ভারতের কেরালা রাজ্যের বিখ্যাত সাবারিমালা মন্দিরে ‘নিষিদ্ধ’ বয়সের নারীদের প্রবেশ নিয়ে মঙ্গলবার শুরু হওয়া প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের ধারাবাহিকতায় রাজ্য সরকার এলাকাভিত্তিক কারফিউ ঘোষণা করেছে।
কেরালার সান্নিধানাম, পামবা, নীলাক্কাল এবং এলাভুঙ্গাল – এই চারটি বেস ক্যাম্প থেকে ভক্তরা পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত মন্দিরটির উদ্দেশে ট্রেকিং শুরু করে। ঘোষণা অনুসারে এই এলাকাগুলোতে একসঙ্গে ৫ জনের বেশি মানুষ জড়ো হওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এর সঙ্গে আবার নারী ভক্ত প্রবেশ নিষিদ্ধ রাখার দাবিতে ‘সাবারিমালা প্রটেকশন কমিটি’ নামের একটি সংগঠন রাজ্যজুড়ে ১২ ঘণ্টার ‘বনধ’ ঘোষণা করেছে।
বর্তমানে সাবারিমালার আশপাশের বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। রাস্তায় যানবাহন নেই বললেই চলে।
কেরালা বিজেপি এই বন্ধে সমর্থন জানিয়েছে। অন্যদিকে রাজ্য কংগ্রেসের নেতা রমেশ চেন্নিথালা বলেছেন, সাবারিমালা জটিলতার মূল ইস্যু ‘লিঙ্গ সমতা নয়’। রাজ্যের বামপন্থি সরকারকে একা করে দিয়ে এখন কংগ্রেস, বিজেপি স্থানীয় হিন্দুপন্থি দলগুলোর সঙ্গে মিলে দেশের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কেরালার বিখ্যাত সাবারিমালা মন্দিরে ঋতুমতী নারীর (১০ থেকে ৫০ বছর বয়স) প্রবেশ একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল। স্থানীয়দের বিশ্বাস, ওই মন্দিরের উপাস্য দেবী আয়াপ্পা একজন চিরকুমারী এবং পিরিয়ড হওয়ার বয়স হয়েছে এমন সব নারী ‘অপবিত্র’।
এ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গিয়ে গত ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের দেয়া রায়ে ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত নারী উপাসকদের প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা বাতিল করা হয়।
রায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, উপাসনা এবং নিবেদন কখনো লিঙ্গ বৈষম্যমূলক হতে পারে না। ঈশ্বরের কাছে সব ভক্তই সমান। দেবী আয়াপ্পাও এর বাইরে নন। প্রার্থনা-উপাসনায় সবার সমান অধিকারে পুরুষতন্ত্র কখনো বাধা হতে পারে না।
পাঁচ সদস্যের ওই বেঞ্চের একমাত্র নারী সদস্য বিচারপতি ইন্দু মালহোত্রা শুধু এ সিদ্ধান্তের বিপক্ষে কথা বলেছিলেন। তার বক্তব্য ছিল, আদালতের কখনো ধর্মচর্চায় হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।
এর প্রায় এক মাস পর মঙ্গলবার প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে নারী ভক্তদের জন্য বিকেল ৫টা থেকে খুলে দেয়া হয় মন্দিরের দরজা। কিন্তু মন্দিরের ভক্তরা সুপ্রিম কোর্টের এই বিচার মেনে নিতে পারছে না। মঙ্গলবার বিকেল ৩টার দিক থেকে মন্দিরের সব বয়সী পুরুষ ও বর্ষীয়ান নারী ভক্তরা সাবারিমালার পথ আটকে মিছিল শুরু করে।
ওই সময় পূণ্যার্থীবাহী প্রত্যেকটি বাস থামিয়ে জোর করে উঠে তারা খুঁজে খুঁজে দেখতে থাকে ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সের কোনো নারী মন্দিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে কিনা। একই সঙ্গে সবাইকে নির্দেশনা দিতে থাকে যেন সুপ্রিম কোর্টের রায় কেউ আমলে না নেয়।
এ পর্যায়ে একটি সরকারি বাস থেকে মন্দিরগামী সাংবাদিকতা বিভাগের একদল ছাত্রীকে জোর করে টেনেহিঁচড়ে বের করে মারধর করে ফেরত পাঠিয়ে দেয় উত্তেজিত ভক্তরা। ওই সময় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মঙ্গলবারের ঘটনার পর পুরো এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করে সরকার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব ভক্তের সাবারিমালা মন্দিরে প্রবেশ নিশ্চিতের আশ্বাস দিলেও বুধবারও কোনো ‘নিষিদ্ধ’ বয়সের নারীকে মন্দিরে ঢুকতে দেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল ঘটনাস্থলে অবস্থানকারী ভক্তরা।
বুধবার বিকেল ৫টার সময় মন্দিরের দরজা খুলে দেয়ার পর বিক্ষোভকারীরা ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সী সব নারী পূণ্যার্থীকে মন্দিরে প্রবেশে বাধা দিতে থাকে। এ ঘটনায় পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এমনকি এক নারী সাংবাদিকের ওপরও হামলা চালায় তারা।
বিক্ষোভকারী ভক্তরা পুলিশ ও গণমাধ্যমের গাড়ি ভাঙচুর করে এবং পুলিশের দিকে পাথর ছুড়তে থাকে। ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত নারী স্বাস্থ্যকর্মী ও নারী পুলিশ কনস্টেবলরাও তাদের হামলা থেকে রেহাই পাননি।
এক পর্যায়ে পুলিশ লাঠিচার্জ করে এলাকা খালি করে। এ সময় ১২ জনের বেশি আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এসব কিছুর পরও নিজের অবস্থানে অনড় কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ান। বলেছেন, কোনো ভক্তকেই কেউ সাবারিমালায় যেতে বাধা দিয়ে রাখতে পারবে না।