চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

কে কাকে ক্ষমা করে?

রোববার বিকেলে রাজধানীর সোহরারওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় দেয়া ভাষণে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ক্ষমতায় এলে তারা আওয়ামী লীগের জুলুম (তার ভাষায়) ক্ষমা করে দেবেন। এর আগে বেগম জিয়া আদালতেও বলেছেন যে, তিনি শেখ হাসিনাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।

প্রথম প্রশ্ন হলো, কে কাকে ক্ষমা করে? আওয়ামী লীগ কি বিএনপির কাছে ক্ষমা চেয়েছে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, বিএনপি নেত্রী কি নিশ্চিত যে তারাই আগামীতে ক্ষমতায় আসছেন? নাকি তাদের কাছে এরকম কোনো ঐশী বাণী পৌঁছে গেছে যে, তাদের দাবি অনুযায়ী নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি অবাধ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে এবং তারা ক্ষমতায় যাবে?

২০০৮-এর নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তার দলের কিছু নেতার কিছু ‘বিতর্কিত’ কর্মকাণ্ড (বিশেষ করে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর কাছে দেয়া জবানবন্দি) স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ক্ষমা করলাম, কিন্তু ভুলব না। তিনি ক্ষমা করেছিলেন। প্রভাবশালী অনেক নেতা যারা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে মন্ত্রী হবেন স্বাভাবিক বলে গণ্য করা হত, তারা মন্ত্রিসভায় জায়গা পাননি। ছিটকে পড়েছিলেন দলের প্রেসিডিয়াম থেকেও। পরে তাদের কেউ কেউ মন্ত্রিসভায় জায়গা পেলেও দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারীণ ফোরাম প্রেসিডিয়ামে জায়গা পাননি।

ফলে রাজনীতিতে এই ক্ষমা করে দেয়া এবং ভুলে না যাওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খালেদা জিয়ার কথার টোনও সেরকম। কিন্তু এখানে অনেকগুলো প্রশ্নও রয়েছে।

খালেদা জিয়ার ভাষায় তিনি আওয়ামী লীগের জুলুম ক্ষমা করে দেবেন। তার মানে তিনি বিশ্বাস করেন যে, আওয়ামী লীগ জুলুম করছে। তাহলে প্রশ্ন, তারা যদি সত্যিই ক্ষমতায় আসে এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করে দেয়, সেটি অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া হবে কি না? এরপরে আবার থেকে বিএনপি যেসব জুলুম করবে, আওয়ামী লীগ কি তখন বিরোধী দলে থেকে বলবে যে, ক্ষমতায় এলে তারা বিএনপিকে ক্ষমা করে দেবে? কে কাকে ক্ষমা করছে?

রাষ্ট্র যদি সত্যিই জুলুম করে, তার প্রথম ভিকটিম হয় দেশ ও জনগণ। ভিকটিম হয় দেশের অর্থনীতি। তার মানে ক্ষমতায় এসে সরকার জুলুম করবে আর বিরোধী দল বলবে যে তাদের এই জুলুম ক্ষমা করে দেয়া হবে–তাহলে এর অর্থ কি এই দাঁড়ায় যে, জনগণ জুলুমের শিকার হতেই থাকবে?

শুধু তাই নয়, খালেদা জিয়া সরকারি কর্মকর্তাদেরও আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন এই বলে যে, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে রাজনৈতিক পরিচয়ে কারো চাকরি যাবে না। অর্থাৎ কেউ আওয়ামী ঘরানার বলেই তাকে ওএসডি করা বা খারাপ জায়গায় বদলি করা হবে না। বেগম জিয়া জানেন, নির্বাচনে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি এই বার্তা দিয়ে মূলত নির্বাচনে তাদের কাছ থেকে নিরপেক্ষতা আশা করছেন।

বাস্তবতা অত্যন্ত কঠিন। বিএনপি এখন আওয়ামী লীগকে জুলুমকারী বলে নিজেকে ধোয়া তুলসিপাতা দাবি করছে। অথচ চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের উপরে যেসব জুলুম নির্যােতন হয়েছে, শেখ হাসিনাকে যেভাবে বারবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে,শেখ হাসিনা কি তা ক্ষমা করেছেন? এসবের জন্য বিএনপি কি কখনো ক্ষমা চেয়েছে? ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে দেশে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির জন্ম দেয়া হয়েছিল, পেট্রলবোমায় অসংখ্য নিরীহ মানুষের জীবন নেয়া হলো, বিএনপি নেত্রী কি তার দায় এড়াতে পারেন? একজন নিরীহ মানুষও যদি তার বা তার দলের কারণে নিহত হয়, তার জন্য খালেদা জিয়া কখনো ক্ষমা চেয়েছেন? নাকি ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা বহাল থাকার জন্য সব অপরাধই বৈধ?
ক্ষমা মহত্বের লক্ষণ। অর্থাৎ কারো দ্বারা অন্যায়ের শিকার হবার পরও তাকে ক্ষমা করে দিতে পারা নিঃসন্দেহে অনেক বড় মানবিক গুণ। কিন্তু এটিও বিবেচনায় রাখা দরকার যে, কে কাকে ক্ষমা করার কথা বলছেন। যিনি বলছেন তার বা তার দলের বিরুদ্ধেও যেসব জুলুমের অভিযোগ আছে, সেগুলোর জন্য তিনি কি কখনো ক্ষমা চেয়েছেন?

তবে বেগম জিয়ার এবারের ভাষণের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো এই যে, এখানে প্রতিহিংসার কোনো গন্ধ ছিল না। তিনি রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনার কথা বলেছেন। সুতরাং এই পরিবর্তনটা তিনি নিজের দলের ভেতর থেকেই যদি শুরু করতে পারেন, যদি তিনি যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতকে আনুষ্ঠানিকভাবে বয়কট করার ঘোষণা দিতে পারেন, সেটি নিঃসন্দেহে বিএনপির রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের একটা সূচনা হবে বলে আশা করা যায়।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)