‘ক্ষ্যাত’ একটি গালি, একই অর্থে ‘চাষা’ শব্দটিও গালি অর্থে বোঝানো হয়, হচ্ছে। এই ক্ষ্যাত হলো সেই খ্যাত যেখানে উৎপাদন হয় আমাদের জীবন যাপনের পণ্য-দ্রব্য। আবার এই চাষা হলো সেই চাষা যারা কৃষিপণ্য উৎপাদন করেন। এখনতো যে অবস্থা গালি দিয়েও মন ভরছে না, কৃষকের হাতে থাকা পণ্যের দাম নেই। একই পণ্য হাত বদল হয়ে কৃষকের হাত থেকে ব্যবসায়ীর হাতে গেলেই দাম দ্বিগুণ, তিনগুণ, চারগুণ বা তারও বেশি।
আর একটি বিষয়, এখন কৃষি ঋণ বেশ সহজলভ্য। ফলে কম বেশি সব কৃষকই ঋণ গ্রহণ করেন। ফসল কাটার মৌসুমে সেই টাকা সুদসমেত ফেরত দেয়ার প্রয়োজন হয়। যে ঋণ নিয়ে ধান উৎপাদন করেছেন তিনি এবার ঋণ শোধ করবেন কীভাবে?
চলতি বছরের ১০মে তারিখে বিবিসি বাংলা প্রতিবেদন প্রকাশ করে, ‘কৃষি শ্রমিক: বাংলাদেশের গ্রামে একজন কৃষি শ্রমিকের দৈনিক মজুরি একমণ ধানের দামের চেয়েও বেশি’।
জানা যায়, ধানের মণ ৪৮০ টাকা আর দিন মজুরের বেতন ৭০০ টাকা। এই যে ঘাটতি এই ঘাটতি পূরণ হবার নয়। এতো শুধু ধান কাটার হিসেব, সেচ খরচ, ধান মাড়াই, ধান শুকানো এসবতো বাদই রয়েছে। এতো ঘাটতি নিয়ে কৃষক নিশ্চয় দেশে ও জাতির জন্য খাদ্য সরবরাহের মহাদায়িত্ব নিয়ে বসে থাকবেন না।
কিছু চিত্রের কথা মনে করা যেতে পারে, মসলিন-জামদানি কাপড় বুননের জন্য ইংরেজরা একবার অনেক অনেক বেশি দাদন দিয়েছিলেন, এতো কাপড়ের অর্ডার করেছিলেন যে, তারা জানতেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এ দেশের বস্ত্রশিল্পীরা এই পোশাক সরবরাহ করতে পারবেন না। ঠিক তাই হয়েছিল। বস্ত্রশিল্পীদের কাঁধে তখন ঋণের বোঝা তারা আর অন্য কুঠি যেমন-ওলন্দাজ, ফরাসিদের কাছ থেকে বস্ত্রের অর্ডার নিতে পারলো না। ওলন্দাজ ও ফরাসিরা ব্যবসা গুটিয়ে চলে গেলেন। প্রতিযোগিতাহীন হয়ে পড়লো বাজার, দরদাম নিয়ে বস্ত্রশিল্পীদের কোন কিছু বলার সুযোগ আর রইল না। তারা নীরব দাসে পরিণত হয়ে গেলেন।
আমরা আরো মনে করতে পারি চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের অশনি সংকেত’ সিনেমার কথা। দুর্ভিক্ষের সময়, চালের দাম হুরহুর করে বাড়তে থাকলো তারপর ঘোষণা এলো বাজার থেকে চাউল উধাও। মাটির সঙ্গে নাড়ির বাঁধন ছিন্ন করে মানুষ শহরমুখী হলো। শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা ঊর্ধ্বমুখী।
খাবারের সন্ধানে মানুষ কীভাবে শহরমুখী হয়েছে তার চিত্র ধারণ করে, বাংলাদেশের বরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপি এখন ট্রেনে’ সিনেমায়। ভাতের রাজনীতি মানুষকে উম্মুল করে দেয়, বোধের রাজ্যে ক্রমাগত আঘাত করে, মানুষকে সহিংসও করে তোলে।
জমির মালিকানা হারানো কৃষক হয়ে পড়েন পৃথিবীর অসহয় সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের মানুষ। ‘ভাত দে’ চলচ্চিত্রে আমরা সেই করুণ দৃশ্য দেখেছি।
কথা হচ্ছে, কৃষককে যেন তার জমির মালিকানা হারাতে না হয়। ক্রমাগত লোকসান তাদেরকে কৃষি বিমুখ করবে। এই সুযোগে কৃষকের সহায়তা করার নামে বিভিন্ন সংস্থা-কোম্পানি গ্রামে প্রবেশ করবে, অনুপ্রবেশ করবে-ঘাঁটি করবে।
মাটির কাছাকাছি দিন যাপন করা কৃষকের দ্বারে কেউ উপস্থিত হলে তারা বরে নিয়েছে হৃদ্যতায়। ভয় এখানেই।
কে তাদের সহযোগী। মনে করে দেখুনতো গত কয়েক বছরে কৃষকের স্বার্থজনিত কোন অধিকার আদায়ে কোন রাজনৈতিক দল রাস্তায় নেমেছিল কিনা, নামেনি। জনবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রথমে ছুঁড়ে ফেলে তার মৃত্তিকা সন্তানদের।
যাইহোক, বিভিন্ন কোম্পানি কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তারা সনাতনী কৃষি পদ্ধতি বাদ দিতে বলছে, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে বলছে। ক্রমাগত লসের হিসেব মিলাতে গিয়ে কৃষক তার জমি কোম্পানির হাতে তুলে দিবে। এই পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। এতে ফলন বাড়বে কিন্তু মালিকানা চলে যাবে কোম্পানির হাতে। আবার কোম্পানি! এবার ইংরেজ, ওলন্দাজ, ফরাসি নয়, দেশি কোম্পানি। তবে সংগ্রামটা হবে কাকে সঙ্গে নিয়ে?
সনাতন নয় আধুনিক পদ্ধতি, আর প্রযুক্তির যৌক্তিক ব্যবহারের সুযোগ ইনডিভিজ্যুয়ালি কৃষককে দেয়া হোক। কৃষকের পণ্যের ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করা হোক। সরকারের বাইরে অদৃশ্যহাত বেশি শক্তিশালী হয়ে যাওয়া সরকারের জন্যও সুখকর হবার নয়। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন। কৃষিতে বিপর্যয় নেমে আসলে শহরের ওপর মানুষের চাপ আরও বাড়বে। মহাজনী বা কোম্পানির শোষণে না পড়ুক মৃত্তিকা সন্তানেরা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)