পশ্চিমা দেশগুলো থেকে রুশ কূটনীতিক বহিষ্কারের ঘটনা মস্কোর ক্রিমিয়া দখলের পর রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যকার সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক সংকটে পরিণত হচ্ছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।
যুক্তরাজ্যে রুশ সাবেক গুপ্তচর ও তার মেয়েকে বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় যুক্তরাজ্যের সঙ্গে একতা প্রকাশ করে এবার একে একে ২০টিরও বেশি দেশ থেকে শতাধিক রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছে। তাদের একটাই কথা – আরেক দেশের মধ্যে ঢুকে এ ধরনের কাজ করা মারাত্মক আন্তর্জাতিক অপরাধ। এর সাজা রাশিয়াকে পেতেই হবে।
কর্নেল সের্গেই স্ক্রিপাল ও তার মেয়ে ইউলিয়াকে বিষাক্ত নার্ভ এজেন্ট দিয়ে হত্যা চেষ্টা যে রাশিয়ার কাজ হওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি, ব্রিটেনের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো এটা স্পষ্টভাবেই বিশ্বাস করে নিয়েছে। তাই রাশিয়া যা-ই বলুক, যতই অস্বীকার আর প্রতিবাদ করুক, সেটা মানতে রাজি না তারা।
ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক জানান, স্যালিসবারি বিষপ্রয়োগ ইস্যুতে গত সপ্তাহে আয়োজিত এক বৈঠকেই বিভিন্ন দেশে এক সঙ্গে রুশ কূটনীতিকদের বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-ভুক্ত দেশগুলো।
ইইউ বর্তমান মতৈক্যের অধীনে ভবিষ্যতে আরও বেশকিছু বহিষ্কারের ঘটনা ঘটতে পারে বলেও জানান টাস্ক। বলেন, আরও কিছু পরিকল্পনা রয়েছে এ ব্যাপারে, যা পরে বাস্তবায়িত হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র: অতি কোমল থেকে অতি কঠোর
অন্যান্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের তুলনায় ডোনাল্ড ট্রাম্প রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি অনেকটাই বেশি অনুরাগী বলে বেশ সমালোচিত। এমনকি ট্রাম্পকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বানানোর পেছনে রাশিয়ার ভূমিকা ছিল – এমন অভিযোগ থেকে তদন্তও চলছে। অথচ যুক্তরাজ্যে ঘটা ঘটনার জন্য যুক্তরাজ্য যেখানে ২৩ জন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করল, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র করল ৬০ জনকে!
বিবিসি’র তথ্য অনুসারে, গত সপ্তাহেই ফোনালাপ হয়েছিল ট্রাম্প-পুতিনের। রুশ গুপ্তচর হত্যা চেষ্টা নিয়ে তখন তোলপাড় চললেও পুতিনকে ফোন করে এ নিয়ে একটি কথাও বলেননি ট্রাম্প। অথচ উপদেষ্টাদের নিষেধ না শুনে ঠিকই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুননির্বাচিত হওয়ায় অভিনন্দন জানিয়েছেন তিনি।
৬০ জন কূটনীতিককে বহিষ্কারের সময় মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র যুক্তরাজ্যের ওপর এই হামলা অসংখ্য নির্দোষ মানুষের জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিল। একে আন্তর্জাতিক আইনের ‘ভয়াবহ লঙ্ঘন’ বলেও উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে।
সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের কোমল সুর এক সপ্তাহের মাথায় হঠাৎ বজ্রকঠিন হয়ে যাওয়াই প্রমাণ করে, রাশিয়ার কর্মকাণ্ড নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায়ই পড়ে গেছে দেশটি। আর সিয়াটলে রুশ কনস্যুলেট বন্ধ করে দেয়া নির্দেশ করে গুপ্তচরবৃত্তি আর সাইবার-হামলার মাধ্যমে জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে আমেরিকার আশঙ্কার বিষয়টি। কারণ এই শহরের খুব কাছেই মার্কিন সাবমেরিন ঘাঁটি আর আর এরোস্পেস ফার্ম বোয়িং-এর কার্যালয়।
বেক্সিট বিপত্তির মাঝেও টেরেসার ‘বিরাট জয়’
ইইউ’কে নিজের পক্ষে এনে এত বড় একটা পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে’র জন্য অনেক বড় জয়। বিশেষ করে চলমান ব্রেক্সিট আলোচনার ফলে যুক্তরাজ্য-ইইউ সম্পর্কের অবনতির মাঝেও ব্রিটেনের ডাকে ইইউ দেশগুলোর এগিয়ে আসা প্রমাণ করে, এদের একতা এত সহজে ভাঙার নয়।
মস্কোর দিকে আঙ্গুল তুলতে এবার দেরি করেনি ব্রিটেন। জনগণের বিতর্ক-সমালোচনাকে পাত্তা না দিয়ে কূটনৈতিক পথে এগিয়েছে দেশটি। ইইউ, ন্যাটো, জাতিসংঘ এবং ওপিসিডব্লিউ (অর্গানাইজেশন ফর দ্য প্রহিবিশন অব কেমিক্যাল উইপনস)-এর মতো আন্তর্জাতিক জোটগুলোর সামনে সাক্ষ্য-প্রমাণ তুলে ধরে নিজের অবস্থান পরিষ্কার ছিল যুক্তরাজ্যের কৌশল।
আর এ কারণেই ব্রেক্সিট চাপে থেকেও টেরেসা এই কূটনৈতিক জয় পেয়েছেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
যুক্তরাজ্যের যুক্তি
টেরেসা মে ২৩ রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কারের সময় বলেছিলেন, এই ২৩ জনকে রাশিয়ার ‘অঘোষিত গোয়েন্দা কর্মকর্তা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সোজা ভাষায় বললে, এরা হলেন রাশিয়ার গুপ্তচর, যারা ‘সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা’ পরিচয়ে রুশ কূটনীতিক হিসেবে যুক্তরাজ্যে ঘোরাফেরা করছেন এবং যুক্তরাজ্যের বিরুদ্ধে গোপন তথ্য সংগ্রহ করছেন।
সাবেক রুশ গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপাল ডাবল এজেন্ট হিসেবে ক্রেমলিনের খবর ব্রিটিশ সরকারকে সরবরাহ করতেন। এ কারণেই তাকে হত্যা চেষ্টায় আঙ্গুল রাশিয়ার দিকেই উঠল।
এর প্রতিক্রিয়ায় ব্রিটেনে কূটনীতিক বহিষ্কারের অর্থ হলো অভিজ্ঞ গুপ্তচরদের একটি বিশাল দলের কর্মকাণ্ড আটকে দেয়া, যেন তারা যুক্তরাজ্যের কোনো গোপন ও সম্ভাব্য স্পর্শকাতর তথ্য রাশিয়ায় পাচার করতে না পারে। অদূর ভবিষ্যতেও যেন এভাবে অঘোষিত কূটনীতিক রাশিয়া নিতে না পারে সেটাও এই পদক্ষেপের অন্যতম উদ্দেশ্য।
টেরেসার ভাষণে মূলত রাশিয়ার যুক্তরাজ্যবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে। অর্থাৎ যুক্তরাজ্যের মাটিতে থেকে যুক্তরাজ্যের বিরুদ্ধে কাউকে কিছু করতে দেয়া হবে না। তবে বৈধভাবে ব্যবসাসহ বিভিন্ন কাজে রাশিয়ার নাগরিকরা অবশ্যই সেখানে থাকতে পারবেন এবং আসা-যাওয়া করতে পারবেন। এদেরকে আপাতত আশঙ্কার আওতায় আনছে না ব্রিটিশ সরকার।
রুশ কূটনীতিকদের বহিষ্কার প্রক্রিয়ায় মোটামুটি যুক্তরাজ্যের পদ্ধতিই মেনে চলছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে।
কী করবে রাশিয়া
এখন দেখার বিষয় রাশিয়া এর জবাবে কী করে। ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্যে কূটনীতিক বহিষ্কারের ঘটনায় ২৩ ব্রিটিশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে দেশটি। আর সোমবারের ঘোষণাকে ‘উস্কানিমূলক আচরণ’ উল্লেখ করে এর জবাব দেয়ার অঙ্গীকারও করেছে দেশটি।
তবে ভবিষ্যতে আরও কঠোর বহিষ্কারের পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে – কথাটি বলে পুতিনকে স্পষ্টভাবে সাবধানই করলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, যেন রাশিয়া তার জবাব ঠিক করার আগে পরিণতি হিসেবে ভালোভাবে ভেবে নেয়।