বোকার বাক্স টেলিভিশনে মানুষের বিনোদনের এক উপলক্ষ টক-শো। এর বড় কারণ সেখানে কথকরা যা ইচ্ছা তাই বলতে পারেন, তাই বলেন। পত্রিকায় লেখার ক্ষেত্রে নীতিমালা মেনে চলতে হলেও টক-শোতে এসবের বালাই নেই। যা মনে আসে তাই বলা যায় বলে মানুষও শুনে এবং কখনো কখনো অঙ্গভঙ্গি দেখে বিনোদিত হয়।
মাঝেমধ্যে টক-শোতে আলোচিত বিষয়-আশয় পরে সাধারণেরও আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, কখনো কখনো জাতীয় সংসদ পর্যন্ত চলে যায় ওই আলোচনা। এমপিরা কেউ ‘হঠাৎ দেশে শিশু হত্যার ঘটনা’ বেড়ে যাওয়ার মতো বিষয়ে আগ্রহ না পেলেও টক-শোতে আলোচিত বিষয়কে এজেন্ডা করেন। পার্লামেন্টেও যেহেতু যা ইচ্ছা বলে ফেলা যায়, সেটাও যেহেতু নিত্যদিন কয়েক ঘণ্টা ধরে এক ধরনের টক-শো, কখনো সখনো পরে এক্সপাঞ্জ হলেও তাৎক্ষণিক বলার সুযোগটা তারা ষোল আনাই নেন।
জাতীয় সংসদে সর্বশেষ এরকম আলোচনার বিষয় ছিলো একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের একটি স্বীকারোক্তি। যে টক-শোটিতে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ ‘অ্যাঁ-অ্যাঁ’, সেরকম একটি অনুষ্ঠানে মাহফুজ আনাম তার দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে সম্পাদকীয় সিদ্ধান্তে একটি ভুলের কথা স্বীকার করে সাধারণ মানুষ থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত জায়গা করে নিয়েছেন। যতো শতাংশ ভোটেই তারা নির্বাচিত হয়ে থাকুন না কেনো (ভোটের বাক্স খালি থাকাটা অবশ্য তাদের ব্যক্তিগত কোনো দোষ নয়) নীতি-নৈতিকতার প্রতি পরম শ্রদ্ধা দেখিয়ে তারা মাহফুজ আনামকে সম্পাদক পদ ছেড়ে দিতে বলেছেন। তবে একইসঙ্গে তারা বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিকটি বন্ধ করে দেয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে মাহফুজ আনামের বিচারও দাবি করেছেন।
প্রথা অনুযায়ী সংসদে এমন কারো সমালোচনা করা যায় না যার পক্ষে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে অাত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নেই। কোনো ক্যামেরা সেশন বা স্থায়ী কমিটির ক্যামেরা বৈঠকে ডেকে নিয়ে বক্তব্য নেওয়ার ঘটনাও সেটা ছিলো না। তারপরও তারা মাহফুজ আনামের বিচার দাবি করেছেন। বিজ্ঞ এমপিদের কাছে যদি মাহফুজ আনামকে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রদ্রোহী মনে হয়, ঠিক আছে, তারা সেটা করতেই পারেন, বিচারের দাবি জানাতেই পারেন।
তবে, যে মাহফুজ আনামকে তারা রাষ্ট্রেদ্রোহী বলছেন তার আরো একটা পরিচয় আছে। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তারপরও বলতে হয়, মুক্তিযোদ্ধাদেরও যে বিচ্যুতি ঘটেনি, মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ যে রাষ্ট্রদ্রোহিতা করতে পারেন না এমন না। তার অপরাধটা আমরা পরে বিশ্লেষণ করতে পারি। তার আগে একবার দেখে নেই তিনি কোন ধরনের সম্পাদক নন:
১. মাহফুজ আনাম মেয়ের জামাইয়ের জন্য সরকারের কাছ থেকে সিএনজি পাম্প নেওয়া সম্পাদক না।
২. মাহফুজ আনাম ভূমিদস্যুতার পক্ষে ঝাণ্ডাধারী সম্পাদক না।
৩. মাহফুজ আনাম ডেভেলপার হিসেবে টাকা-পয়সা নিয়ে মানুষকে ফ্ল্যাট না বুঝিয়ে দেওয়া সম্পাদক না।
৪. মাহফুজ আনাম পত্রিকার চেয়ে সম্পাদকের সার্কুলেশন বেশি (পত্রিকা বিক্রি না হলেও টক-শোতে প্রতিদিন জ্ঞান বিলানো) সম্পাদক না।
৫. মাহফুজ আনাম সম্পাদককে হটিয়ে দিয়ে ক্যু করা সম্পাদক না।
৬. মাহফুজ আনাম কোনো দলীয় অানুগত্যের সম্পাদক না।
এ তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করা যায়। ঢাকার গণমাধ্যম কর্মীরা যারা নিজ নিজ সম্পাদকের সীমাবদ্ধতা জানেন তারা চাইলেও সাত, আট, নয় করে এগিয়ে যেতে পারেন। মাহফুজ আনাম কোনো মহাপুরুষ সম্পাদক নন। তাই তার সীমাবদ্ধতার কথাও তার সহকর্মীদের জানার কথা। চাইলে তারা মাহফুজ আনাম কোন ধরনের সম্পাদক এবং কোন ধরনের সম্পাদক নন সে তালিকা তৈরি করতে পারবেন।
তবে মাহফুজ আনাম যে এখন আলোচিত এক মানুষ, তার মূল কারণ ছয় নম্বরটি। তিনি দলীয় আনুগত্যের সম্পাদক নন বলেই সবসময়ই সব দলের তিনি চক্ষুশূল। সে কারণে তার একটি ‘ভুল স্বীকার’কে ‘মওকা’ হিসেবে নিয়েছে এখনকার ক্ষমতাসীনদের একটি অংশ। সে কারণে তারা মাহফুজ আনামের ‘কল্লা’ চাচ্ছে। ভুল বলছি না, কল্লাই চাচ্ছে তারা। রাষ্ট্রদ্রোহিতার সর্বোচ্চ শাস্তিতো মৃত্যুদণ্ডই।
কিন্তু, তার অপরাধটা কী?
তার মূল অপরাধ যে তিনি ওয়ান ইলেভেন সরকারকে সমর্থন দিয়েছেন। দু’ নেত্রীকে রাজনীতি থেকে বিদায় করে দিতে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা বাস্তবায়নে তিনি সহযোগী হয়েছিলেন বলে তার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযোগ। আর তৃতীয় অভিযোগ হচ্ছে যে তিনি এজন্য ডিজিএফআই’র সরবরাহ করা সংবাদ ছেপে সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা ভেঙ্গেছেন।
তৃতীয় যে অভিযোগ সে বিষয়ে এক বা একাধিক রিপোর্টের ক্ষেত্রে তিনি নিজেই ভুল স্বীকার করেছেন। টক-শোতে তিনি নিজেই বলেছেন, সম্পাদকীয় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এটা তার সম্পাদক জীবনে একটা বড় ভুল। টক-শো’র ভিডিওটি দেখতে নীচের লিংকে ক্লিক করুন:
সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সরবরাহ করা একপক্ষীয় তথ্য দিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করা সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে অবশ্যই অনৈতিক কাজ। বিশেষ করে মাহফুজ আনামের পত্রিকা ডেইলি স্টার যে ‘স্ট্যান্ডার্ড জার্নালিজম’ করে, গত ২৫ বছরে ডেইলি স্টার নিজেরা, বিশেষ করে বড় সময় ধরেই এর সম্পাদক হিসেবে মাহফুজ আনাম এদেশে সাংবাদিকতার মানের যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছেন; তাতে ওই পত্রিকায়, মাহফুজ আনামের পত্রিকায় তার ভাষায় ‘ইন্ডিপেন্ডেন্টলি ভেরিফাই’ ছাড়া এরকম প্রতিবেদন কারো কাছেই কাঙ্খিত ছিলো না।
সত্য যে ওইসময় সব পত্রিকাতেই এরকম প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। তার কিছু ছাপা হয়েছে সামরিক বাহিনীর হর্তা-কর্তাদের চাপে, বড় একটি অংশ সেই তালিকায় না থাকলেও নিজেরাই চেয়েচিন্তে তা ছাপিয়ে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চেয়েছে। যে দুয়েকটি পত্রিকা তা প্রকাশ করেনি তারা অতো গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না যে সামরিক বাহিনী তাদেরকে এরকম প্রতিবেদন ছাপতে বাধ্য করে সময়ের অপচয় করবে। বিপরীতে যাদেরকে তারা ছাপতে বাধ্য করেছে, গুরুত্ব-প্রভাব-এবং-মানের দিক থেকে ডেইলি স্টার ছিলো তাদের প্রধান টর্গেটের একটি।
কিন্তু, সম্পাদক হিসেবে মাহফুজ আনামের অতীত এবং দৈনিক পত্রিকা হিসেবে ডেইলি স্টারের কাছ থেকে এটা অপ্রত্যাশিত ছিলো। মাহফুজ আনাম এরকম চাপের কাছে নতি স্বীকার করবেন না এটাই ছিলো প্রত্যাশিত। তার কারণও খুব স্পষ্ট। অন্য পত্রিকাগুলো প্রতিদিন– আগের মতো এখনো– ‘ইন্ডিপেন্ডেন্টলি ভেরিফাই’ ছাড়া এরকম রিপোর্ট প্রকাশ করছে। মালিকপক্ষের গাড়িচালক থেকে শুরু করে সম্পাদকের শ্যালিকার ব্যক্তিগত স্বার্থে এরকম প্রতিবেদন প্রকাশ তাদের জন্য ডালভাত। তাই তারা ওয়ান ইলেভেনের সময় যে ক্ষমতাবানদের পা আরো বেশি চাটবে সেটা খুব স্বাভাবিক ধরে নিয়েছিলো সবাই। কিন্তু, মানের দিক থেকে আদর্শ সাংবাদিকতা করা, সবসময় সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা মেনে চলা ডেইলি স্টার-প্রথম আলোর কাছে কেউ সেটা আশা করেনি।
তাই গত কয়েক বছর সাংবাদিকদের নিজেদের মধ্যে যে বিষয়টি আলোচনার বিষয় ছিলো সেটাই প্রশ্ন হিসেবে ওই টক-শোতে এসেছে। কিন্তু, মাহফুজ আনাম তার ভুল স্বীকার করতে ভুল করেননি। খুব ভালো হতো যদি অাত্মউপলব্ধি থেকে সম্পাদকদের সংগঠনটি আগেই এ বিষয়ে ভুল স্বীকার করে নিতো। সেটা হয়নি। হয়নি তার কারণ: বেশিরভাগ সম্পাদকের মধ্যে এ বিষয়টি কখনো কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি। প্রতিদিন যারা এরকম প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাদের কাছে ওয়ান ইলেভেনের সময় প্রকাশিত একপক্ষীয় প্রতিবেদনগুলো কখনো ভুলই মনে হওয়ার কথা না! তাহলে আর তারা ভুল স্বীকার করবেন কিভাবে?
কিন্তু, এখন মনে হচ্ছে মাহফুজ আনাম ভুল স্বীকার করেই আরেকটি ভুল করেছেন। সবাই তার উপর যেভাবে হামলে পড়েছে, সাংবাদিকতার ‘একাডেমিক বিতর্কের’ বিষয়টিকে যেভাবে প্রধান রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করেছে, যে আলোচনা থেকে আমাদের সম্পাদকরা একটা শিক্ষা নিয়ে নিজেদের মেরুদণ্ডটা আরেকটু শক্তিশালী করার সাহস পেতে পারতেন সেটাকে এখন মাহফুজ আনামের ‘কল্লা’ চাওয়ার ইস্যুতে পরিণত করা হয়েছে।
কারণ হিসেবে তাকে ওয়ান ইলেভেনের সমর্থক এবং ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা বাস্তবায়নে সহায়তাকারী হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। মজার বিষয় হচ্ছে, ডেইলি স্টারের পাঠকমাত্রই জানেন পত্রিকাটি শুরু থেকেই ওয়ান ইলেভেনের সমর্থক ছিলো। এটা মোটেই লুকোছাপার কোনো বিষয় ছিলো না। ওইসময় ইয়াজউদ্দিন সাহেবরা খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানদের অঙ্গুলি হেলনে দেশকে যে অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিলেন আর আওয়ামী লীগসহ অন্যদের প্রতিক্রিয়ায় যে গৃহযুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিলো তাতে একটি হস্তক্ষেপকে সারাদেশের মানুষের মতো ডেইলি স্টারও স্বাগত জানিয়েছিলো। মনে রাখা উচিত, এখন যারা ক্ষমতায় আছেন তারাও কিন্তু ওয়ান ইলেভেনের জন্য কৃতিত্বের দাবি করেছিলেন। এর কারণও ওই সরকারের প্রতি মানুষের সমর্থন।
সুস্থবুদ্ধির সব মানুষের মতো ডেইলি স্টার আর যে কারণে ওয়ান ইলেভেনকে সমর্থন করেছিলো সেটা হলো সংস্কারের প্রতিশ্রুতি। নতুন করে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার মাত্র দেড় যুগ পর গণতন্ত্র আবার যখন হুমকির মুখে পড়েছিলো তখন এটা স্পষ্ট ছিলো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ছাড়া গণতন্ত্রকে রক্ষা করা যাবে না। এ সংস্কারের সঙ্গে দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো ওয়ান ইলেভেন সরকার। তবে ওই দুর্নীতিবিরোধী লড়াইকে ওয়ান ইলেভেন সরকারের একটি অংশ যখন নিজেদের ক্ষমতায় থাকার উপলক্ষ করছিলো তখন অন্যরা চুপচাপ থাকলেও মাহফুজ আনাম উচ্চকণ্ঠ হয়েছেন। শেখ হাসিনার গ্রেফতারে তার পত্রিকার ভূমিকা ছিলো বলে যে অভিযোগ সে বিষয়েও স্পষ্ট ধারণা দেবে শেখ হাসিনার গ্রেফতারের পরদিন প্রকাশিত মাহফুজ আনামের মন্তব্য প্রতিবেদন। (প্রতিবেদনটি পড়তে ক্লিক করুন)
শুধু একটি বা দুটি রিপোর্ট দেখে একটি পত্রিকা বা একজন সম্পাদককে বিচার করা ভুল হবে। এজন্য পত্রিকাটি পড়তে হবে। বিশেষ করে মাহফুজ আনামের যে লেখাটি আজ পুনর্মুদ্রিত হয়েছে অন্ততঃ সেটা পড়তে হবে। তবে, যারা তার বিচার দাবি করছেন তারা যে সেটা জানেন না এমন নয়। তাদের মূল লক্ষ্য আসলে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। বড় জায়গা থেকেই তারা সেটা শুরু করতে চান। অন্যরা তাহলে আপনাআপনি চুপ হয়ে যাবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)