দক্ষিণ কোরিয়ার আলোচিত এবং একই সঙ্গে বিতর্কিত পরিচালক কিম কি দুক কোভিড-সংক্রান্ত শারীরিক জটিলতায় ১১ ডিসেম্বর মারা গেছেন। থ্রি-আয়রন, পিয়েতা, দ্য আইল-এর নির্মাতা কিম কি দুক চলে গেলেন মাত্র ৫৯ বছর বয়সেই!
বার্লিনে ‘সিলভার বিয়ার’, কান-এ ‘উন সার্টেন রিগার্ড’, ভেনিস উৎসবে ‘গোল্ডেন লায়ন’ জিতেছেন তিনি। ইউরোপীয় চলচ্চিত্র উৎসবগুলোয় ছিল কিমের জয়জয়কার। কম বাজেটে দুর্দান্ত সিনেমা নির্মাণ করার কৌশল জানা এই নির্মাতাকে কোরিয়ার মেইনস্ট্রিম মনে করে ‘বাণিজ্যিকভাবে অসফল একজন নির্মাতা’। তবে এটি সত্য যে, তার ছবি সব ধরনের দর্শকের মন জয় করতে পারেনি। নিষ্ঠুরতা, সহিংসতা ও ডার্ক কন্টেন্টের জন্য সমালোচিত ও বিতর্কিত হয়েছিল তার ছবিগুলো।
দক্ষিণ কোরিয়ার বোংঘোয়ায় জন্ম নেন কিম। বেড়ে ওঠেন গরীব পরিবারে। স্কুল ছেড়ে দেন ১৪ বছর বয়সে। এরপর কয়েক বছর কাজ করেন এক কারখানায়।
পাঁচ বছর মেরিন কোর-এর পেটি অফিসার পদে চাকরি করার পর কোংশিন ইউনিভার্সিটিতে কিছুদিন পড়াশোনা করেন।
৩০ বছর বয়সে তিনি প্যারিসে চলে যান এবং মিউজিয়াম ও আর্ট গ্যালারি ঘুরে ঘুরে ছবি আঁকা শেখেন। ফ্রেঞ্চ রোমান্স ফিল্ম ‘দ্য লাভার্স অন দ্য ব্রিজ’ এবং আমেরিকান থ্রিলার ‘সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস’ দেখে সিনেমা নির্মাণের শখ হয় কিম কি দুক-এর। বলা যায়, ছবি দুটি দেখেই সিনেমা নির্মাণে অনুপ্রাণিত হন এই পৃথিবী খ্যাত নির্মাতা।
১৯৯৫ সালে কোরিয়া ফিরে কোরিয়ান ফিল্ম কাউন্সিল আয়োজিত চিত্রনাট্য প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জিতে যান কিম। এটিই চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট কিমের প্রথম পুরস্কার। এরপর ১৯৯৬ সালে প্রথম সিনেমা ‘ক্রোকোডাইল’ পরিচালনার সুযোগ পেয়ে যান। ছবির গল্পে দেখানো হয়, গণধর্ষণের শিকার হওয়া এক নারীকে আত্মহত্যার হাত থেকে বাঁচিয়ে দেন এক গৃহহীন পুরুষ। পরে সেই ব্যক্তি নিজেই ওই নারীকে ধর্ষণ করা শুরু করেন। স্বল্প বাজেটের এই ছবিটি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়।
তার সিনেমাগুলো বিতর্ক তৈরি করেছে কোরিয়ায়, কিন্তু সাড়া ফেলেছে আন্তর্জাতিক মহলে। ‘বার্ডকেজ ইন’-এর প্রিমিয়ার হয় বার্লিনেল এর প্যানারোমা শাখায় এবং ‘দ্য আইল’ ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিযোগিতা বিভাগে প্রদর্শিত হয়।
ব্যাড গাই (২০০১) বাণিজ্যিক ভাবে সফলতা পায় কোরিয়ায়। প্রায় ৭ লাখ দর্শক হলে গিয়ে ছবিটি দেখেছিলেন। ২০০৩-এর ছবি ‘স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার… অ্যান্ড স্প্রিং’ ছবিটি গ্র্যান্ড বেল অ্যাওয়ার্ড এবং ব্লু ড্রাগন ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয়।
২০০৪ সালে ‘সামারিটান গার্ল’ ছবির জন্য বার্লিনে ‘সিলভার বিয়ার’ পুরস্কার জিতেন কিম। এই ছবির গল্প একজন টিনএজ দেহপসারিনিকে ঘিরে। একই বছর তিনি ভেনিস উৎসবে সিলভার লায়ন পুরস্কার জিতে নেন সাইকো-হরর ড্রামা ‘থ্রি-আয়রন’ এর জন্য।
কিম কি দুক-এর ছবিতে দেখানো সহিংসতা ও নির্যাতন অনেক দর্শকের মনে অস্বস্তি তৈরি করতো। বিতর্ক তৈরি হয়েছে। অনেক দেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবুও থেমে থাকেননি কিম কি দুক।
২০১৭ সালে একটি খবর কিম কি দুক এর ভক্তদের চমকে দেয়। একাধিক নারীকে যৌন হেনস্তা করার অভিযোগ ওঠে নির্মাতার বিরুদ্ধে। তাদের অনেকেই কিম এর ছবির অভিনেত্রী, আবার অন্যরা বিভিন্ন সময়ে কাজ করেছেন কিম এর সাথে।
কিম কি দুক এর বিরুদ্ধে ধর্ষণ, জোরপূর্বক চুমু দেয়া, শারীরিক হেনস্তার অভিযোগ তুলেছেন অভিযোগকারীরা। তবে উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে বিষয়টি চাপা পড়ে যায়।
এসব অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় কিম বলেন, এই বিষয়গুলো সম্পর্কে তার ভিন্ন মত আছে। ক্ষমা চাওয়ার বদলে তিনি অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে মানহানি মামলা করে দেন।
কোরিয়ায় সমালোচিত কিম কি দুক বুঝতে পারেন, তার কাজের বিশেষ সমাদর আছে রাশিয়ায়। তিনি কাজাখস্তান-এ চলে যান এবং সেখানে সাম্প্রতিক ছবি ‘ডিসলভ’ নির্মাণ করেন। এরপর তিনি লাটভিয়ার স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার জন্য আবেদন করেন। সর্বশেষ নভেম্বরের ২০ তারিখে সেখানেই বাড়ি কিনতে গিয়েছিলেন তিনি।
কিম এর মৃত্যুর পর সারা বিশ্বের সিনেমাপ্রেমী মানুষ শোক অনুভব করলেও কোরিয়ান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নীরব ছিল। কোনো ফিল্ম অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেই আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি বা শোকবার্তা প্রকাশ করা হয়নি। কিম-এর কাছের কয়েকজন শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় শোক প্রকাশ করেছেন।
কোরিয়ার সমালোচকদের মতে, ‘কিম মেধাবী হলেও তিনি একজন অপরাধী।’ – কোরিয়ান টাইমস