দেখতে দেখতে নির্জন কারাগারে এক বছর পূর্ণ হলো সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার। পুরানো ঢাকার নাজিমউদ্দীন রোডের পুরানো কেন্দ্রীয় কারাগারের একমাত্র কয়েদী খালেদা জিয়া। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ের প্রেক্ষিতে কারাগারে প্রেরণ করা হয় তাকে। সেই থেকে তিনি বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন।
খালেদার বয়স ৭৩ বছর। অসুস্থ শরীর। একা চলতে পারেন না। আদালতে বা হাসপাতালে আনতে গেলে হুইল চেয়ারই ভরসা। বয়স্ক এই নারীর জীবনের নিয়তি সেটিই এখন অনেকের প্রশ্ন। দেশের এতো বড় একজন রাজনীতিবিদ, দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী তিনি। কিন্তু পুরনো ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে যে তিনি বন্দি আছেন তা যেন ভুলেই গেছে দেশের মানুষ। কিন্তু কেন?
জানতে চাওয়া হয়েছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী কাজী সুজন মিয়ার কাছে। তিনি বললেন, “আসলেই তো চিন্তার কথা! আমরা তো ভুলেই গিয়েছি যে তিনি আমাদের পাশেই কারাগারে বন্দি আছেন। একজন তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির দায়ে বন্দী। লোকজন তো মনেই করতে পারছে না তার কি অবস্থা! আসল সমস্যা হলো, দেশের মানুষ এখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এই পথে কে কোথায় কিভাবে কি অন্যায়ের কারণে শাস্তি ভোগ করছে তা মানুষ ভাবে না। তাছাড়া খালেদা জিয়ার শাস্তি এটাই প্রমাণ করে যে, অন্যায় করলে কেউ পার পাবে না”।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন শিক্ষার্থী বললেন অবশ্য ভিন্ন কথা। তার মতে, দেশে দুর্নীতির মাত্রা ভয়াবহ রকমের বেড়েছে। প্রত্যেকে কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতি করে এবং করছে। সে তুলনায় খালেদা জিয়ার দুর্নীতির বিষয়টি বড় কিছু নয়। তিনি শুধু বড় রাজনীতিক বলেই অনেকাংশে রাজনীতিকভাবে বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। তার কথা হলো, খালেদা জিয়ার জায়গায় সাধারণ অন্য কেউ হলে এতদিনে জামিনে মুক্তি পেয়ে যেতেন।
বিএনপির পক্ষ থেকে প্রতিদিনই খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য নানা চেষ্টা চলছে। প্রতিদিন দাবি জানানো হচ্ছে। প্রতিবাদ সভা, সমাবেশ, সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রতিবাদ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সংবাদ সম্মেলনে, বক্তৃতায় একটু বেশি সোচ্চার দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
তিনি বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের নিকট এক প্রকার আকুতি জানালেন যেন, খালেদা জিয়াকে এবার মুক্তি দেওয়া হয়।
রিজভী বলেন, ‘এবার ক্ষান্ত দেন। একজন গুরুতর অসুস্থ বয়স্ক নেত্রীর ওপর জুলুম করবেন না। একটি বছর কারারুদ্ধ করে রেখে অত্যাচার করেছেন। এবার মুক্তি দিন। ইতিহাস পড়ুন, ইতিহাস বড় নির্মম। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না।’
রুহুল কবির রিজভী আরো বলেন, খালেদা জিয়া প্রচণ্ড অসুস্থ। চোখেও প্রচণ্ড ব্যথা, তার পা ফুলে গেছে। অথচ তাকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে না। কিছুদিন ধরে নাজিম উদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কারাগারের নিচতলায় ছোট একটি কক্ষে অস্থায়ী ‘ক্যাঙারু’ আদালত সাজিয়ে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেখানে ‘টেনে’ এনে জোর করে বিভিন্ন মামলায় শুনানি করা হচ্ছে।
জামিনের বিষয়ে তিনি বলেন, জিয়ার জামিন নিয়ে যেন ‘লুকোচুরি’ খেলা হচ্ছে। এক মামলায় জামিন নিলে অন্য আরেকটি মামলায় জামিন বাতিল করা হয়েছে। হাইকোর্ট জামিন দিলে আপিল বিভাগ আবার জামিন স্থগিত করেছেন। পরে আপিল বিভাগ জামিন দিলে নিম্ন আদালত আরেকটি মামলায় জামিন আটকে দিয়েছেন। এমন করে পার হয়ে গেছে একটি বছর। যেসব মামলায় অন্যরা জামিনে রয়েছেন, সেখানে খালেদা জিয়াকে জামিন দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে খালেদা জিয়াকে চিকিৎসাসেবা পর্যন্ত দেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে না সরকার’।
খালেদা জিয়ার কারাবরণের এক বছর ও জামিন ইত্যাদি বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাওয়া হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন উর রশিদ এর কাছে।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, “অন্যায় করলে যে কারোর শাস্তি হয় সেটির প্রমাণ হলেন বেগম খালেদা জিয়া। এটি আইনের শাসনের দৃষ্টান্ত যে, অন্যায় ও দুর্নীতি করে কেউ পার পায় না। তা খালেদা জিয়া হোক আর যিনিই হোক, তাকে শাস্তি পেতেই হবে। পৃথিবীর বড় বড় রাষ্ট্রগুলোতে আমরা তেমনটাই দেখি। আর আমাদের দেশও এগিয়ে যাচ্ছে। পরিবর্তন আসছে। পরিবর্তন এই যে, অপরাধ করে কেউ পার পাবে না।
অধ্যাপক হারুন বলেন, আদালত খালেদা জিয়াকে শাস্তি দিয়েছেন। সরকারের এখানে কিছু করার আছে বলে আমি মনে করি না। এই মামলা তো ১০ বছর ধরে চলেছে। সরকারের হস্তক্ষেপ থাকলে এক বছরের মাথায় খালেদা জিয়ার শাস্তি হতে পারতো। এটিতো সরকারের কিছু না। আইনের ব্যাপার। আদালতের ব্যাপার।
এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, খালেদা জিয়া যেহেতু একজন বয়স্ক নারী এবং অসুস্থ আর জামিনে মুক্তি পেতে সমস্যা হয়, তাহলে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করতে পারেন। আমার মনে হয় এটি খালেদা জিয়ার জন্য উচিত কাজ হবে। তার সামনে রাষ্ট্রপতি আছেন।