ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় কমানো, ঋণের গুণগত মান উন্নয়ন, নতুন পণ্যের উদ্ভাবন এবং যৌক্তিক মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করলে সুদহার কমানো সম্ভব। এতে অর্থনৈতিক সূচকের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক হবে। তবে সুদ হার না কমার অন্যতম কারণ খেলাপি ঋণ।
মঙ্গলবার রাজধানীর মিরপুরে বিআইবিএম অডিটোরিয়ামে ‘ইন্টারেস্ট রেট অ্যান্ড এক্সপানশান অব ব্যাংক ক্রেডিট’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
গোলটেবিল বৈঠকে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিআইবিএমের অধ্যাপক মো. নেহাল আহমেদ।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সাল শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট খেলাপি ঋণ ছিল ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। যা ব্যাংকিং খাতের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর পরিচালন আয় থেকে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয়। কিন্তু অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকগুলো প্রভিশন রাখতেও ব্যর্থ হচ্ছে। এসব কারণেই হাজার চেষ্টার পরেও ঋণ বিতরণ বাড়ানো যাচ্ছে না।
অন্যদিকে দিন দিন কমে যাচ্ছে ব্যাংকের আমানতের পরিমাণও। যা বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে তীব্র তারল্য সংকটের তৈরি করেছে।
গবেষণাপত্রে পরামর্শ দিয়ে বলা হয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশে খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য রাষ্ট্রীয় মালিকানায় অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সরকার এ ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। যা খেলাপি ঋণকে নিয়ন্ত্রণ এবং সুদহার কমাতে সহায়তা করবে।
গবেষণাপত্রে নেহাল আহমেদ বলেন, ঋণ গ্রহীতারদের উচ্চসুদহার ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বড় বাঁধা। যা ঋণ পরিশোধে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। উপরন্তু উচ্চ সুদের কারণে পণ্য উৎপাদনে খরচ বাড়ার কারণে রপ্তানিমুখী শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সুতরাং ঋণের সুদহার যৌক্তিক পর্যায়ে আসা দরকার।
বৈঠকে শীর্ষ ব্যাংকাররা বলেন, ক্রমাগতভাবে আয় বাড়ানোর নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করছে ব্যাংক। সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যাংকাররা মরিয়া হয়ে ঋণ বিতরণ করছেন। ফলে পদদলিত হচ্ছে গুণগত ঋণ বিতরণের প্রথা। সে কারণেই বাড়ছে খেলাপি ঋণ, পাশাপাশি বাড়ছে ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকিও।
তারা বলেন, ব্যাংকের পণ্যে বৈচিত্র্য আনা দরকার। কারণ বহুদিন থেকে একই ধরনের পণ্য নিয়ে ব্যবসা করছে ব্যাংকগুলো। ব্যবসা বাড়াতে পণ্যগুলোর বিস্তার এবং নতুন নতুন গ্রাহক তৈরির বিকল্প নেই। ঢাকা শহরের বাড়ি ভাড়া যদি ব্যাংক চেকের মাধ্যমে প্রদান করা যায় তবে নতুন করে আরো একটি প্রোডাক্ট তৈরি হবে বলে মতামত ব্যক্ত করেন ব্যাংকাররা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিআইবিএমের মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মহা. নাজিমুদ্দিন বলেন, সুদহার কম থাকলে বিনিয়োগে গতি বাড়ে। ভিশন-২০৪১, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং ডেল্টা প্ল্যানের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সুদের হার কমিয়ে আনতে হবে। যাতে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হয়।
পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক হেলাল আহমদ চৌধুরী বলেন, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অসম প্রতিযোগিতা অনেক সময় বিপদ ডেকে আনছে। এটি দ্রুত বন্ধ করতে হবে। ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদকেই বিষয়টি দেখভাল করতে হবে। অনেকে সঞ্চয়পত্রের সুদের হারের কারণে ব্যাংক সুদ কমানো সম্ভব হচ্ছে না দাবি করেন। গবেষণায় প্রমাণিত সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ব্যাংক ঋণের সুদে তেমন কোন প্রভাব পড়ে না। সামাজিক নিরাপত্তায় সঞ্চয়পত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তিনি বলেন, ব্যাংকের ট্রেজারি ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু হলে ব্যাংক তারল্য সংকটের মধ্যে পড়ে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ইয়াছিন আলি বলেন, ব্যাংকের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে খেলাপি ঋণ কমাতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পুরো ব্যাংকিং খাতকে খেলাপি সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নেপাল এবং চীনে ঋণ খেলাপিরা ট্রেন এবং বিমানের টিকেট কিনতে পারেন না। এ ধরণের উদ্যোগ বাংলাদেশেও নেয়া যেতে পারে।