চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

কোথাও শ্রোতা-দর্শক নাই, সবাই এখন সমালোচক: রাজীব আহমেদ

‘টাকার জন্যই আমি গান লেখা শুরু করি’

চ্যানেল আই অনলাইনের মুখোমুখি পাগলা হাওয়া, কুসুম কুসুম প্রেম, রাখিনি আমায় কেউ, নদীর বুকে চাঁদ, ও আমার সখী, এক আকাশের তারার মতো অসংখ্য গানের রচয়িতা রাজীব আহমেদ…

নব্বইয়ের শেষের দিক। তখনো ফিতা ক্যাসেটে গান কিনে শুনেন বাংলার সংগীতপ্রেমী মানুষ। বাংলা গানের দুনিয়ায় তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, হাসান, পথিক নবী কিংবা বিপ্লবের মতো তুখোড় ব্যান্ড শিল্পীরা। তাদের গাওয়া তুমুল জনপ্রিয় গানগুলোর সাথে শোনা যায় কিছু দাপুটে গীতিকারের নামও। যাদের লেখা গান থাকলেও ক্যাসেটটির উপর শ্রোতাদের আস্থা দ্বিগুণ বেড়ে যেত। তারমধ্যে প্রিন্স মাহমুদ, লতিফুল ইসলাম শিবলি, নিয়াজ আহমেদ অংশু, তরুণ, আনন্দ, দেহলভীর মতো গীতিকবির নাম উল্লেখযোগ্য। আর সেই সময়ের গীতিকবিদের মধ্যে হঠাৎ শোনা যায় এক তরুণ গীতিকারের নাম। যার লিরিকের উপর ভরসা করতে থাকেন বাংলার হাজারো তরুণ শ্রোতা। জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, হাসান কিংবা পথিক নবীর গান লেখার মধ্য দিয়ে যিনি রাতারাতি ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠিত গীতিকবিদের কাতারে চলে যান। তার লেখা গানগুলো খুব অল্প সময়ে হয়ে উঠে মানুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয়। সাড়া পড়ে যায় চারদিকে। শ্রোতাদের কাছে সাড়া পড়ে যাওয়ায় সেই সময়ের ব্যান্ড শিল্পী, সংগীতায়োজকরাও ভরসা করতে থাকেন তরুণ সেই গীতিকবির উপর। তরুণ সেই গীতিকবির নাম রাজীব আহমেদ।

জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা সব তারকা ব্যান্ড শিল্পীর গান লেখেন রাজীব আহমেদ। জেমসের ‘সুন্দরী’ অ্যালবামের ‘বিধাতা’ গানটি নিয়ে গীতিকবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ তার। এরপর জেমসের জন্য তিনি লেখেন পাগলা হাওয়া, কুসুম কুসুম প্রেম, রাখিনি আমায় কেউ, তুই কোথায় যাসরে, আমি কোন ফুলে দিবো পুজো তোমায়, জলের কোনে কার ছায়ার মতো অন্তত ত্রিশটি গান। যার প্রায় সবগুলোই মানুষের মুখে মুখে ফেরে! আইয়ুব বাচ্চুর জন্য লেখেন, ‘নদীর বুকে চাঁদ, ও আমার সখী, এক আকাশের তারা, আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই, যেও না চলে বন্ধু’সহ অন্তত ২৫টি গান। হাসান ও পথিক নবীর জন্য যথাক্রমে ‘লাল বন্ধু নীল বন্ধু’ এবং ‘নিশি কালো মেঘ দেখে’র মতো অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান লিখে সাড়া ফেলে দেন তিনি। ব্যান্ডের বাইরে তিনি লিখেন উড়ো মেঘ, তুই যদি মোর চন্দ্র হতি’র মতো সাড়াজাগানো গান। এদুটো গানের শিল্পী ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ খ্যাত শিল্পী আসিফ। ব্যান্ডের বাইরে আসিফের জন্যই সর্বাধিক গান লেখেন তিনি। যেগুলো মানুষের মুখে মুখে শোনা যেত।

জনপ্রিয়তার ঢেঁকুর তোলার আগেই অডিও ইন্ডাস্ট্রিতে আচমকা নেমে আসে অশুভ ছায়া! প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ফলে ফিতা ক্যাসেটের বাজার দখল করে নেয় সিডি ক্যাসেট। শুরু হয় প্রযুক্তির অপব্যবহার। পাইরেসির কবলে পড়ে চোখের সামনে ধ্বসে পড়ে অডিও ইন্ডাস্ট্রি। অতি মুনাফালোভীদের আগ্রাসনে পিছু হটতে তাকেন অডিও গানের পৃষ্টপোষক কোম্পানিগুলো। ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় বিপাকে পড়েন সংগীতের সঙ্গে জড়িত মানুষেরা। নতুন সৃষ্টিও থেমে যায়। আর সংগীতের এসব নিয়ে এবং নিজের ব্যক্তিগত প্রাপ্তি, ক্ষোভ আশা ভরসার কথা নিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনে মুখোমুখি গীতিকবি রাজীব আহমেদ:

গীতিকবি হয়ে উঠার গল্প:
নব্বই দশকের শেষের দিকের ঘটনা। বাসায় পুরোপুরি গানের পরিবেশ। কারণ আমার মা সুফিয়া মনোয়ার বাংলাদেশ টেলিভিশন(বিটিভি) ও বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী। সেই হিসেবে গানের পরিবেশেই আমি বেড়ে উঠেছি। কিন্তু গান নিয়ে আমার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না। এমনকি আমার মা-ও চাইতেন না যে আমি গান করি। বরং স্কুলে পড়াকালীন সময় থেকেই আমি লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। স্কুলের দেয়ালিকাতে নিয়মিত লিখতাম। সেই সময়েই জনকণ্ঠে ‘নবীন লেখক সংখ্যা’ নামে সেগমেন্ট চালু করেছিলো। আমি সেখানে নিয়মিত লিখতাম। এভাবেই এক সময় জনকণ্ঠে কন্ট্রিবিউটিং শুরু করেছিলাম। কন্ট্রিবিউটর হিসেবে সারা মাস লিখে আমি টাকা পেতাম তিন থেকে চার হাজার টাকা। কিন্তু সেই সময় দেখলাম, আমি সারা মাস কন্ট্রিবিউট করে যে টাকা পেতাম দুই টা গান লিখলেই তা পাওয়া যায়। সেই সময় থেকেই আমিও গান লেখা শুরু করলাম। কারণ অল্প লেখায় বেশি টাকা! এটা কে হাতছাড়া করবে। টাকার জন্যই আমি গান লেখা শুরু করি।

গান লিখে প্রথম উপার্জন:
আমার লেখা প্রথম গানটি গায় জেমস ভাই। ‘সুন্দরী’ অ্যালবামের ‘বিধাতা’ নামের গান ছিলো সেটা। এই একটি গানের জন্য আমি পেয়েছিলাম দুই হাজার টাকা। যারা সেই সময়ে প্রতিষ্ঠিত গীতিকার ছিলেন তারাও কিন্তু একটা গানের জন্য এতো টাকা পেতেন না। বেশির ভাগই এক থেকে দেড় হাজার টাকা পেতেন। জেমস ভাইকে দিয়ে গানটি গাওয়ানোয় সহযোগিতা করেছিলেন জুয়েল বাবু ভাই। কারণ তিনি এই গানটি বেশ পছন্দ করেছিলেন। গানটির সুরকারও তিনি ছিলেন। আর আমারও টার্গেট ছিলো গান লিখবো বড় শিল্পীর জন্য। আর এমন ধারনাটা আমার কিছুটা ক্ষতিও করেছে। কেননা সবার দ্বারা দুই হাজার টাকা দিয়ে গান নেয়া সম্ভব ছিলো না, তাই আমি সিলেকটিভ শিল্পীর জন্য গান লিখেছি। মানে যারা বেশি টাকা দেয়ার সামর্থ রাখতেন তাদের জন্যই লিখতাম।

গানের ভাষা নিয়ে সমালোচনার শিকার:
আমি ব্যান্ড শিল্পীদের জন্যই গান লিখতাম। জেমস ভাই, বাচ্চু ভাই, হাসান, পথিক নবীদের জন্য আমি গান লিখেছি। শুধু টাকার জন্য গান লিখলেও রক ঘরানার শিল্পীদের জন্য গানের ভাষা কেমন হওয়া উচিত সেদিকেও অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হয়েছে। জেমস বা বাচ্চু ভাইদের জন্য অন্তত পঞ্চাশটার মতো গান আমি লিখেছি। তখনতো আমার বয়স খুব বেশিও না। গান লিখতে গিয়ে একটা মহা ঝামেলা পড়তে হলো। চারদিকে সমালোচনা হতে থাকলো আমি নাকি আমার গানে ‘তুই’ সম্বোধনটা বেশি করি। রোমান্টিক গানে সবাই যখন ‘তুমি’ সম্বোধন করছে, প্রশ্ন উঠলো আমি কেন গানে ‘তুই’ শব্দটা ব্যবহার করি! এটা কিন্তু আমি ইন্টেনশনালি করিনি। পত্র পত্রিকায় প্রচুর সমালোচনা হলো। বলা হলো বাংলা ব্যান্ডের গানের কথায় শব্দ ব্যবহার খুব নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। অভিযোগ আসলো গানে ‘তুই তুকারি’ রুচিহীনতার পরিচয়। সিনিয়ররাও আমাকে বলছিলো গানে ‘তুই তুকারি’ না করতে। কিন্তু আমিও তাদের বলেছি ‘ভাই, এভাবে লিখেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি! কিন্তু এখনতো দেখি কলকাতা, বাংলাদেশের বেশির ভাগ গানেই ‘তুই’ সম্বোধন করা হয়। তাহলে তখন আমার কি অপরাধ ছিলো জানি না! তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের বহু গানে ‘তুই’ সম্বোধন আছে। আসলে বড়দের ল্যাঙ্গুয়েজে আসলে সমস্যা নেই, কিন্তু ছোটদের ভাষায় আসলে সমস্যা!

সংগীতে অদল বদল:
এখনতো গান দেখার হয়ে গেছে। আগেতো গান ছিলো শোনার। গানটা লিখতাম হার্ট থেকে। এটা নিয়ে আমি ব্যক্তিগত ভাবে ঝামেলাতেই আছি। তো ভেবে দেখলাম গান যদি দেখার বিষয়-ই হয় তাহলে আমি গান লিখবো কেনো? আমি নাটক বা ভিজ্যুয়াল প্লাটফর্মে কাজ করি! এজন্যই এখন নাটক লেখা শুরু করেছি।

এখন শ্রোতা কারা?:
আমরা যারা গানের শ্রোতা ছিলাম, তারা টাকা খরচ করে গানের অ্যালবাম কিনতাম। অ্যালবামে দশটা বা বারোটা গান থাকতো। সবগুলো শুনে যদি একটা গানও ভালো লাগতো সেটা নিয়েই হ্যাপি থাকতাম। কারণ আমিতো টাকা দিয়ে গানগুলো কিনেছি। কিন্তু এখনতো এক অর্থে ফ্রি পাওয়া যাচ্ছে সব। ইন্টারনেটে বিভিন্ন প্লাটফর্ম তৈরি হয়ে আছে, সেখানে গিয়ে ধুম করে একটা মন্তব্য করে দিলো। বলবে এটা ভালো হয়েছে, ওটা ভালো হয়নি। কোথাও শ্রোতা-দর্শক নাই, সবাই এখন সমালোচক। আরেকটা বড় পেইন হচ্ছে ভিউ দিয়ে কে কতো বড় শিল্পী সেটা নির্বাচন করা। এটা আশ্চর্য রকমের একটা বিষয়! এখনকার কোনো কোনো গানের দেখি কোটি কোটি ভিউ, কিন্তু এগুলো কারো মুখে মুখে শুনি না। কাউকে গাইতে দেখি না। তাহলে এই ভিউ দিয়ে কি লাভ! আবার অনেক গান আছে হয়তো কোটি ভিউ হয়নি, কিন্তু লোকের মুখে মুখে শোনা যায়। তাহলে জনপ্রিয়তার মাপকাঠি কীভাবে ‘ভিউ’!

বর্তমান ব্যস্ততা:
বললাম না, এখন যেহেতু গান আর শোনার বিয়ষ নয় তাই আমিও গান লিখি না। খুব কম লিখছি। এখন নাটক লিখছি নিয়মিত। সর্বশেষ আসিফ ভাইয়ের জন্য দুটো গান লিখেছি। মিউজিক্যাল ফিল্মের জন্য। আমিরুল অরুণের পরিচালনায় চ্যানেল আইয়ে ‘কাগজের উড়োজাহাজ’ নামের একটি নাটক এরইমধ্যে দেখানো হয়েছে। বিশ্বজিৎ দত্ত ও প্রীতি দত্তের পরিচালনায় এটিএন বাংলায় সম্প্রচার হয়েছে ‘বউ চুরি’। গেল বাবা দিবসে বিশ্বজিৎ দত্তের পরিচালনায় শর্টফিল্ম ‘পোলাও মাংস’ নামের গল্পটি আমার লেখা। মানে এখন নিয়মিত নাটক, শর্টফিল্মের গল্প লিখছি। আসছে ঈদে আমার লেখা কয়েকটি নাটক দেখানো হবে বিভিন্ন টেলিভিশনে। এরমধ্যে সারপ্রাইজ, লাভ এন্ড সেক্রিফাইস, আমি আর আমার বাবার গার্লফ্রেন্ড নাটকগুলো রয়েছে। যেগুলো পরিচালনায় আছেন সাখাওয়াত মানিক। ‘কাগজের বউ’ নামের আরো একটি নাটক আসবে। যার পরিচালনায় রুমান রুনি। ঈদের পর কাজ শুরু হবে ‘ফুল ঝাল চানাচুর’, ফেল(শর্টফিল্ম) ও বউয়ের বিয়ে নামের তিনটি কাজ।