রামচাঁদ গোয়ালা। নামটা প্রথম শুনি আমাদের অফিসেই। তখনও পুরোদস্তুর স্পোর্টস রিপোর্টিং শুরু হয়নি আমার। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের টুকটাক কাজ করি ডেস্কে বসে, ফিল্ডে যাওয়ার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ দলের খেলার দিন সকালে একটা ডেস্ক প্রিভিউ হতো আমাদের। সেটা আবার তৈরি করতে হতো আগের দিনই। এই ধরুন ওয়েবসাইট ঘাঁটাঘাঁটি, ক্রিকেটারদের ক্যারিয়ার স্ট্যাটিসটিক্স, রেকর্ড ইত্যাদি জোগাড় করে রিপোর্ট-গ্রাফিক্স তৈরি এসবই ছিলো আমার কাজ।
বাংলাদেশের খেলা মানেই চ্যানেল আইয়ের বার্তাকক্ষে ক্রিকেটিয় আড্ডা, ভুরিভুরি ইনফরমেশন। সঙ্গে চারছক্কার হৈ-চৈতো আছেই। আড্ডাস্থলটা বেশিরভাগ সময়ই হয়ে থাকে আমাদের স্পোর্টসরুম। নিউজ এডিটর জাহিদ নেওয়াজ খান (জুয়েল ভাই) এসেই কিছু একটা বলবেন, আর তাতে যুক্ত হবেন স্পোর্টস ইনচার্জ সাইদুর রহমান শামীম ভাই। ব্যস, শুরু হয় একের পর এক ইনফরমেশন আসা। আমি তখন শুধুই মনোযোগী এক শ্রোতা।
আর এই দুজনের সঙ্গে যেদিন দুলাল মাহমুদ ভাইও থাকেন সেদিন আমার ‘তথ্যভা-ার’ আরও মজবুত। এখানে বলে রাখি, জুয়েল ভাই এবং শামীম ভাই দুজনই ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত দীর্ঘদিন। জুয়েল ভাই ক্রিকইনফোর প্রথম বাংলাদেশ প্রতিনিধি। ক্রিকেট নিয়ে সাংবাদিকতা করেছেন অনেকদিন। আর শামীম ভাই নিজে ক্রিকেট খেলেছেন ঢাকা লিগে এরপর শুরু করছেন ক্রীড়া সাংবাদিকতা। আর দুলাল ভাই বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীণ ক্রীড়া পাক্ষিক ক্রীড়াজগতের সম্পাদক, চ্যানেল আইতেও ক্রীড়া বিভাগে সময় দেন বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির সাবেক এই সভাপতি।
তো এই ত্রয়ীর আড্ডার মাঝখানে বসে বসে আমার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে বাংলাদেশের অনেক ক্রীড়া-ইতিহাস বা ব্যাক্তিত্বকে চিনতে ও জানতে পেরেছি আমি। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। একজন শিক্ষানবিশ স্পোর্টস রিপোর্টারের জন্য একে আমি বিশাল এক সুযোগই বলবো।
এবার মূল বিষয়ে ফিরি। কোনো এক দুপুরে বাংলাদেশ আর কার মধ্যে যেন ওয়ানডে ম্যাচ চলছিলো। ঠিক মনে পড়ছে না কে ছিলো টাইগারদের প্রতিপক্ষ। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন জুয়েল ভাই উঠালেন ময়মনসিংহের এক তারকা স্পিনারের গল্প। তিনিই রামচাঁদ গোয়ালা। জুয়েল ভাইয়ের শুরু করা গল্পে দুলাল ভাই-শামীম ভাইও যুক্ত হলেন। আমি শুধু শুনেই গেলাম। সেদিনই আমি প্রথম শুনেছিলাম এই ক্রিকেটারের ইতিহাস। আসলে ক্রিকেট প্রতিভার চেয়ে সেদিন এই ভদ্রলোকের নামটাই আমাকে বেশি আকর্ষিত করেছিলো।
এর কিছুদিন পর, সম্ভবত কোনো একটি পত্রিকা বা অনলাইন গোয়ালাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করলো। আমি সেটি প্রিন্ট করে জুয়েল ভাইকে দেখাই এবং বলি- আমি কি উনার একটা ইন্টারভিউ করবো? তিনি বললেন, তাহলেতো তোমাকে ক্যামেরা নিয়ে ময়মনসিংহ যেতে হবে, কারণ উনি তথাকথিত মফঃস্বলে থাকেন। যা হোক, পরে আর সেটি করা হয়নি।
তবে আমার জন্য সুযোগ এসেছিলো গোয়ালা সাহেবকে সামনে থেকে দেখার। গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ স্পোর্টস জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন (বিএসজেএ) তাদের অ্যাওয়ার্ড নাইটে বিশেষ সম্মাননা দিতে নির্বাচন করলো রামচাঁদ গোয়ালাকে। ক্রীড়া পরিবারের মিলনমেলায় পরিণত হওয়া সেই অনুষ্ঠানে সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার তৃষা ভক্তের সঙ্গে সহউপস্থাপক ছিলাম আমিও। এবং পুরস্কার নেওয়ার জন্য আমি নিজেই ঘোষণা করেছিলাম গোয়ালার নামা। এজন্য খুব গর্ব অনুভব করি।
ধীরে ধীরে মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসলেন তিনি। এই প্রথম দেখলাম বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক শুরুর ‘কারিগর’-কে।
জীবনের ‘পড়ন্ত-বেলা’ পার করা দীর্ঘদেহী এক মানুষ। হাতটা বাড়িয়ে দিলাম হ্যান্ডশেক করতে, হতাশ করেননি। ছোঁয়া হলো অনেক ইতিহাসের সাক্ষি এক স্পিনারের যাদুকরী হাত। ক্রিকেটের পেছনেই জীবনের পুরোটা দিয়ে দিয়েছেন যিনি।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রতিমন্ত্রী বীরেণ শিকদারের হাত থেকে পুরস্কারটা নিয়ে চুপচাপ নেমে যাচ্ছিলেন স্টেজ থেকে। অনুষ্ঠানের শিডিউল ব্রেক করে সাহস করে পেছন থেকে মাইক্রোফোনটা বাড়িয়েই দিলাম। বললাম, জনাব গোয়ালা আপনি কি আমাদের সঙ্গে একটু কথা বলে যাবেন? পেছনে ঘুরে খুব নিচু গলায় বললেন, আপনারা আমাকে সম্মান দিয়েছেন এটা আমার ভালো লাগছে। আর কি বলবো?। আপনি আর কিছু বলবেন? এবার মাইক্রোফোনটা সামনে ধরতেই হাত দিয়ে থামিয়ে দিলেন। আগের কথাটাই আরেকবার বললেন; ভালো লাগছে আমার। আর কিছু আমি বলতে চাই না। এজন্য আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।
গোটা অনুষ্ঠানস্থল তখন স্তব্ধ। পরিস্কার দেখতে পাচ্ছিলাম রামচাঁদ গোয়ালার চোখে তখন অশ্রু টলমল। আলতো করে চোখ মুছতে মুছতে অ্যাওয়ার্ডটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন একজন অভিমানী গোয়ালা। তিনি ক্রিকেটার রামচাঁদ।
(ছবি: রতন গোমেজ, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড)