে চার রান’-এর মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। এখানে লেখা দিয়ে বোঝাতে হয় মার্ক ওয়াহ কিংবা আজহার উদ্দিনের মাঝারি মানের ব্যাটিং গড়ের মধ্যেও কি অপার মুগ্ধতা লুকিয়ে আছে? বোঝাতে হয়, হ্যাভিয়ের মাশেরানো, রামিরেস, জাবি আলোনসোরা কিভাবে গোল না করেও হয়ে ওঠেন মহীমাময়! এতো কিছুর মাঝে বস্তুনিষ্ঠতার সুযোগ কই!

২ জুলাই। বিশ্ব ক্রীড়া সাংবাদিক দিবস। ১৯২৪ সালের ২ জুলাই ফ্রান্সে এআইপিএসের (ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন) প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই হিসেবে ২ জুলাই বিশ্বের ক্রীড়া সাংবাদিক ও ক্রীড়া লেখকদের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একমাত্র সংস্থা। আজ এআইপিএসের ৯১তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। ১৯৯৫ সন থেকে এআইপিএস এর বিশ্ব জুড়ে ‘অ্যাফিলিয়েটেড’ সংস্থাগুলো দেশে বিশ্ব ক্রীড়া সাংবাদিক দিবস পালন করছে। বর্তমানে এআইপিএস সদস্য দেশের সংখ্যা ১৬৭। আর বাংলাদেশে এর স্বীকৃত সংস্থা হচ্ছে বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি। বাংলাদেশে এআইপিএস’র একমাত্র স্বীকৃত ক্রীড়া সাংবাদিক ও ক্রীড়া লেখকদের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি এবং তার আঞ্চলিক সংস্থাগুলোও গত ১৯৯৫ সাল থেকে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিবারই দিবসটি উদযাপন করেছে।

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ক্রীড়াঙ্গনের প্রেক্ষাপট পাল্টে যায়। স্বাভাবিকভাবেই ক্রীড়া সাংবাদিকতা ও লেখনির গুরুত্ব অনুভূত হয়। সবকিছুই শূন্য থেকে শুরু করা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং স্বপ্ন নিয়ে। ১৯৭২ সালের ৪ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবের দোতালায় তদানীন্তন মর্নিং নিউজের ক্রীড়া সাংবাদিক মি. ডেভিটসনের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান ক্রীড়ালেখক সমিতিকে বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি নামে নতুন করে তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়ে সদস্য বিশিষ্ট কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠিত হয়। সভাপতি করা হয় আবদুল হামিদকে, সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান। সেই পূর্ব পাকিস্তান ক্রীড়া লেখক সমিতি কর্তৃক শুরু করা বছরের সেরা খেলোয়াড় পুরস্কৃত করার রেওয়াজ অনুযায়ী বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি ১৯৭৩ সালের সেরা খেলোয়াড়দের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের প্রথম আয়োজন করে ১৯৭৪ সালে। ক্রীড়াঙ্গনে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এবং বিতর্কের উর্ধ্বে এই পুরস্কার এখনো নিয়মিতভাবে দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন খেলার ‘ডিসিপ্লিনে’।

জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার শুরুর আগে থেকেই ক্রীড়ালেখক সমিতির পুরস্কারের শুরু এবং সে হিসাবে এটা বাংলাদেশের প্রথম ক্রীড়ার জাতীয় পুরষ্কার।

১৯৯২ সালের ২৪ মে। বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি সিউলে অনুষ্ঠিত আসপুর কংগ্রেসে (এশিয়ান স্পোটর্স প্রেস ইউনিয়ন) সদস্যপদ লাভ করে। এশিয়ান স্পোর্টস প্রেস ইউনিয়নের সদস্য পদ লাভ করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্রীড়া লেখক সমিতি একধাপ এগিয়ে যাবার পর লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় এআইপিএসের সদস্য পদ লাভ। ১৯৯৩ সালের ৭ মে পূরণ হয় সেই প্রত্যাশা। বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি এএসইপিএস-এর সদস্য পদ লাভ করে। আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য হওয়ার কারণে দক্ষিণ এশীয় স্পোর্টস প্রেস কমিশন গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতিকে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের দরজা খোলার পর সমিতির সদস্যরা বিশ্বমঞ্চেও নিজেদের জায়গা করে নিতে থাকেন।

অর্থাৎ বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি সূত্রে বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকরা এখন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিচরণ করছেন বাইরেও। এবং দিচ্ছেন নেতৃত্বও। আর সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তাদের অগ্রগতি যে হয়েছে তাঁর প্রমাণ তো এখনকার পত্রিকার পাতা এবং টিভির খেলার খবর। অভিজ্ঞ ক্রীড়া সাংবাদিকদের পথ ধরে এসে উদ্যমী তরুণ প্রজন্ম দিচ্ছে তাতে নতুন নতুন মাত্রা। সেটা আরও এগিয়ে যাক, ক্রীড়া সাংবাদিকতার মাধ্যমে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা খেলাকে নিয়ে যাবেন আরও উঁচুতে আজকের বিশ্ব ক্রীড়া সাংবাদিক দিবসে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।