গাণিতিক অর্থে তিন (৩) একটি বিশেষ সংখ্যা। যে কোনো সংখ্যার চেয়ে এই সংখ্যাটির প্রচলন সূচনালগ্ন থেকেই বেশি। ৩ (তিন) একটি মৌলিক সংখ্যা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৩ ব্যবহৃত হয় ইতিবাচক অর্থে। যেমন: সত্যি সত্যি সত্যি, তিন সত্যি। পরীক্ষার উত্তরপত্রে প্রশ্নের উত্তরের ক্ষেত্রে ৩টি উদাহরণ দিতে হয়। বিশেষত বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের। প্রতিজ্ঞা কিংবা তিরস্কার হিসেবেও ৩-এর প্রয়োগ রয়েছে। যেমন: তালাক, তালাক, তালাক, তিন তালাক।
বহুকাল ধরে ৩ চলছে। অবিরত ধারায়। বিভিন্ন কলা-কৌশল এবং ছলনায়। গণিত, সাহিত্য কিংবা ধর্মে ৩-এর অবস্থান দৃঢ়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও ৩ জড়িয়ে আছে ওতোপ্রোতভাবে। ‘৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতা’। এখানেও ৩ অগ্রাধিকার পেয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কর্মকাণ্ড কভারেজের জন্য একটি ডিজিটাল ক্যামেরা কিনতে জার্মানি যাচ্ছেন সরকারের উচ্চপদস্থ ‘তিন’ কর্মকর্তা। তারা হলেন- তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (প্রেস) মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরের (ডিএফপি) মহাপরিচালক মোহাম্মদ লিয়াকত আলী খান ও একই অধিদফতরের উপ-পরিচালক ও সম্পাদক মুহা. শিপলু জামান। ২১ জুলাই তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব নিলুফার নাজনীন স্বাক্ষরিত জারি সরকারি আদেশে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কর্মকাণ্ড কভারেজের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে এক সেট ডিজিটাল ক্যামেরা ও কিছু সরঞ্জামাদি আমদানির লক্ষ্যে প্রি শিপমেন্ট ইন্সপেকশন করার লক্ষ্যে উল্লেখিত কর্মকর্তাগণ জার্মানী সফর করবেন। তারা আগামী ২৫ জুলাই থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত এই ৭দিন জার্মানিতে অবস্থান করবেন। এই কাজে অংশগ্রহণের জন্য যাবতীয় ব্যয়ভার আয়োজক সংস্থা বহন করবে।
‘৩’-এর ভাগ্য যে কতোটা সুপ্রসন্ন, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রধানমন্ত্রীর ছবি তোলা হবে। সেই জন্যে জার্মানি গিয়ে ক্যামেরা কিনে আনতে হবে। সেটাও যাবেন ৩ জন সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এই কর্মকর্তাদের ক্যামেরা সম্পর্কে একেবারেই কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাছাড়া বিদেশ থেকে এ ধরনের কোনো সরঞ্জাম কেনার অভিজ্ঞতাও তাদের নেই! তবুও। ৩ জন যাচ্ছেন ক্যামেরা কিনতে। জার্মানিতে।
এই বিষয়টা নিয়ে ফেসবুকে টর্নেডো বয়ে যাচ্ছে। যারা জীবনে কোনদিন আওয়ামী লীগ বিরোধী কথা বলেননি, তাদেরও বিষয়টি ধাক্কা লেগেছে। সুতরাং বুঝতে হবে এই টর্নেডো আলতু-ফালতু নয়। এটা জার্মানীয় টর্নেডো। প্রবল শক্তিশালী এবং প্রলয়ংকারীও বটে! যেহেতু এটা আবহাওয়া বিষয়ক নয়, তাই এটির কোনো নাম নেই। ধরে নেয়া যাক, এটির নাম ‘ক্যামেরীও টর্নেডো’।
বহুকিছু আছে এই ৩-কে ঘিরে। বাংলাদেশের ৫ কোটি মানুষের ৩ বেলা খাবার জোটে না। তাদের বসবাস দারিদ্র সীমার নীচে। কোন পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৩জন হলে, সেটাকে বলা হয় সুখী পরিবার। শর্ত আরোপের ক্ষেত্রেও ৩-কে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়।
কিছুদিন আগে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আন্ডারে “Strengthening National capacity build-up in radiation protection of workers and public in Bangladesh” এর লক্ষে সায়েন্টিফিক ভিজিট বা ফেলোশিপ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য তিনজন বিজ্ঞানীর নাম চাওয়া হয়। সেই অনুসারে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন তাদের তিনজন বিজ্ঞানীর নাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। ওই মন্ত্রণালয় তিনজন বিজ্ঞানীর নামের স্থলে তাদের তিনজন কর্মকর্তার নাম বসিয়ে দেয়। এরা হলেন একজন যুগ্মসচিব, একজন উপসচিব ও একজন তথ্য কর্মকর্তা।
বিষয়টা অনেকটা এরকম আমলারা রেডিয়েশন প্রটেকশনের উপর ট্রেনিং নিয়ে কি করবে! এধরণের প্রোগ্রাম strictly ওই ফিল্ডের বিজ্ঞানীদের জন্য। বাংলাদেশে এরকম আরো অনেক scholarship, fellowship আসে ছাত্র, শিক্ষক এবং বিজ্ঞানীদের জন্য আর সেগুলো আমলারাই নিয়ে নেয়। ঝোঁপ বুঝে কোপ মারার ক্ষেত্রে আমলাদের দক্ষতা প্রশংসনীয়।
এক সময় মানুষ নৈসর্গিক দৃশ্যকে ধরে রাখার জন্য কলম ও রঙ-তুলি, কাপড়, কাগজ ও পাথরের ওপর ছবি আঁকার প্রচলন শুরু করে। স্মৃতি রক্ষার্থে মানুষের ছবি, ইতিহাসখ্যাত ইমারত, ঐতিহাসিক বিভিন্ন দৃশ্য ও শখের বস্তুকে কলম অথবা রঙ-তুলির সাহায্যে ক্যানভাসে ধরে রাখার চেষ্টা চালায় মানুষ। এভাবে ধীরে ধীরে তৈরি হতে থাকে বড় বড় চিত্রকর, যারা সৃষ্টি করেন ইতিহাসখ্যাত চিত্রকর্ম। সময়ের সাথে সংগতি রেখে প্রযুক্তি ছোঁয়া লাগতে শুরু হয়। ১০২১ সালে ইরাকের এক বিজ্ঞানী ইবন-আল-হাইতাম আলোক বিজ্ঞানের ওপর ৭ খণ্ডের একটি বই লিখেছিলেন আরবি ভাষায়। এর নাম ছিল কিতাব আল মানাজির। সেখান থেকে ক্যামেরার উদ্ভাবনের প্রথম সূত্রপাত। ১৫০০ শতাব্দীতে এসে চিত্রকরের একটি দল তাদের আঁকা ছবিগুলোকে একাধিক কপি করার জন্য ক্যামেরা তৈরির প্রচেষ্টা চালায়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৫৫০ সালে জিরোলামো কারদানো নামের জার্মানির একজন বিজ্ঞানী ক্যামেরাতে প্রথম লেন্স সংযোজন করেন।
তখন ক্যামেরায় এই লেন্স ব্যবহার করে শুধু ছবি আঁকা হতো। তখনও আবিষ্কৃত ওই ক্যামেরা দিয়ে কোনো প্রকার ছবি তোলা সম্ভব হয়নি। কারণ ওই ক্যামেরাকে সফল রূপ দিতে সময় লেগেছিল আরও অনেক বছর। ক্যামেরার ইতিহাসে একটি মাইলফলক ছিল ১৮২৬ সাল। ওই সালেই প্রথমবারের মতো আলোকচিত্র ধারণের কাজটি করেন জোসেপ নাইসপোর নিপস। ১৮৪০ সালে উইলিয়াম টালবোট স্থায়ী চিত্র ধারণের জন্য নেগেটিভ ইমেজ থেকে ছবিকে পজিটিভ ইমেজে পরিবর্তন করেন। এরপরই বিশ্বব্যাপী ক্যামেরার প্রযুক্তিগত উন্নয়ন দ্রুতবেগে সম্প্রসারিত হতে থাকে।
১৮৮৫ সালে জর্জ ইস্টম্যান তার প্রথম ক্যামেরা ‘কোডাক’-এর জন্য পেপার ফিল্ম উৎপাদন করেন। বাণিজ্যিকভাবে এটাই ছিল বিক্রির জন্য তৈরি প্রথম ক্যামেরা। এর ঠিক এক বছর পরে পেপার ফিল্মের পরিবর্তে সেলুলয়েড ফিল্মের ব্যবহার চালু হয়। এরপর আর পেছন ফিরে তাকানো নয়। ১৯৪৮ সালে প্রথম আবিষ্কৃত হয় পোলারয়েড ক্যামেরা, যা দ্বারা মাত্র এক মিনিটে ছবিকে নেগেটিভ ইমেজ থেকে পজিটিভ ইমেজে রূপান্তর করা সম্ভব হয়। দীর্ঘ ৭৫ বছর অ্যানালগ ক্যামেরার রাজত্ব চলার পর ১৯৭৫ সালে কোডাকের স্টিভেন স্যাসোন প্রথম ডিজিটাল ক্যামেরার উদ্ভাবন করেন। এভাবেই আজ ক্যামেরা মানুষের হাতের মুঠোয়।
আলোকচিত্র গ্রহণের যন্ত্রের নাম ক্যামেরা। ‘ক্যামেরা’ শব্দটি এসেছে ‘ক্যামেরা অবস্কিউরা’ নামক ল্যাটিন শব্দ থেকে,যার অর্থ অন্ধকার প্রকোষ্ঠ। দৃশ্যমান স্থির বা গতিশীল ঘটনা ধরে রাখার জন্য এটি ব্যবহার হয়। স্থির চিত্র, গতিশীল চিত্র, শব্দসহ চিত্র, রঙ্গিন চিত্র প্রভৃতি এর দ্বারা গ্রহণ করা সম্ভব।
বাংলাদেশে শিক্ষিত যুব সমাজের একটি বিরাট অংশ মাসে ৩ হাজার টাকা রোজগার করতে পারে না। সাংবাদিকদের মধ্যে এমন অনেকে আছেন যারা অবিরাম কলাম লিখে মাসে ৩ হাজার টাকা হাতে পাননা। প্রধানমন্ত্রীর ছবি তোলার জন্য, একটি ক্যামেরা কিনতে সরকারের তিন কর্মকর্তা জার্মানি যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর ছবি তোলা হবে বিশ্বের সেরা ক্যামেরা দিয়ে। এটি অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য গর্বের। শুধু মাত্র একটি প্রশ্ন আমাদের। দেশের যে মানুষগুলো মরছে, জ্বলছে, পুড়ছে, অনাহারে মানবেতর জীবন যাপন করছে, কষ্টের যন্ত্রণায় মৃত্যুকে স্বাগত জানাচ্ছে, তাদের ছবি কী ঐ ক্যামেরা দিয়ে তোলা হবে? এই একটি প্রশ্নের জবাব চাই। আমরা বিশ্বাস করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের প্রশ্নের জবাবটি দেবেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)