সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা সংস্কারে চাকরিপ্রার্থী এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে দাবি জানিয়ে আসছেন, তাকে অত্যন্ত যৌক্তিক মনে করছেন কয়েকজন সাবেক আমলা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তি।
তারা বলছেন, দেশের বাস্তবতায় নানাভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা সংরক্ষণের দরকার আছে। তবে তা কখনও মেধাকে উপেক্ষা করে নয়। মেধা উপেক্ষিত থাকলে তা রাষ্ট্রের জন্য আত্মঘাতী হয়। এমন বাস্তবতায় কোটা ব্যবস্থা সংস্কার জরুরি।
বিষয়টি নিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, সাংবাদিক, কলামিস্ট এবং গবেষক সৈয়দ আবুল মকসদু ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল।
তবে এ নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় থাকা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) কোনো বর্তমান বা সাবেক সদস্য।
চ্যানেল আই অনলাইনের পক্ষ থেকে পিএসির একজন সাবেক চেয়ারম্যান এবং একজন সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেছেন, ‘কোটা নিয়ে আমরা কোনো কথা বলতে পারবো না।’
কোটা সংস্কারের দাবিতে দীর্ঘদির ধরে চলা আন্দোলন তীব্রতা পায় গত ফেব্রুয়ারি থেকে। এ সময় কোটা ব্যবস্থা সংস্কারে ৫ দফা দাবি সামনে রেখে দেশের প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহরের সরকারি কলেজসহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ করে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থী।
‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’র ব্যানারে রাস্তায় নামে হাজার হাজার তরুণ। ২০১৩ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনে বাধা দিয়েছিল আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ। তবে এবার সেই চিত্র ভিন্নতা পেয়েছে। সংগঠনটির অনেক পদধারী নেতাকেও দেখা গেছে এই দাবির পক্ষে রাস্তায় নামতে। এমনকি এই আন্দোলনের আহ্বায়কও ছাত্রলীগের একজন পদধারী নেতা।
আন্দোলনকারীদের পাঁচ দফা দাবি হচ্ছে, কোটা ব্যবস্থা সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে এ নিয়ে আসা, কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে শূন্য থাকা পদগুলো মেধা থেকে নিয়োগ দেওয়া, কোটার কোনো ধরনের বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষা না নেওয়া, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারণ এবং নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধার সুযোগ একাধিকবার না দেওয়া।
যদিও আন্দোলনের মুখে সরকার কোটায় থাকা প্রার্থী পাওয়া না গেলে সেখানে মেধা তালিকায় থাকা প্রার্থীদের নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি চাকরিতে সুবিচার নিশ্চিত করতে কোটা সংস্কারের দাবিকে সরকারের বিবেচনা করা উচিত বলে মত দিয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ১০০টা চাকরির মধ্যে কোটায়ই চলে যাচ্ছে ৫৬টা। কোটার চেয়ে মেধার সংখ্যা অনেক কম। সুতরাং এখানে একটা অসম অবস্থারও সৃষ্টি হয়েছে। সে হিসেবে আন্দোলনকারীদের দাবিকে আমি সংগত মনেকরি।
যৌক্তিক এ দাবি সরকারের বিবেচনা করা প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে মেধাবীরাও ঢুকতে পারবে এবং সুবিচারও নিশ্চিত হবে।
জনপ্রশাসনে মেধার চেয়ে কোটার প্রাধান্য থাকা রাষ্ট্রের জন্য আত্মঘাতী মন্তব্য করে কলামিস্ট এবং গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আমি মনেকরি আন্দোলনকারীদের দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক। কারণ জনপ্রশাসনে নিয়োগের প্রধান মানদণ্ড হওয়া উচিত মেধা। সেখানে মেধাকে প্রাধান্য না দিয়ে কোটাকে প্রাধান্য দিলে প্রশাসন অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়বে। যেটা রাষ্ট্রের জন্য আত্মঘাতী।
‘‘আমিতো মনেকরি এটা আন্দোলনের কোনো বিষয় না। বরং সরকারেরই দায়িত্ব এর সংস্কার করা। শুধুমাত্র শারীরিক প্রতিবন্ধী এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠী যেমন: আদিবাসীদের জন্য কোটা ছাড়া আর কোনো কোটা রাখার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনেকরি না।’’ বলেন আবুল মকসুদ।
মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ কিছু ক্ষেত্রে কোটা রাখার প্রয়োজন থাকলেও সার্বিকভাবে কোটা সংস্কার অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামালও।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন: আমি কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোটা রাখার পক্ষে। আমি চাই মুক্তিযোদ্ধা কোটা, নারী কোটা বা আদিবাসী কোটা থাক। তবে সেটা যৌক্তিক পর্যায়ে সংস্কার দরকার।
‘মুক্তিযোদ্ধারা দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত ছিল। তাদের সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে পারেনি। এখন হয়তো তাদের পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষিত হচ্ছে বা চাকরির বাজারে আসছে। তাদের জন্য কোটা রাখা যেতে পারে। তবে সেটা ৩০ শতাংশ নয়, ১৫ শতাংশই যথেষ্ট বলে মনেকরি।’
মেসবাহ কামাল বলেন, আমাদের দেশে কর্মমুখী শিক্ষা না থাকায় শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা অনেক। কিন্তু সরকারেরও সেভাবে চাকরির সুযোগ তৈরি করার সুযোগ কম। এ জন্য আমার মনেহয় কোটা সংস্কার করা জরুরি।
চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি হাসান আল মামুনের দাবি, আমাদেরকে কোটাবিরোধী হিসেবে কেউ কেউ প্রচার চালাচ্ছে। এটা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
তিনি বলেন, আমরা কখনওই বলিনি যে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করা হোক। আমরা শুধু বলেছি বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করে যেন এর যৌক্তিক সংস্কার হয়।
‘‘আমরাও চাই দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা থাক। তবে সেটা একটা যৌক্তিক পর্যায়ে থাক। যাতে আমাদের মতো সাধারণ শিক্ষার্থীরা চাকরির সুযোগ বঞ্চিত না হয়।”
‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকবে’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যের পর আন্দোলনের গতিপথ কী হবে- জানতে চাইলে হাসান আল মামুন বলেন, আপনি খেয়াল করে দেখবেন প্রধানমন্ত্রী কিন্তু বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকবে। তিনি কিন্তু বলেননি যে কত শতাংশ থাকবে।
‘‘আমরা দাবি করেছি সব মিলে ১০ শতাংশ কোটা থাক। কিন্তু এটাই তো শেষ কথা নয়। আমরা চাই সরকার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে আলাপ-আলোচনা করুক। তারপর সব ধরনের কোটা বিবেচনা করে তারা যদি মনে করে আরও কিছুটা বেশি থাকবে (১০ শতাংশের) তবুও সংস্কার হোক।’’
দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলেও জানান তিনি।
বিদ্যামান কোটা ব্যবস্থায়, সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদগুলোতে জনবল নিয়োগে কোটা থেকে নিয়োগ পাচ্ছেন ৫৬ শতাংশ প্রার্থী। বাকী ৪৪ শতাংশের নিয়োগ মেধার ভিত্তিতে।
ওই ৫৬ শতাংশ কোটার মধ্যে রয়েছে; ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতী-নাতনী, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা এবং ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী ও অন্যান্য কোটা।
তবে কোটাধারী কেউ মেধা তালিকায় ঢুকে পড়লে তার নিয়োগ মেধা কোটাতেই হয়ে থাকে। সেইক্ষেত্রে তার জন্য নির্ধারিত কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয় একই কোটায় থাকা অন্যপ্রার্থীকে। আর যোগ্যপ্রার্থী পাওয়া না গেলে, তখন সে পদে কাউকে নিয়োগ না দিয়ে তা সংরক্ষণ করা হয়।
দেশে বিপুল পরিমাণ বেকার থাকার পরেও কোটা ব্যবস্থায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ার কারণে প্রায় সব শ্রেণির চাকরিতেই অনেক পদ শূন্য থেকে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিগত কয়েকটি বিসিএসের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া যাওয়ায় ২৮তম থেকে ৩৫তম বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারে সাড়ে তিন হাজার পদ খালি থেকে গেছে। এর মধ্যে ২৮তম বিসিএসে ৮১৩টি, ২৯তম বিসিএসে ৭৯২টি, ৩০তম বিসিএসে ৭৮৪টি, ৩১তম বিসিএসে ৭৭৩টি এবং ৩৫তম বিসিএসে ৩৩৮টি পদ শূন্য থেকে যায়।
চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের হিসেবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে শূন্য পদের সংখ্যা ৩ লাখ ৫৯ হজার ২৬১টি। এরমধ্যে প্রথম শ্রেণির শূন্য পদের সংখ্যা ৪৮ হাজার, ২৪৬টি, দ্বিতীয় শ্রেণির শূন্যপদের সংখ্যা ৫৪ হাজার ২৯৪টি, তৃতীয় শ্রেণির শূন্যপদের সংখ্যা ১ লাখ ৮২ হাজার ৭৩৭টি এবং চতুর্থ শ্রেণির শূন্যপদ রয়েছে ৭৩ হাজার ৯৮৪টি।
একদিকে লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার, অন্যদিকে লোকবলের অভাবে মুখ থুবরে পড়ছে রাষ্ট্রয়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলো। এ অচলাবস্থা ভাঙতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই বলেও মত জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞদের।