সকাল ৬টায় ২৮ বছর বয়সী মেডিকেল ল্যাবরেটরি সায়েন্টিস্ট গুতামা হিব্রো যখন মিনেসোটার মিনেপোলিসের টার্গেট এরিনা বিমানবন্দরে পৌঁছালেন তখন ব্লকের চারপাশে অনেকেই টিকেটের জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সেখানে প্রায় ২০ হাজার ভক্ত চলে এলো, ধীরে ধীরে পুরো এলাকাটা ভরে গেলো। গুতামা জানান, ‘আমার চারপাশে লোকজন কান্নাকাটি করছিলো।
গুতামা কোনো পপ কনসার্টে ছিলেন না তখন। সেদিন ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যাবি আহমেদের আমেরিকার তিন শহর ভ্রমণের শেষ ধাপ ছিলো। জুলাইতে ৪২ বছর বয়সী এই প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ২ লাখ ৫১ হাজার ইথিওপিয়ানের সঙ্গে দেখা করতে যান। তারা জাতিগত নিধন, সহিংসতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার হয়ে নিজেদের মাতৃভূমি ছেড়ে এসেছিলো।
২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়া অ্যাক্টিভিস্ট মোহাম্মেদ আদেমো বলেন, বারাক ওবামার নির্বাচনের পরে এইভাবে কোনো আশার সঞ্চার আমরা দেখিনি।
এপ্রিলের ২ তারিখে দায়িত্ব গ্রহণ করেন আফ্রিকার সবচেয়ে কম বয়সী সরকারপ্রধান অ্যাবি আহমেদ। তিনি ইথিওপিয়ার সবাইকে চমকে দেন উদার সংস্কারের বিন্যাস করে যেটা দেশটিকে গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করে। সেই সময়ে অ্যাবি হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্ত করে দেন, সেন্সর হওয়া শত শত ওয়েবসাইট উন্মুক্ত করে দেন এবং ইরিত্রিয়ার সঙ্গে ২০ বছরের যুদ্ধেরও অবসান করেন, রাজ্য জরুরি অবস্থা তুলে নেন এবং ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের জন্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্র উন্মুক্ত করে দেন। তার মধ্যে রাজ্য মালিকানাধীন ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সও ছিলো।
ইথিওপিয়ার রাজধানী আদিস আবাবাতে ট্যাক্সির বড় স্ক্রিন অ্যাবি স্টিকারে ঢাকা, সাধারণ নাগরিকরা তাদের হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক প্রোফাইল পিকচার করছেন প্রো-অ্যাবি স্লোগান দিয়ে, টাকা খরচ করছেন অ্যাবি টি শার্ট কিনতে। একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির মালিক ইলিয়াস টেসফায়ে জানান, গত ছয় সপ্তাহে তিনি ২০ হাজার টি শার্ট বিক্রি করেছেন অ্যাবির মুখ আকা। যেগুলোর দাম ৩০০ বির বা ১০ ডলার। জুনে রাজধানীর মেসকেল স্কয়ারে আয়োজিত এক অ্যাবি র্যালিতে অংশ নেয় ৪০ লাখ মানুষ।
বিষয়টা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। অ্যাবি ইথিওপিয়ার প্রথম প্রধানমন্ত্রী দেশটির সবচেয়ে বড় জাতিগত গোষ্ঠী অরোমোর সদস্য। যাদের সংখ্যাটা ১০০ মিলিয়ন মানুষের এক তৃতীয়াংশ। ইথিওপিয়ার ৯০টি জাতিগত গোষ্ঠী রয়েছে। এবং কয়েক দশকের চলমান রাজনীতির কারণে একটা বিভেদমূলক লাইন তৈরি হয়েছে গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে।
১৯৯১ সালে টিগরায়ান পিপল’স লিবারেশন ফ্রন্ট টিপিএলএফ মেনগিস্টু হাইলে মরিয়ামের একনায়কত্ব ক্ষমতাচ্যুত করে। যিনি ১৯৭৪ সাল থেকে সেনাশাসন চালিয়ে আসছিলেন। ১৯৮৯ সালে টিপিএলএফ বড় জাতিগোষ্ঠীগুলো যেমন অরোমো ও আমহারার সঙ্গে জোট বোধার পরিকল্পনা করে। কিন্তু অ্যাবি জোট বাঁধেন ইথিওপিয়ান পিপল’স রিভলিউশনারি ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ইপিআরডিএফের সঙ্গে। সাম্প্রতিক সময়ে ইথিওপিয়ায় আবারো বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভের মুখে ২০১৮ সালে পদত্যাগ করেন ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী সাউদার্ন ইথিওপিয়ান পিপলস ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্টের হাইলে মারিয়াম ডিসালেন। এরপর ক্ষমতা গ্রহণ করেন অ্যাবি।
অ্যাবি মোটেও তার আগের প্রধানমন্ত্রীদের মতো নয়। সে রাজনীতিবিদদের প্রকাশ্যে জড়িয়ে ধরেছেন, ভক্তদের সঙ্গে ছবি তুলেছেন, তিনি শুধু ক্যামেরার সামনে হাসেন না বরং দীপ্তি ছড়ান। ইথিওপোয়ার জাতিগোষ্ঠীগুলোকে তিনি বার্তা দেন, দেয়ালটি ভেঙে দিন, বরং সেখানে সেতু তৈরি করুন।
মিনেসোটাতে তিনি বলেন, একজন আরেজনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকো। যদি তুমি তোমার প্রজন্মের গর্ব হতে চাও। তারপর তোমাকে অবশ্যই সিদ্ধান্ত আসতে হবে যে অরোমস, আমহারাস, ওলাইটাস, গুরেজেস এবং সিলটেস সবাই সমানভাবে ইথিওপিয়ান।
একটি শারিরীকভাবে বৈষম্যমূলক একটি রাষ্ট্রের জন্য এটি একটি বিপ্লবী ম্যাসেজ। যুক্তরাষ্ট্র সফরে পরামর্শক হিসেবে থাকা অ্যাডেমো বলেন, মানুষ বুঝতে পারে এমন ভাষায় তিনি কথা বলেন। মানুষ কাঁদছিলো কারণ তারা কোনো টানেলের শেষপ্রান্তে এসে আলোর দেখা পেয়েছে। মানুষ শেষ পর্যন্ত তাদের সেই নেতাকে পেয়েছে যার জন্য তারা অপেক্ষা করছিলো।
অ্যাবির নিজের পরিচিতি জাতিগত দলগুলোর মধ্যে সেতু তৈরি করতে সাহায্য করেছে। তার বাবা একজন মুসলিম অরোমো এবং মা ক্রিস্টান। একই সঙ্গে অরোমো, আমহারিক, টিগরিনয়া এবং ইংলিশে কথা বলতে স্বচ্ছন্দ অ্যাবি। মিনেসোটাতেও তিন ভাষাতেই সবাইকে সম্বোধন করেন তিনি। পাশাপাশি কিছু সোমালি ভাষাও বলেন ইথিওপিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের মানুষদের জন্য।
তার পেশাগত জীবনও বেশ বর্নাঢ্য। ১৯৯০ এর দিকে অ্যাবি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী হিসেবে রুয়ান্ডাতে কাজ করতেন। তারপর ইথিওপিয়ান সাইবার সিকিউরিটি এজেন্সি ইনসার প্রধান হিসেবেও কাজ করেন। ছিলেন বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী। অরোমা এলাকার ডেপুটি প্রেসিডেন্টও হন তিনি।
ইথিওপিয়ায় এখন দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি চলছে। তবে অ্যাবির সাফল্যের গল্পে কিছু হালকা অদ্ভূতুড়ে পয়েন্টও আছে। নিজেকে একজন স্বাধীন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে প্রকাশ করেন চার মাসের অফিস জীবনে তিনি কোনো সাক্ষাৎকার দেননি। এই সময়ে কোনো প্রাইভেট মিডিয়াকে কোনো আয়োজনে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। কেন জানানো হয়নি, সেই কারণ এখনো কারো কাছেই পরিস্কার নয়। এমনকি তার বিবাহিত জীবন ও তিন মেয়ের জনক হওয়ার বিষয়টি নিয়েও অনেকের প্রশ্ন আছে।
এর আগের সরকারের সময়ে রাজনৈতিক বন্দীদের নির্যাতনের কথা তুলে ক্ষমা চান অ্যাবি, তবে দোষী গার্ডদের কোনো শাস্তির নমুনা এখনো মেলেনি।
এসব ছোট বিষয় বাদ দিলে ‘ইথিওপিয়ার মতো একটি দেশে অ্যাবি লাখে ১ জন। আফ্রিকার দেখা সেরা নেতাদের একজন তিনি। ’এমনটাই মন্তব্য করেন তেল আবিবে বসবাসকারী ইথিওপিয়ান মুলা জিতা।