মানুষের মধ্যে সারল্য বেশি নাকি প্যাঁচ বেশি- এ প্রশ্নের সহজ উত্তর আছে বলে মনে হয় না। আমাদের সমাজে সহজ-সরল মানুষ যেমন আছে, তেমনি আজে জটিল-কূটিল-ধুরন্ধর মানুষের অস্তিত্ব। সহজ-সরল মানুষরা নিরীহ বলে তারা সাধারণত অগোচরেই থেকে যায়। তাদের দ্বারা আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হই না বলে তাদের নিয়ে ভাবিও না। কিন্তু জটিল-কূটিল মানুষেরা অত্যন্ত বিপজ্জনক। তারা কারণে-অকারণে প্যাঁচ কষেণ। আরেকজনের সর্বনাশের ব্যাপারে সারাক্ষণ মাথা ঘামান।
এ জাতীয় লোকদের আমরা এড়াতে চাইলেও পাড়ি না। তাদের কূটিলতা বা প্যাঁচ আমাদের হাড়ে-হাড়ে বুঝিয়ে দেয় তাদের অস্তিত্ব ও উপস্থিতি। ব্যবহারগুণেই তারা ধন্য, বিশিষ্ট্য।
আপাতদৃষ্টিতে আমাদের সমাজে জটিল-কূটিল লোকের সংখ্যাই বেশি বলে মনে হয়। অবশ্য সব মানুষের মধ্যেই কম বেশি কূটিলতা ও সারল্য আছে। মানুষ আসলে এ দুইয়েরই সমন্বয়। সরল হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিও মাঝে মাঝে এমন প্যাঁচ কষেণ যে বিস্মিত হতে হয়। আবার আপাত ‘প্যাঁচুয়া’ মানুষও এমন সারল্য দেখান যে, তাজ্জব বনে যেতে হয়।
সারল্য ও ভালোমানুষি অবশ্য আমাদের জীবনে কোনো সমস্যা নয়; সমস্যা হচ্ছে কূটিলতা বা প্যাঁচ। কে যে কখন কার বিরুদ্ধে প্যাঁচ কষবেন, কার সর্বনাশ করবেন, তা আগে ভাগে কল্পনা করা যায় না। আর একবার প্যাঁচে পড়ে গেলে উদ্ধার পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। যারা প্যাঁচ কষেণ, তারা কিন্তু নিয়ম-নীতি আইনের ধার ধারেন না। নীতি-আদর্শ-আইন মেনে অবশ্য আরেক জনের ক্ষতি করা যায় না। বিপদগ্রস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে রক্ষা করার জন্য সমাজে আইন তৈরি করা হয়েছে। আইনের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা। যদিও আইন শেষ পর্যন্ত কূটিল লোকদেরই রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়ায়। দুর্বল বা বিপদগ্রস্তরা আইনের আশ্রয় নিয়ে সুবিচার পেয়েছে- এমন উদাহরণ বড় বেশি খুঁজে পাওয়া যায় না। এখানে একটা বড় ‘প্যাঁচ’ আছে। আইনের আশ্রয় নিতে হলে যে সব মানুষের সাহায্য নিতে হয়, তারাও কী এক অজ্ঞাত কারণে কূটিলতারই ক্রীড়নক হয়ে যান। পুরো প্রক্রিয়াটিই এত প্যাঁচালো যে সহজে এর জট খোলা যায় না। আর তাই সহজ-সরল ভালোমানুষেরা আইনের সুফল খুব একটা পান না। তাছাড়া আইন বা আইনের লোকেরাও খুব একটা সহজ-সরল নয়। আইন বিষয়টি যেমন অত্যন্ত জটিল; এর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা আরো জটিল। তাই তো আইন এবং আইনের আঙ্গিনা আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের কাছে প্রীতিকর না হয়ে ভীতিকর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
আইন নিয়ে যাদের কাজ-কারবার, তারা আসলে সারাক্ষণ এত জটিল-কূটিল বিষয় নিয়ে মাথা ঘামান যে, তাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত আর সহজ-সরল থাকতে পারেন না। যাক, এ বিষয়ে বেশি কথা না বলাই ভালো। আমরা কূটিল ব্যক্তিদের নিয়ে জটিল আলোচনায় না গিয়ে একটি সরল কাহিনীতে বরং ফিরে যাই। এই কাহিনীটিও অবশ্য কম বিপজ্জনক নয়। অনেকে অনেকভাবে এটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলেছেন, সরাসরি বলতে গেলে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। কাহিনীটি রয়ে-সয়ে সংক্ষিপ্তাকারে বলা যাক। স্বর্গ আর নরক, দুটি পাশাপাশি জায়গা। দু’জায়গার মধ্যে একটা বহু পুরনো পাঁচিল রয়েছে, তার অতিশয় ভগ্নদশা। সেই কবে সত্যযুগে সে প্রাচীর নির্মিত হয়েছিলো, অযুত-নিযুত বছর পরে আজ সে দেয়াল কোনো কাজে লাগছে না। মাঝে-মাঝেই নরকের দু-চারজন দুর্দান্ত অধিবাসী শান্তির স্বর্গে ঢুকে সেখানকার পবিত্র পরিবেশ তছনছ করে দিচ্ছে।
ঈশ্বর অবশেষে বাধ্য হয়ে শয়তানের সঙ্গে দেখা করলেন। শয়তান তো শয়তানই; সে বললো দেয়াল ভেঙে গেছে তাতে আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। যদি তোমার অসুবিধা হয় তুমি সারিয়ে নাও।
ঈশ্বর অনেক বোঝালেন শয়তানকে; কিন্তু শয়তান নাছোরবান্দা। সে কিছুতেই রাজি হলো না দেয়াল সারাতে। সে ঈশ্বরের অনুরোধে মোটেও কর্ণপাত করলো না।
মহামহিম ঈশ্বর আর কী করেন, নিজের খরচেই দেয়াল সারালেন। তবে সারানোর সময় শয়তানকে বললেন, দেখো এবার আমি সারালাম বটে, কিন্তু ভুলে যেও না এটা দু’জায়গার মধ্যে কমন ওয়াল। তোমার দায়িত্ব ফিফটি-ফিফটি, সমান-সমান। এর পরের বার সারানোর দায় তোমার।
এদিকে কিন্তু দেয়াল বানানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দুর্দান্ত নারকীরা আবার দেয়াল ভেঙে ফেলল। যারা স্বর্গের কিন্নরী আর সোমরসের আস্বাদ পেয়েছে, তারা আবার স্বর্গে যথেচ্ছাচার শুরু করে দিলো।
ঈশ্বর এবার মরিয়া হয়ে অনেক দেনদরবার করে শয়তানকে গিয়ে ধরলেন। সবাই বললো শয়তানকে, আগেরবার ঈশ্বর দেয়াল সারিয়েছে, এবার তুমি সারাবে। আর দেখবে যেনো এরকম আর না হয়। তোমার লোকেরা যেনো স্বর্গে ট্রেসপাস না করে।
সবার চাপে পড়ে শয়তান বললো, এখন তার হাতে টাকা নেই। দেয়াল সে সারাতে পারছে না, তবে ঈশর¦ যদি দেয়াল সারিয়ে নেয় আর আবার যদি কখনো দেয়াল ভেঙে যায়, সে তখন দেখবে। তাছাড়া নরকের দু’চারজন যদি মাঝে-মধ্যে স্বর্গে যায়, তাতে আপত্তির কী থাকতে পারে!
ঈশর যদি স্বর্গের দু’চারজনকে নরকে বেড়াতে পাঠান, সে তাতে মোটেও আপত্তি করবে না। শয়তানের শয়তানি ধরতে কারো কোনো কষ্ট হলো না। বেশি আলোচনার মধ্যে না গিয়ে শয়তানের সঙ্গে ঈশ্বর রফা করলেন যে, এবারো তিনি দেয়াল সারিয়ে নেবেন তবে এরপর দেয়াল ভাঙ্গলে শয়তানকে তা সারাতে হবে।
শয়তানের মুখের কথার বিশ্বাস নেই। তাই ঈশ্বর শয়তানের সাঙ্গে রীতি মত লিখিত চুক্তি করলেন এবং সেই চুক্তিপত্রে দুজনেরই স্বাক্ষর রইলো।
বলা বাহুল্য, অল্পদিনের মধ্যেই নরকের সেই পাঁজি অধিবাসীরা আবার স্বর্গ-নরকের দেয়াল ভেঙে স্বর্গে ঢুকে গোলমাল করতে লাগলো। এবার ঈশ্বর গিয়ে শয়তারকে ধরলেন, চুক্তির কথা মনে আছে তো, এবার তোমাকে সারাতে হবে।
শয়তার বললো, চুক্তি! কিসের চুক্তি? ঈশ্বর স্বর্গের দপ্তর থেকে সেই চুক্তিনামা নিয়ে এলেন, এনে শয়তানকে দেখালেন। এই দেখো চুক্তি। এই সেদিন তুমি সই করে চুক্তি করলে, আর এখন বলছো কিসের চুক্তি?
শয়তান নির্বিকারভাবে বললো, কবে কী করেছিলাম জানি না। এসব চুক্তি আমি মানি না।
ঈশ্বর রেগে গিয়ে বললেন ঠিক আছে। তা-ই যদি বলো, আমি এই দলিল নিয়ে আদালতে যাচ্ছি, তোমার নামে মামলা করবো।
শয়তান মুচকি হেসে বললো, তা যাও আদালতে সেখানে কোনো সুবিধা হবে না। ঈশ্বর থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, কেনো?
শয়তান বললো, মামলা যে করবে উকিল পাবে কোথায়? তুমি কি মনে করো তাদের কেউ তোমার পক্ষ নেবে? তোমার পক্ষে ওখানে কি তেমন কেউ আছে?
ঈশ্বর অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তিনি সবই বুঝলেন এবং শয়তানের বিরুদ্ধে কোন মামলা করলেন না।
স্বর্গ এখন অবারিত-দ্বার, ভাঙ্গা দেয়াল আরো ভেঙ্গেছে। আর সেই দেয়ালের ফাঁক দিয়ে নরকের অধিবাসীরা নিয়ত স্বর্গে যাতায়াত করছে, নন্দন কাননে গিয়ে ফূর্তি পর্যন্ত করছে!
লেখকের ফুটনোট : এ কাহিনীটি পুরোপুরি কাল্পনিক। এর সঙ্গে যদি কেউ বাস্তবের কোনো চরিত্রের মিল খোঁজার চেষ্টা করেন, সেজন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)