সঙ্গীতশিল্পী নাজিয়া হাসান তার ছোট্ট বর্নাঢ্য জীবন সম্পর্কে যুতসই বর্ণনা তারই প্রিয় ছোটভাই বিখ্যাত সংগীত শিল্পী জোহেব হাসানের, ‘পৃথিবীতে নাজিয়ার পথ চলাটা ক্যাসেট প্লেয়ারের ‘ফাস্ট-ফরোয়ার্ড’’ বাটনের মতো। দ্রুতলয়ে সময়কে পেছনে ফেলে ছুঁটে চলা, বর্তমানকে টপকে আগামীর আধুনিকতাকে ধারণ করা। আবার ফাস্ট ফরোয়ার্ড বাটনের মতো দ্রুতলয়ে চলতে চলতে সময়ের আগেই থেমে যাওয়া। ক্যাসেটের স্পুল-ফিতা ছিঁড়ে গেলে যেভাবে থেমে যায় পুরো মেশিনটা।’
স্বল্পায়ুর জীবন, তাতেই খ্যাতি, সাফল্য জনপ্রিয়তা, অতুলনীয় কণ্ঠের মাধুর্য দিয়ে এই উপমহাদেশের কোটি কোটি ভক্তের মন জয় করেছেন পাকিস্তানি পপ-কুইন নাজিয়া হাসান।
পাকিস্তানের মতো অনগ্রসর রক্ষণশীল দেশে জন্ম নিয়েও সব বাঁধা অতিক্রম করে নিজের প্রতিভাকে মেলে ধরেছিলেন নাজিয়া। আশির দশকে ‘আপ জ্যায়সা কোই’ গানটি দিয়ে সারা উপমহাদেশকে চমকে দেয়া এই অপূর্ব সুন্দরী, মৃদুভাষিনী, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সেলিব্রেটির জীবনের শেষ পর্বটি দুঃসহ যন্ত্রনায়।
ফুসফুসের ক্যান্সারের সঙ্গে লড়তে লড়তে ৩৫ বছরে থেমে যায় জীবন ঘড়ি। তার আগে পারিবারিক কারণে সইতে হয়েছে নরক যন্ত্রনা। সমাজসেবা, শিশু শিক্ষাপ্রসার, কিংবা অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য আইনি সহায়তায় নিজের পাশ্চাত্য শিক্ষাকে কাজে লাগানোর পরও কোন কোন ক্ষেত্রে তাকে রক্ষনশীল সমাজের পারিবারিক অনুশাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে।
পাকিস্তানের এক উচ্চবিত্ত, অভিজাত পরিবারে জন্ম নাজিয়া হাসান ও তার ছোট ভাই জোহেব হাসানের। স্কুলের গণ্ডি পেরুনোর আগে করাচি থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনে পাঠানো হয় দুই ভাইবোন’কে। তারও আগে মা্ মুনায়েজা বশিরের আগ্রহে কিংবদন্তীর পাকিস্তানি গায়ক সোহেল রানা’র কাছে সংগীতে হাতেখড়ি তাদের। এতটুকুই প্রাতিষ্ঠানিক সংগীত শিক্ষা। লন্ডনে নাজিয়ার সংগীত প্রতিভা আবিস্কার করেন ভারতীয় সুরকার বিড্ডু।
এসময় বলিউডের নায়ক-পরিচালক ফিরোজ খান তার নির্মিতব্য ছবি ‘কুরবানি’র’ আইটেম সং “আপ জ্যায়সা কোই মেরি’র’ জন্য খুঁজছিলেন এক ব্যাতিক্রমী নারী কণ্ঠ, যার গায়কি ও ড্রিম-গার্ল জিনাত আমানের নাচের রসায়নে তৈরী হবে সুপার-ডুপার হিট প্রজেক্ট। ১৫ বছর বয়সী নাজিয়ার কণ্ঠ শুনেই মুগ্ধ ফিরোজ খান, তার কণ্ঠে তুলে দিলেন সেই গান। ১৯৮০ সালে মুক্তি পাওয়া কুরবানি মন কাড়লো লক্ষ-কোটি দর্শকের।
জিনাত আমান, ফিরোজ খান, বিনোদ খান্না কিংবা শক্তি কাপুর নন, কুরবানির বক্স অফিসে সর্বগ্রাসী সাফল্যের একক কৃতিত্ব গায়িকা নাজিয়া হাসানের গাওয়া ‘আপ য্যায়সা কোই মেরি’ গানটির তুমুল জনপ্রিয়তা। বিড্ডুর সুরে গাওয়া গানটি ১৫ বছর বয়সী নাজিয়া হাসানকে এনে দেয় ভারতের বিখ্যাত চলচিত্র পুরস্কার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড। সেই রেকর্ড অম্লান আজো।
উদয় হলো এমন এক তারকার যার ঔজ্জল্যে আলোকিত উপমহাদেশের তরুণরা, যাদের পরিচিতি ‘ডিস্কো প্রজন্ম’ হিসাবে। বিটলস, রক এন্ড রোল পেরিয়ে তখন উপমহাদেশের সংগীত মজেছে ডিস্কোথেকের সফট-রক সংগীতে। নাজিয়া-জোহেব হাসানের কণ্ঠে সেই সফট-রক উপমহাদেশীয় সুরের ছোঁয়ায় পেয়েছে সর্বগ্রাসী জনপ্রিয়তা। সমসাময়িক পপ সংগীত ব্যান্ড বনি-এম,অ্যাবা,বিজি’স কিংবা ক্লিফ রিচার্ডস,অলিভিয়া নিউটন জন এবং জন ট্র্যাভোল্টার‘স্যাটারডে নাইট ফিভারের গানের পাশপাশি এই উপমহাদেশের তরুণরা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে নাজিয়া-জোহেবের, ‘ডিস্কো দিওয়ানে, বুম-বুম, তেরে কদমোকো,জানা জিন্দেগী কিসেনা জানা’র মতো নন-ফিল্মিক, মোলোডিয়াস, রোমান্টিক নম্বরে। অপূর্ব সুন্দরী নাজিয়া’র মাঝে বলিউড খুঁজে পেতে চেয়েছিলো বিশ্বখ্যাত ম্যাডোনা’র মতো এক চৌকস গায়িকা-অভিনেত্রীকে।
বলিউড, পাকিস্তানি চলচিত্রের পরিচালক প্রয়োজকরা টাকার থলে নিয়ে হাজির হয়েছিলের নাজিয়া’র কাছে। চলচ্চিত্রে নায়িকার অফারে তাকে কিছুতেই রাজি করানো যায়নি। নাজিয়ার একই কথা, আমি গান ভালোবাসি, চলচিত্রে অভিনয় নয়।’ আশির দশকে মুম্বাই বিমানবন্দরে নাজিয়া-জোহেব ভাইবোন’কে স্বাগত জানাতে হাজির হন তাদের প্রায় ৪০ হাজার ভক্ত,পরিস্থিতি সামাল দিতে ডাকতে হয় অতিরিক্ত পুলিশ ।
দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী উপমহাদেশের সংগীত ভক্তরা নাজিয়া হাসানের গানে কতটা সন্মোহিত ছিলেন তার উদাহরণ আশির দশকে অমিতাভ বচ্চন, পারভীন ববি, জিনাত আমানদের সঙ্গে এক সফরে নাজিয়া-জোহেব যুক্তরাস্ট্রের ২৬টি বড় শহরের মঞ্চে পারফর্ম করেন।
কুরবানি’র সাফল্যের পর ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন এবং নিউইয়র্কের রিচমন্ড আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে আইন শাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা গ্রহনের পাশপাশি নাজিয়া-জোহেব জুটি ভারতীয় সুরকার বিড্ডুর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে একের পর এক প্রকাশ করতে থাকেন অ্যালবাম: ডিস্কো দিওয়ানে, বুমবুম, ইয়ান করণ, ক্যামেরা-ক্যামেরা’। ভারত-পাকিস্তানের রাজনীতি,অর্থনীতি কিংবা যুদ্ধের ময়দানের বৈরিতা পাত্তা পায়নি মাইক্রোফোনের পেছনে এদের সুর সৃষ্টির দূর্দান্ত বোঝাপড়ায়।
সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা নাজিয়া অ্যালবামের পাশপাশি মিউজিক ভিডিও’ও বের করেছেন আশির দশকের শুরুতে। ১৯৮১ সালে একসাথে ১৪ দেশ থেকে প্রকাশিত হয় অ্যালবাম ‘ডিস্কো দিওয়ানে’। তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়া এই লং-প্লে’র বিক্রির পরিমাণ প্রায় ছয় কোটি। অর্জন করে গোল্ডেন ডিস্ক, প্লাটিনাম ডিস্ক সহ ব্যবসায়িক সাফল্যের সব পুরস্কার। ডিস্কো দিওয়ানে জাপানি ভাষায় অনুবাদ করে গেয়েছেন সেদেশের গায়িকা।
দু”ভাইবোনের ইংরেজী গানের অ্যালবাম ‘দ্য হাসান্স,ডোন্ট থিংক টুআইস কিংবা দেন ইউ কিস মি’ রিলিজ হয় যুক্তরাজ্য থেকে। প্রথম পাকিস্তানি হিসাবে নাজিয়া হাসানের গাওয়া ‘ড্রিমার দিওয়ানে’ ঠাঁই পায় ব্রিটিশ টপ-চার্টে। মৃত্যু’র ১২ বছর পরেও নাজিয়ার গানের আবেদন যে আকাশ ছোঁয়া তার প্রমাণ ২০১২ সালে বলিউডে মুক্তি পাওয়া করণ জোহারের হিট ছবি ‘স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ার’র ডিস্কো সং’ শীর্ষক গানটি।
‘ডিস্কো দিওয়ানে’ গানে ব্যবহার করা প্রয়াত নাজিয়ার ভয়েস ট্র্যাকের সঙ্গে এ সময়ের ক্রেজ বেনি দয়াল ও সুনীতি চৌহানের কণ্ঠ মিলিয়ে নতুন মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টে তৈরী হয় গানটি। এ প্রজন্মের শ্রোতারা আটের দশকের ‘পপ-আইকন’ নাজিয়া হাসানকে তার মৃত্যুর একযুগ পর মুগ্ধতা দিয়ে গ্রহণ করেছে দু’হাত বাড়িয়ে। ‘স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ার’ ছবির বক্স অফিসে ঝড় তোলার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ‘ডিস্কো সং’ গানটি।
বিলাত আমেরিকায় আইনে উচ্চতর ড্রিগ্রি নেয়া নাজিয়ার শেষ একক অ্যালবাম ‘হট-লাইন’ রিলিজ হয় ১৯৮৭ সালে সেই বিড্ডুর সুরে। এরপর অনেকটাই স্বেচ্ছা নির্বাসন পেশাগত ব্যস্ততার কারণে। জাতিসংঘের কালচারাল অ্যাম্বাসেডর হিসাবে কাজ করেছেন ভারত, পাকিস্তান প্যালেস্টাইন,আরব সহ বিভিন্ন প্রান্তে। ১৯৯২ সাল থেকে জাতিসংঘের পলিটিক্যাল অ্যানালিস্ট হিসাবে চাকরি জীবন শুরু।
বিভিন্ন দেশের অনগ্রসর শ্রেণীর জীবন মান উন্নয়ন,রাজনৈতিক সংকটের সমাধানে নিজের আইনে অর্জিত উচ্চতর ডিগ্রিকে কাজে লাগিয়েছেন। এরই মাঝে ডাক্তারি পরীক্ষায় জেনেছেন ফুসফুসে ক্যান্সারের বাসা বাঁধার দু:সংবাদ। ১৯৯৫ সালে মা-বাবা’র ইচ্ছায় তাদের পছন্দের পাত্র ব্যবসায়ী মীর্জা ইশতিয়াক বেগের সঙ্গে পাতেন অসফল এক সংসার।
আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নাজিয়া পারিবারিক চাওয়া ও সামাজিক অনুশাসনকে মেনে নীলকণ্ঠ হয়েছেন। তার মৃত্যুর পর ভাই জোহেব প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন নাজিয়াকে নিজেদের পছন্দ চাপিয়ে দেয়া ছিলো বাবা-মায়ের বিশাল ভুল। পাঁচ বছরের দাম্পত্য জীবনে এক ছেলে আরেজ হাসানের মা হয়েছেন, সুখী পাননি সংসার জীবনে। লন্ডনে হাসপাতাল-বাড়ি করে জীবনের শেষ আড়াই বছর পার করেছেন নাজিয়া। পারিবারিক হতাশার পাশাপাশি স্বল্প সময়ে ১৩/১৪টি কেমোথেরাপির ভয়াবহ শারীরিক ধকলও সইতে হয়েছে।
এই সময় তার পাশে থাকতে পারেননি পাকিস্তানে বসবাসকারী বাবা-মা। মৃত্যু পথযাত্রী নাজিয়ার শেষ সময়ের সঙ্গী ছোটভাই জোহেব, যাকে নিয়ে একই মঞ্চে নতুন ধারার গান দিয়ে দুনিয়া কাঁপিয়েছেন। মৃত্যুর দশদিন আগে দু’হাজার সালের ৩ আগষ্ট নাজিয়া পান তার স্বামীর শেষ উপহার, বিবাহ বিচ্ছেদের চুড়ান্ত নোটিশ। মৃত্যুর পরও শেষ শয্যায় নেই আপনজনের সান্নিধ্য। জন্মভূমি পাকিস্তান থেকে বহুদূরে লন্ডনের এক মুসলিম কবরস্থানে শেষ শয্যা তার। সেই সমাধির এপিটাফও তিনি মৃত্যুর আগে ঠিক করে গেছেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)