মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের এক মাস যেতে না যেতেই যুক্তরাষ্ট্র সফর করলেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু। আর দু’জনের বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনেই ট্রাম্প জানালেন ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন নিয়ে আমেরিকার দীর্ঘদিনের নীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সঙ্কট সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক দশক ধরে সমর্থিত ‘দুই-দেশ নীতি’ থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন ট্রাম্প। সংবাদ সম্মেলনে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সমঝোতার শর্ত রেখে দেশ দু’টির জন্য একটি ‘চমৎকার’ শান্তিচুক্তি তৈরিরও প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
দুই দেশকেই ছাড় দেয়ার কথা বললেও ‘দুই-দেশ নীতি’র প্রতি সমর্থন তুলে নিয়ে ট্রাম্প মূলত ইসরায়েলের দিকে একটু ঝুঁকে যাওয়ার ইঙ্গিত দিলেন। প্রথমত, বরাবরই ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনকে দু’টো আলাদা দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া এই নীতির বিরোধিতা করে এসেছে শুধু ইসরায়েল সরকার। অথচ ফিলিস্তিন, এমনকি সাবেক ওবামা সরকার, এমনকি জাতিসংঘও এর পক্ষে। এ কারণে বারবার ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি আলোচনা ব্যাহত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, শুধু ইসরায়েলের সরকার প্রধানের সঙ্গে কথা বলে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন ট্রাম্প। অথচ ফিলিস্তিনের বক্তব্য নেননি তিনি। তাই দুই দেশ নীতি বাতিল করে ট্রাম্প কীভাবে একটি ‘গ্রেট’ শান্তিচুক্তি উপহার দেবেন, সেটি এখন একটি বড় প্রশ্ন।
টানা আট বছরের ওবামা প্রশাসনের পুরোটা সময়ই ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ছিল খিটমিটে সম্পর্ক। সিএনএন তার প্রতিবেদনে লিখেছে, নেতানিয়াহু আমেরিকা-ইসরাইল রোমান্সকে পুনরুজ্জীবিত করতে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেছেন। বলার ঢং রসিকতাপূর্ণ হলেও কথাটা মিথ্যে নয়। অন্তত বৈঠকের পর ট্রাম্প-নেতানিয়াহু যৌথ সংবাদ সম্মেলনে দু’জনের বক্তব্যে তাই মনে হয়েছে।
দখল করা ভূমিতে ইসরায়েলের অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে এর আগে জাতিসংঘে প্রস্তাব পাস হয়। এমনকি এ ব্যাপারে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভোটাভুটিতে হেরে নেতানিয়াহু তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে তুলোধুনো করেন। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে দেয়া ওবামা সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির বক্তব্যকে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ও বলেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী।
অথচ ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকার গঠনের পর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে ৪ হাজার ইহুদি বসতি স্থাপনকারীর বাড়িঘর তৈরিকে বৈধতা দেয়া একটি বিতর্কিত আইন পাশ করে ইসরাইলের পার্লামেন্ট। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে না গিয়ে গত সংবাদ সম্মেলনে সংবাদ সম্মেলনে তিনি ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে নতুন ইহুদি বসতি স্থাপন কার্যক্রম থেকে কিছুটা ক্ষান্ত হতে নেতানিয়াহুকে অনুরোধ জানান।
মার্কিন গণমাধ্যম দ্য নেশন তার এক বিশ্লেষণে বলে, যদিও তারা ভিন্ন ভিন্ন নৃতাত্ত্বিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে এসেছেন, রাজনৈতিক দিক থেকে বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে রয়েছে যথেষ্ট মিল। দু’জনেই এমন দু’টি সরকারের প্রধান, যেগুলোর নিয়ন্ত্রণ তারা নিয়েও নিতে পারছেন না। দেশ দু’টোর সরকারের ওপর রয়েছে ডানপন্থি শক্তির ব্যাপক প্রভাব।
এই শক্তি আইনের শাসন তো দূর, প্রকৃতির বিধানেরও তোয়াক্কা খুব একটা করে না আর এর সদস্যরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় উচ্চশক্তির কাছেই শুধু জবাবদিহি করে। সেই শক্তিগুলোর অবস্থান ট্রাম্প আর নেতানিয়াহুর নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাই এই ডানপন্থি শক্তির হাতে তারা অনেকটাই জিম্মি।
কিন্তু শুধু দুর্বলতা নয়, একটি যোগ্যতার দিক থেকে মিলও আছে ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর মধ্যে, যার ধারে-কাছেও নেই তাদের অন্যান্য শত্রু-মিত্র বা বন্ধুর নামে শত্রুরা। সেটি হলো গণমাধ্যমকে নিজের পক্ষে ব্যবহার করার ক্ষমতা – সরকারের সৈন্য হিসেবে গণমাধ্যমকে যুদ্ধের ময়দানে নামানো।
ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর এই ক্ষমতা আর পারস্পরিক রাজনৈতিক মিলকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের রোমান্স আবার চাঙ্গা হওয়ারই লক্ষণ দেখা গেল দু’জনের সংবাদ সম্মেলনে। তবে নেতানিয়াহুর এই যুক্তরাষ্ট্র সফর ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নবগঠিত সরকার প্রধানের যে নরম দৃষ্টির ইঙ্গিত দিচ্ছে তা ফিলিস্তিনের জন্য কী ভবিষ্যৎ বয়ে নিয়ে আসবে আর সেটি আন্তর্জাতিক মহলের সিদ্ধান্তের সম্মান কতটা রাখবে, তা সময়ই বলে দেবে।