রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। ফলে এই ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) রাখতে পারছে না। এ কারণে ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে, যার প্রভাব পড়ছে মুনাফায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে এ অবস্থা উঠে এসেছে।
পরিসংখ্যান মতে, চলতি অর্থবছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতে প্রভিশন সংরক্ষণ কম হয়েছে ৯ হাজার ২২০ কোটি টাকা। যা গত ৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ৩ মাস আগেও গত মার্চ শেষে ঘাটতি ছিল ৮ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী সংরক্ষণ করতে গিয়ে ২০১৩ সালের মার্চে ৯ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি হয়েছিল। এরপর আর কখনও ঘাটতি ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি হয়নি।
গত জুন শেষে ১৩টি ব্যাংক তাদের প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারেনি, এর মধ্যে রয়েছে বেসরকারি ৮টি বাণিজ্যিক ব্যাংক।
অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, খেলাপি ঋণ বাড়লে ব্যাংকগুলো আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এ কারণেই প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে। যেসব ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে তাদের মূলধন ঘাটতি হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।
তাই সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় ঋণ খেলাপিদের কাছ থেকে মানুষের আমানত ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় বেশিরভাগ ব্যাংকের বিনিয়োগ কমে যাবে বলে মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, খেলাপি ঋণের সাথে প্রভিশন সম্পৃক্ত। খেলাপি ও মন্দমানের ঋণ বাড়লে প্রভিশন রাখার পরিমাণও বাড়াতে হয়। ফলে ব্যাংকের মূলধনে টান পড়ে।
তিনি আরও বলেন, পুরনো ঋণের পাশাপাশি নতুন যে ঋণগুলো বিতরণ করা হচ্ছে, সেগুলোও খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। তাই ব্যাংকগুলোকে যেকোনো উপায়ে হোক খেলাপি ঋণ আদায় করতে হবে। এর বিকল্প নাই। একই সাথে যেসব গ্রাহক নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করছেন তাদের ঋণ দেয়ার পরিমাণ বাড়াতে হবে।
সালেহ উদ্দিন বলেন, প্রভিশন ঘাটতি পূরণ করতে গেলে ব্যাংকগুলোর মূলধনে প্রভাব পড়বে। ফলে ঋণ দেয়ার ক্ষমতা কমে যাবে। অন্যদিকে আমানতকারীদের আমানত শঙ্কায় পড়বে। অর্থাৎ সার্বিকভাবে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে ৭১ হাজার ২৪৩ কোটি টাকার প্রভিশন রাখার প্রয়োজন ছিল। ব্যাংকগুলো সংরক্ষণ করতে পেরেছে ৬২ হাজার ২৩ কোটি টাকা। ৩ মাস আগে ব্যাংকগুলোর ৬৭ হাজার ৭০ কোটি টাকা প্রভিশন রাখার প্রয়োজন ছিল। সংরক্ষণ করতে পেরেছে ৫৮ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। এ সময়ে ১৩টি ব্যাংকে ১২ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকার ঘাটতি রয়েছে। তবে অনেক ব্যাংকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি রাখায় সার্বিক অঙ্ক এর চেয়ে কম।
গত বছরের জুনে ব্যাংকগুলোর ৫২ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল। ব্যাংকগুলো তখন সংরক্ষণ করেছিল ৪৪ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঘাটতি ছিল ৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৭৩ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে বেসিক ব্যাংক। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকের ১ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ৯৮২ কোটি টাকা এবং অগ্রণী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ৮৫২ কোটি টাকা।
এ সময় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১২৮ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ঘাটতি বেড়ে ৭২৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ৩ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ৫১১ কোটি টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ১২৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১০৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ও ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ১৮৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
ঋণ শ্রেণিকরণের ৩টি পর্যায় রয়েছে। তা হলো- নিম্নমান, সন্দেহজনক ও মন্দ বা ক্ষতি। এই ৩টি পর্যায় বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকগুলোকে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ঋণ নিম্নমান হলে তার বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ২০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।
পরপর ৬ মাস ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সে ঋণকে সন্দেহজনক ঋণ বলা হয়। এ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ৫০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর ৯ মাস অতিবাহিত হলে ওই ঋণকে মন্দ ঋণ বলা হয়। এ মন্দ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। এ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে টাকা এনে। যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যত বেশি ওই ব্যাংকের আয় খাত থেকে বেশি পরিমাণ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। বেশি প্রভিশন সংরক্ষণ করলে ওই ব্যাংকের মুনাফা কমে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, গত জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের হার ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এ সময়ে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের স্থিতি ৯ লাখ ৬২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। এর বাইরে খেলাপি হওয়া ঋণ রাইট অফ বা অবলোপন হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে দেশের ব্যাংক খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ১ লাখ ৬২ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা। খেলাপির হার দাঁড়াবে ১৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারি ৪ ব্যাংকের পক্ষ থেকে মূলধন ঘাটতি মেটাতে সরকারের কাছে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে।
বিগত ৪ অর্থবছরে সরকারি ব্যাংকগুলোকে মূলধন ঘাটতি মেটাতে দেওয়া হয়েছে ১০ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেওয়া হয়েছে ব্যাংক বেসিককে। এ ব্যাংকটিকে মোট ঋণ দেওয়া হয়েছে তিন হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। বরাদ্দের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সোনালী ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে তিন হাজার তিন কোটি টাকা।
এছাড়া জনতাকে ৮১৪ কোটি টাকা, অগ্রণীকে এক হাজার ৮১ কোটি, রূপালীকে ৩১০ কোটি ও কৃষি ব্যাংককে ৭২৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।
তবে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন ব্যাংকগুলোকে আর অর্থ বরাদ্দ দেয়া হবে না। নিজেদের আয় দিয়ে চলতে হবে।