জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন আবার খারিজ করেছেন হাইকোর্ট।
বিএসএমএমইউ থেকে আসা খালেদা জিয়ার চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রতিবেদন দেখার পর বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হক এর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার জামিন আবেদন খারিজের আদেশ দেন। এই হাইকোর্ট বেঞ্চ এর আগে একবার এই মামলায় খালেদার জামিন আবেদন খারিজ করেছিলেন।
আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী জয়নুল আবেদীন। এসময় আদালতে খালেদার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, নিতাই রায় চৌধুরী, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল এবং অ্যাডভোকেট সগির হোসেন লিওন। এছাড়া শুনানির সময় আদালতে ছিলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। আর আদালতে দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।
এর আগে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি এই মামলায় আবার হাইকোর্টে জামিন চেয়ে আবেদন করেন খালেদা জিয়া। সে আবেদনে খালেদা জিয়ার ‘অ্যাডভান্সড ট্রিটমেন্ট’ প্রয়োজন উল্লেখ করে তাকে দ্রুত বিদেশে তথা যুক্তরাজ্যের মতো দেশে চিকিৎসা দেয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়।
এই আবেদনের শুনানি নিয়ে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট খালেদার চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রতিবেদন চেয়ে আদেশ দেন। আদালত তার আদেশে, খালেদা জিয়া ‘অ্যাডভান্সড ট্রিটমেন্ট’ নেয়ার সম্মতি দিয়েছেন কি না, তিনি সম্মতি দিয়ে থাকলে তার সে ধরনের চিকিৎসা শুরু হয়েছে কি না, আর সেই চিকিৎসা শুরু হয়ে থাকলে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যগত সর্বশেষ অবস্থা কী, তার প্রতিবেদন বিএসএমএমইউ এর উপাচার্যকে ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৫ টার মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের মাধ্যমে হাইকোর্টে দাখিল করতে নির্দেশ দেন। এবং এই বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য বৃহস্পতিবার দিন ধার্য করেন।
সে অনুযায়ী খালেদা জিয়ার চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রতিবেদন গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) থেকে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে আসে। আজ রেজিস্ট্রার জেনারেল প্রতিবেদনটি হাইকোর্টে বেঞ্চে পৌছে দেন।
এরপর আজ শুনানির শুরুতেই আদালত মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদনটি পড়ে শোনান। যেখানে বলা হয়, বেগম খালেদা জিয়া অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্টের সম্মতি দেননি। এবং অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্টের জন্য যে ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার দরকার সে ধরনের টেস্টের অনুমতিও তিনি দেননি। এছাড়া এই মেডিকেল প্রতিবেদনে খালেদা জিয়ার বর্তমান স্বাস্থ্যগত অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে খালেদা জিয়ার ‘ব্যাকপেইনের’ কথা উল্লেখ রয়েছে।
একপর্যায়ে আদালত স্বাস্থ্যগত প্রতিবেদন পড়ার পর খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন বিষয়ে আদেশ দিতে যান। তখন খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন আদালতের বলেন, মাই লর্ড আমরা আরেকটি সাপ্লিমেন্টারি আবেদন করব সেটি শুনে আপনি রোববার আদেশ দিন। তখন আদালত বলেন, ‘না রোববার আদেশ দেয়ার তো কিছু নেই। চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রতিবেদন চেয়েছিলাম বিএসএমএমইউ সে প্রতিবেদন দিয়েছে। আমরা রিপোর্টি দেখলাম এখন তো আর আদেশ দিতে সমস্যা নেই। তখন খালেদা জিয়ার আইনজীবী বলেন, ‘মাই লর্ড রিপোর্টটা তো আমরা হাতে পাইনি। তাই আমাদের রিপোর্টটি দেয়া হোক এবং প্রয়োজন আজ দুপুর দুইটায় আদেশ দিন। আমরা আরেকটি সাপ্লিমেন্টারি আবেদন তখন নিয়ে আসবো। এরপর আদালত এবিষয়ে আদেশের জন্য দুপুর দুইটার সময় নির্ধারণ করেন।
এরপর দুপুর দুইটায় আবার খালেদা জিয়ার আইনজীবী মানবিকভাবে জামিন আবেদন প্রার্থনা করেন। সেই সাথে তিনি ইন্টেরনেট থেকে প্রাপ্ত কিছু কাগজপত্র পড়ে বলেন যে, খালেদা জিয়া যে ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগছেন তার চিকিৎসা এখানে দিতে ঝুঁকি আছে বলেই চিকিৎসকরা বার বার সম্মতির প্রশ্ন তুলছেন।
এসকল বক্তব্য শোনার পর আদালত বলেন জামিন আবেদন শুনে আমরা নতুন কোন গ্রাউন্ড পাইনি। আর খালেদা জিয়া একজন দণ্ডিত ব্যক্তি। তাই একজ সাধারণ ব্যক্তি যেভাবে সুযোগ সুবিধা পাওয়ার তা তিনি পাবেন না। তিনি শুধু কারা বিধি অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা পেতে পারেন। সে জন্যই তাকে এখন দেশের সর্বোচ্চ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বিএসএমএমইউতে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তবে তিনি যদি সম্মতি দেন তাহলে তার ‘অ্যাডভান্সড ট্রিটমেন্ট’ শুরু করতে হবে। আর খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের যদি মনে করেন যে, আরও চিকিৎসক যুক্ত করা প্রয়োজন তাহলে খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় আরো চিকিৎসক যুক্ত করতে পারবেন। এরপর আদালত বলেন আমারা জামিন আবেদনটি খারিজ করছি।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা লেনদেনের অভিযোগে বেগম খালেদা জিয়াসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন।
এই মামলায় ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আখতারুজ্জামান ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর খালেদা জিয়াকে এই মামলায় ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেন। মামলার বাকি সব আসামিকেও একই সাজা দেয়া হয় এবং ট্রাস্টের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের ঘোষণা করেন আদালত।
খালেদা জিয়া ছাড়াও মামলার অন্য আসামিরা হলেন: বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছ চৌধুরীর সাবেক এপিএস জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার এপিএস মনিরুল ইসলাম।
এই মামলায় জামিন চেয়ে আবেদন করলে খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ করে দেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ। এরপর সে খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করে জামিন চান খালেদা জিয়া। তবে গত ১২ ডিসেম্বর দেশের সর্বোচ্চ আদালত জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার জামিন নামঞ্জুর করে আদেশ দেন। তবে খালদা জিয়া চাইলে তার সম্মতিতে ‘অ্যাডভান্সড ট্রিটমেন্ট’ দিতে বলা হয়।
এই জামিন শুনানিকে কেন্দ্র করে আপিল বিভাগে ২১০ মিনিটের ‘নজিরবিহীন’ হট্টগোল হয়। ওই হট্টগোলের প্রেক্ষাপটে প্রধান বিচারপতির আদালত কক্ষে পরবর্তীতে ৮টি সিসি (ক্লোজড সার্কিট) ক্যামেরা বসানো হয়।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ৫ বছরের সাজার রায় ঘোষণার পর বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেয়া হয়। বর্তমানে তিনি চিকিৎসার জন্য বিএসএমএমইউ হাসপাতালে রয়েছেন।