টানা ২০ বছরের অভিযান শেষে বাংলাদেশ সময় শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ১২০ কোটি কিলোমিটার দূরে সৌরজগতের বলয়গ্রহ শনিতে আছড়ে পড়ে মৃত্যু হয়েছে ক্যাসিনির।
আন্তর্জাতিক এ মহাকাশযানটি পরিচালনা করছে নাসা (যুক্তরাষ্ট্র), ইসা (ইউরোপ) ও আসি (ইতালি) -তিনটি মহাকাশ গবেষণা সংস্থার বিজ্ঞানীরা। এদেরই একজন নিকোলাস আলতোবেলি। ক্যাসিনি মিশনে নিযুক্ত ইসার প্রজেক্ট সায়েন্টিস্ট তিনি।
ইমেইলে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিজ্ঞানকর্মী জাহাঙ্গীর সুর।
জাহাঙ্গীর সুর: শনিগ্রহ নিয়ে বিজ্ঞানে অবদান রাখার জন্য সাধুবাদ জানাই।
নিকোলাস আলতোবেলি: ধন্যবাদ।
জাহাঙ্গীর সুর: গিওভানি ডোমেনিকো ক্যাসিনি মারা গিয়েছিলেন ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৭১২ সালে। ইতালীয় এই জ্যোতির্বিজ্ঞানীর নামেই রাখা হয় ক্যাসিনি মহাকাশযানের নাম। বলয়গ্রহ শনির পরিমণ্ডলে অভিযান চালানো প্রথম প্রোব এটি। তার মৃত্যুর দিন নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় একই দিনে, ১৫ সেপ্টেম্বর। এটা কি নিছক কাকতাল?
নিকোলাস আলতোবেলি: হ্যাঁ, আমি যতদূর জানি, এটা পুরোপুরি কাকতালীয়। মিশনের শেষ দিনক্ষণ ঠিক করা হয়েছে মহাকাশযানটার যাত্রাপথ ও কার্যবিধির সীমাবদ্ধতার নিরিখে।
জাহাঙ্গীর সুর: ২০ বছরের অভিযানের মহাসমাপ্তির শেষ ২০ মিনিট বিষয়ে যদি বলতেন…
নিকোলাস আলতোবেলি: আমি ২০০১ সাল থেকে মিশনে আছি। আমার জন্য ক্যাসিনির মহামরণের মুহূর্তটা খুব আবেগঘন। কারণ যখন মিশনে যোগ দিই তখন আমি পিএইচডির শিক্ষার্থী। ক্যাসিনি আর আকাশে উড়ছে না, এটা জানার পর থেকে যেন সব শেষ হয়ে গেল।
জাহাঙ্গীর সুর: আপনারা বিজ্ঞানীরা এই অভিযানকে অনেক বৈজ্ঞানিক প্রথমের অভিযানে রূপান্তর করেছেন। আপনার দৃষ্টিতে সেরা পাঁচটি প্রথম কোনগুলো?
নিকোলাস আলতোবেলি: সেরা পাঁচ? এক. টাইটান চাঁদে হাইগেনসের অবতরণ। এনসেলাডাস চাঁদে ক্রায়ো-ভলকানিক কার্যক্রম (গলিত লাভার বদলে জল, মিথেন ইত্যাদির উদগীরণ) শনাক্তকরণ। দুই. বলয়গুলোর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ। তিন. টাইটানের মিথেনভরা জলবায়ু আবিষ্কার যেখানে বৃষ্টি আছে, মেঘমালা আছে, আছে লেক। চার. শনির একটা দিনের দৈর্ঘ্য পরিমাপ (ভয়েজার মহাকাশযান যে মান দিয়েছিল, ক্যাসিনি তার থেকে ভিন্ন পাঠ দিয়েছে)। পাঁচ. টাইটানের একটি লেকের গভীরতা মাপা।
জাহাঙ্গীর সুর: আকারে স্কুলবাসের মতো মহাকাশযানটা মাত্র একটা যাত্রী নিয়ে গিয়েছিল। যাত্রীর নাম হাইগেনস ল্যান্ডার (যা ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে টাইটানে নামে)। জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনসের নামে নাম। ডাচ ওই বিজ্ঞানী ১৬৬৫ সালে টাইটান আবিষ্কার করেছিলেন। তো এখন হাইগেনস টাইটান সম্পর্কে নতুন কী জানাল?
নিকোলাস আলতোবেলি: টাইটানের বায়ুমন্ডলের রহস্য প্রথমবারের মতো ভেদ করেছে হাইগেনস। টাইটানের পৃষ্ঠদেশ ছুঁয়েছে ল্যান্ডারটি। বিশ্লেষণ করেছে এর শক্তি ও গঠন। অন্য কোনো গ্রহের চাঁদে এটাই প্রথম মানুষের তৈরি কোনো বস্তু অবতরণ করেছে।
জাহাঙ্গীর সুর: যদি আরেকটা যাত্রী পাঠানো যেত, আরেকটা ল্যান্ডার যা নামানো হতো এনসেলাডাসে?
নিকোলাস আলতোবেলি: এটা খুব ভালো একটা আইডিয়া হতে পারতো। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এরকম কোনো অনুমোদিত পরিকল্পনা নেই। তাছাড়া, এনসেলাডাস খুব শক্তভাবে গ্রহনিরাপত্তা বিধিমালার (জীবনের সন্ধান পাওয়া গেছে। তাই সেখানে পার্থিব বস্তু ফেলা যাবে না) আওতায় রয়েছে।
জাহাঙ্গীর সুর: শনির বড় চাঁদ টাইটানের পৃষ্ঠদেশে একাধিক মিথেন লেকের সন্ধান মিলেছে। জলের সাগর পাওয়া গেছে টাইটান ও এনসেলাডাসে। এই দুটো চাঁদ কি তাহলে সম্ভাব্য অ্যালিয়েন বিশ্ব যেখানে জীবন রয়েছে?
নিকোলাস আলতোবেলি: এনসেলাডাসের সাগরের গভীরে যেখানে সূর্যালোক পৌঁছেনি, সেখানে হাইড্রোথার্মাল ক্রিয়ার চিহ্ন দেখা গেছে। পৃথিবীতে এ ধরনের পরিবেশ জীবন ধারণের জন্য উপযোগী। ফলে, বলা যায় যে, এনসেলাডাসে বাসযোগ্যতার সম্ভাব্যতা রয়েছে। এর মানে এই নয় যে, এনসেলাডাসে অ্যালিয়েন জীবন আছেই। কারণ আমরা এখনও তা জানতে পারিনি। টাইটানের সাগরে ঠিক কী ঘটে চলেছে, এটা এখনও জানা যায়নি। কিন্তু এনসেলাডাসে বাসযোগ্যতার সম্ভাবনাকে বাদ দেওয়া যায় না।
জাহাঙ্গীর সুর: অথচ শনির জগতে অভিযান শুরু করার সময় কিন্তু জীবনের চিহ্ন অনুসন্ধানের কোনো পরিকল্পনা করা হয়নি। কেন?
নিকোলাস আলতোবেলি: আশির দশকে যখন পরিকল্পনা করা হয়েছিল, মিশনের লক্ষ্য অবশ্য জীবনের অনুসন্ধান ছিল না। শনির বরফি চাঁদগুলো যে সম্ভাব্য বাসযোগ্য বিশ্ব হতে পারে, এ ব্যাপারে তখন কোনো ধারণাই ছিল না। পৃথিবীর গভীর সমুদ্রে যে বাসযোগ্যতা এবং বৃহস্পতি গ্রহে গ্যালিলিও মিশনের মাধ্যমে বুঝতে পেরেছি যে, শনিতেও আমরা জীবন খুঁজতে পারি। কিন্তু যখন ক্যাসিনির নকশা করা হয়েছিল তখন পুরো শনির জগতাটাকে উন্মোচন করার জন্য পরিকল্পনা আঁটা হয়েছিল, আলাদা করে জীবনের খোঁজে কিছুই ভাবা হয়নি সেসময়। বৃহস্পতিতে দুটো নতুন মিশন-নাসার ক্লিপার এবং ইসার জুস, গ্রহরাজের বরফি চাঁদগুলোকে আরও ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে দেখবে যে সেসব চাঁদ বসবাসের যোগ্য কি না।
জাহাঙ্গীর সুর: শনিকে চার বছর (২০০৪-২০০৮) চক্কর মারার পর ক্যাসিনির জ্বালানি ফুরিয়ে আসতে শুরু করেছিল। বাকি আট বছরের বর্ধিত অভিযানের বাড়তি পাওয়া কী?
নিকোলাস আলতোবেলি: বিশেষ করে বলব, শনির ঋতু পর্যবেক্ষণ করা। সে সুবাদে নতুন নতুন ঘটনা চোখে পড়া- বিষুব রেখা; শনির বলয় ব্যবস্থার উলম্ব কাঠামো; বসন্তে শনির উত্তর গোলার্ধে ঝড় ও টাইটানের লেকের বাষ্পীভবন; উত্তর মেরুর হেক্সাগন, কেন্দ্রে থাকা হারিকেন যা ভয়েজারও দেখেছিল।
জাহাঙ্গীর সুর: এত কিছুর পরও, এখনও কোন কোন রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি ক্যাসিনি?
নিকোলাস আলতোবেলি: আমি বলব, বলয়গুলোর উৎপত্তি কোথা থেকে- এটার উত্তর আমরা জানি না। হতে পারে, আমরা এরইমধ্যে ক্যাসিনির পাঠানো সব তথ্য পেয়ে গেছি কিন্তু মিশন শেষে আরও অনেক গবেষণা, বিশ্লেষণ দরকার পড়বে।
জাহাঙ্গীর সুর: অনেক ধন্যবাদ। ক্যাসিনি আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু স্বপ্নেরা কখনও মরে না।
নিকোলাস আলতোবেলি: আপনাকেও ধন্যবাদ।
ছবি: নাসা