সকাল থেকে তাড়াহুড়া চলছে, সংবাদ সম্মেলনে যেতে হবে। ভারতে হেনরি কিসিঞ্জার এসেছে। জেপি মর্গ্যান ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিলের বৈঠকে যোগ দিতে। ৯৬ বছরের বৃদ্ধ হলেও পুরো প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে ঘোরাফেরা করেন। আজকের সংবাদ সম্মেলনে তাকে একটা প্রশ্ন করতেই হবে, অনেক দিনের শখ। হাতের এতো কাছে উনি যে অস্থিরতায় সব কাজে প্যাঁচ লেগে দেরি হচ্ছে।
দিল্লির সাত নম্বর জনকল্যাণ মার্গের বাংলোর লনে সংবাদ সম্মেলন, ভারতীয় সাংবাদিকের পাশাপাশি অন্যান্য দেশের সাংবাদিকে লনের চেয়ারগুলি ভর্তি। নিজের নির্ধারিত আসনে বসতেই দেখি টোনি ব্লেয়ার, কন্ডোলিজা রাইস, জন হাওয়ার্ড, রবার্ট গেটস, মোদীজি ও হেনরি কিসিঞ্জার এগিয়ে আসছে উনাদের নির্ধারিত আসলের দিকে। ধীর কিন্ত দীপ্ত পদভারে এগিয়ে এসে বসলেন হেনরি কিসিঞ্জার।
অধিকাংশ মানুষই জানেন হেনরি কিসিঞ্জারকে তারপরও উনার একটু পরিচয় দিতেই হয়। যদিও কিসিঞ্জার – মার্কিন কূটনীতিক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে যার বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকার কথা কারও অজানা নয়।
কুখ্যাত ‘নিক্সন টেপে’ তো হেনরি কিসিঞ্জারকে বলতে শোনা গিয়েছিল ভারতীয়রা ‘সাচ বাস্টার্ডস’ (এত বড় বেজম্মা), আর ইন্দিরা গান্ধী একজন ‘বিচ’!
একাত্তর সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের চালানো গণহত্যাকেও প্রচ্ছন্ন সমর্থন করে স্বাধীন বাংলাদেশেও তার পরিচয় এক নিন্দিত চরিত্রের।
আর সেই তিনি আমাদের বাংলাদেশকে একদা ‘বটমলেস বাস্কেট’ বা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে কিসিঞ্জারের বর্ণনা তো প্রায় লোকগাথায় পরিণত!
কাম্বোডিয়ায় বেআইনিভাবে বোমা ফেলে গণহত্যা থেকে চিলিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে উৎখাত – এমন বহু ঘটনায় বারে বারে নাম জড়িয়েছে কিসিঞ্জারের।
শীতল যুদ্ধের সময়কার ‘রিয়ালপলিটিকে’র মূর্ত প্রতীক বলেও তাঁকে মনে করেন অনেকেই।
১৯৭৩ সালে এহেন বিতর্কিত হেনরি কিসিঞ্জার ও লে ডাক থো যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। জানুয়ারি, ১৯৭৩ সালে উত্তর ভিয়েতনাম ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার যুদ্ধ বিরতি এবং সেখান থেকে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের প্রেক্ষাপটে তাকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। কিন্তু লে ডাক থো পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান কেননা তখনো যুদ্ধ চলছিল। কিন্তু তাদেরকে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদানের ফলে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হয়। এরফলে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির দুইজন সদস্য পদত্যাগ করেন। কিন্তু যখন এ পুরস্কারের বিষয়টি ঘোষিত হয়, তখনও উভয় পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা অব্যাহত ছিল। অনেক সমালোচকদের অভিমত, কিসিঞ্জার শান্তি প্রণেতা ছিলেন না; বরঞ্চ যুদ্ধের ব্যাপক প্রসারে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখেছিলেন।
সেই হেনরি কিসিঞ্জার আজ চোখের সামনে। মোদিজির কানে কানে কি যেন বললেন তিনি, এতে দুইজনেই হেসে ওঠেন। প্রধানমন্ত্রীকে দেখে মনে হল না, যে উনি ভারতীয় ও ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে কি উক্তি করেছিলেন তা মনে রেখেছেন।
অধীর হয়ে অপেক্ষা করে চলেছি আমার প্রশ্ন করার পালার আসার জন্য।
১২জনের প্রশ্ন-উত্তর পালা শেষ হতেই আমার সুযোগ আসল প্রশ্ন করার।
রাত জেগে দেশের অর্থনীতি অবস্থা, জিডিপি নিয়ে পড়াশনা করেছি যাতে ব্যাকগ্রাউন্ড ইনফরমেশনে কোন ভুলচুক না করি।
নিজের পরিচয় দিয়ে উনাকে প্রশ্ন করি মিস্টার কিসিঞ্জার, বাংলাদেশকে নিশ্চয় মনে আছে?
আহা! বাংলাদেশ নামটা শুনেই হাসি হাসি মুখটা কেমন গম্ভীর হয়ে গেল।
আপনি একদা বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলেন।
উনি উত্তর দিলেন ‘বিশেষ সময়ের এক পরিস্থিতিতে এ কথা বলেছিলাম।
আমি আবারো প্রশ্ন করি আজকের বাংলাদেশকে দেখে আপনি কি কেমন বোধ করেন? লজ্জিত কিনা বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলার জন্য?
উনি টেবিলের দিকে একটু ঝুকে এসে আরো গম্ভীর গলায় বললেন, তোমার দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হয়েছিল বিশেষ পরিস্থিতিতে, আর তলাবিহীন ঝুড়ির অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এমন একটি দেশ, যে দেশকে যাই দেওয়া হোক না কেন, তা থাকবে না। সেই ঝুড়িতে কোনো কিছুই ধরে রাখা যায় না, রাখলেই তলা দিয়ে পড়ে যায়। বিদেশি সাহায্য দেওয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে এ কথাটি বলা। অর্থাৎ বাংলাদেশকে যতই সাহায্য দেওয়া হবে, তা কোনো কাজে আসবে না। তারপরও সাহায্য দিয়ে বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখতে হবে। ৭২ সালে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সেই রকম ছিল বলেই বলা। আর বাস্কেট কেস কথাটা প্রথমে আমি বলিনি, বলেছিল উরাল এলেক্সিস জনসন, তৎকালীন আন্ডার-সেক্রেটারি অব স্টেট।
ধন্যবাদ দিয়ে মাইকটা পাশের জনকে দেয়ার আগেই উনি আমাকে বললেন, এবার আমি তোমাকে প্রশ্ন করি? অবাক হলাম আমাকে কেন প্রশ্ন করবেন? আর কি প্রশ্নই বা করবেন? ৯৬ বছরের বৃদ্ধ হলেও হাতটাত কাঁপে না। গলাও বেশ বলিষ্ঠ।
হেনরি কিসিঞ্জার উলটো আমাকেই প্রশ্ন করলেন, তোমাদের বাংলাদেশকে আমি বিশেষ পরিস্থিতে বাস্কেট কেস বলেছিলাম। কিন্তু এখন আমার মনে এখন তিনটা নাম এসেছে তোমাদের দেশকে বিশেষিত করার, হেল্প করো কোনটা বেশি মানানসই, “বাস্কেট অফ লুঠেরাস” বলব নাকি “ল্যান্ড অফ করাপশন” বলবো নাকি “সুইটেবল কান্ট্রি অফ মানি হেইস্ট” বলবো?
ওরে বাবা বলে কি? কিসিঞ্জার সাহেব ত পুরো ডিফেন্সে খেলছে।
তোমাদের তলা বিহীন দেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে দৌড়ে চলেছে। কিন্তু সেই সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছে দুর্নীতি, অনিয়ম, অনাচার, বেআইনি কারবার। কেউ দেখার নেই। কারণ ব্যস্ত লুটপাটে। সংবাদ মাধ্যমে চোখ রাখলেই পাওয়া যায়, তহবিল তসরুফের খবর, ব্যাংক লুট, বিভিন্নভাবে অর্থ লুটের সংবাদ। হাজার কোটির নীচে কোন লুটপাট নেই। মুষ্টিমেয় সৎ অফিসাররা সততার সাথে কাজ করলেও কিন্তু অধিকাংশ নিয়োজিত অবৈধভাবে জনগণের অর্থ লুট করে বিত্তশালী হতে। বিদেশী ব্যাংকে টাকার পাহাড় গড়তে।
তোমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেকে ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়ে, তোমার দেশের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে কাতারে এনেছেন ঠিকই কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের তলা কাটছে তোমার দেশের একদল মানুষ যা কেউ দেখছে না। ধারাল দাঁতাল ধেড়ে ইঁদুরের মত ঝুড়ি ফুটো করে অবিরাম খেয়ে চলেছে। ইঁদুরের পেট ভরে গেলে থামে কিন্তু তোমাদের দেশের সেই ক্ষমতাবান মানুষরূপী ধেড়ে ইঁদুরগুলির পেট কোন কিছুতেই ভরছে না। তারা ঝুড়ির তলা কেটে খেয়ে চলেছে তো চলেছেই। তোমাদের দেশে কি আইন নেই, নিয়ম নেই নীতি নেই, তোমার দেশ বিশ্বের অন্যতম ঘন বসতিপূর্ণ দেশ, ময়লা আবর্জনায় হাঁটাচলা দায়, দিনদুপুরে জন সমক্ষে হত্যা লুট, এমনকি ক্ষমতাবান সহায়তায় ধর্ষণের মত ঘৃন্য অপরাধ সংঘটিত হয়, গণপিটুনির মত জঘন্য কাজ তোমাদের দেশে ঘটে থাকে হরহামেশা, আইন নিরব থাকে। নারীর নিরাপ্ততা নেই, ঘরে, রাস্তায় অফিসে, স্কুলে, মন্দিরে মসজিদে, দুর্নীতিতে তোমরা চাম্পিয়ান হচ্ছো। তোমাদের দেশে একজন চতুর্থশ্রেণির কর্মচারী শত কোটি টাকার মালিক ভেবে বল তো কি তোমরা নিজেরাই তো নিজেদের কে তলাবিহীন ঝুড়ি বানাচ্ছো কিনা। দুনিয়ার বুকে দুর্নীতিবাজ বলে নাম লেখাচ্ছো কিনা। আমাদের আর কষ্ট করে কিছু বলতে হবে না, তোমাদের দেশ তোমাদের হাতেই ধ্বংস হচ্ছে। তোমরা দেশকে ভালবাসো না, বাসলে নিজের দেশের লোকসান ও ক্ষতি করে, সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপাল প্রজেক্ট পাশ করতে না। তোমাদের দেশের স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি তো আরব্যরজনীর গল্পকেও হার মানায়। গুম, খুন, ইচ্ছে হলেই মামলা দেয়া, তোমাদের দেশের সব মন্ত্রণালয় দুর্নীতিতে ভারাক্রান্ত। বাংলাদেশের নারীরা মিডিলইস্টে যায় কাজ করতে, সেখানে তাদের উপর অন্যায় অত্যাচার হয়, রেপ হয়, খুন হয় কিন্তু তোমার দেশ তা নিয়ে উচ্চবাচ্য করে না। তোমাদের দেশের মানুষ ওইসব দেশে শ্রমিক হয়ে যায়, যাদের পশুর মত ট্রিট করে। তোমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সে ব্যাপারে মুখ সেলাই করে রাখে। এসব নিয়ে কিছু বলবে বা করবে কি অন্য কেউ কিছু বলবে কি, তোমরাই তোমাদের দেশকে শেষ করে ফেলছোস। তোমার দেশে রাজনীতি করতে আসে মানুষ সর্ট টার্মে বিত্তবান হতে, দেশকে ভালবেসে, দেশের উন্নয়নের জন্য কেউ একটুও কাজ করে না, তোমাদের প্রধানমন্ত্রী একা উন্নয়ন করছে কিন্তু সেই উন্নয়নের ফসল কেউ কি তোমরা ভোগ করতে পারছো? পারছো না কারন তোমাদের দেশে সুশাসন নেই, টেকসই সুশাসন দরকার। কিন্তু এই নিয়ে কেউ কি ভাবছে……….. ওহ দেখ দেখ আজকের পত্রিকায় কি লেখেছে শিশু ধর্ষণ!, দেখ ধর্ষণ সব দেশে কম বেশি আছে কিন্তু ধর্ষকদের বিরুদ্ধে তোমাদের আইন কতটা কার্যকর হচ্ছে দেখ। কমার বদলে রোজ বাড়ছে ধর্ষণ। পাকিস্তানীরা যা করতে পারেনি, তোমাদের স্বাধীনদেশে তাই হচ্ছে। মৌলবাদে নিমরজিত হচ্ছ। আর তোমাদের দেশের জাতির পিতাকে বাইরে থেকে এসে কেউ হত্যা করেনি তোমরাই করেছো…… আরো কি কি যেন উনি বলেই যাচ্ছেন আমার কান ভোঁ ভোঁ করছে, ইস কেউ কি থামাবে উনাকে……
কিন্তু হেনরি কিসিঞ্জার চোখমুখ লাল করে বলেই যাচ্ছে বলেই যাচ্ছে, উপস্থিত বাকি সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে, সবার দৃষ্টিতে করুণা আর উপহাস ঝরছে, তাদের দিকে না তাকিয়েও বেশ বুঝতে পারছি। লজ্জায় মাথা নত হয়ে যাচ্ছে চোখ তুলে তাকাতে পারছি না, হাত পায়ের তালু ঘেমে ভিজে যাচ্ছে। চারদিকে মনে হচ্ছে কোন বাতাস নেই। উফ নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে উফ একটু বাতাস, একটু বাতাস চাই………
ওদিকে হেনরি কিসিঞ্জার মাইক হাতে গ্যাক গ্যাক করে দেশের বদনাম করেই যাছে। আমি একটু বাতাসের জন্য মরিয়া হয়ে চিৎকার করে উঠি।
ও মা চারদিক দেখি অন্ধকার! সেকি অন্ধ হয়ে গেলাম নাকি, ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল। অন্ধকার চোখে সইতেই দেখি এতো আমার ঘর। ঘড়িতে ভোর পৌনে চারটা বাজে। কোথায় সংবাদ সম্মেলন আর কোথায় হেনরি কিসিঞ্জার আর কোথায় বাকি লোকজন? মাথা পরিস্কার হতেই বুঝলাম গতরাতে আমাজন প্রাইমে The Trials of Henry Kissinger ডকুমেন্টারি দেখার ফল হিসেবে দুঃস্বপ্ন দেখেছি।
ঘুম আর ফেরত না আসলেও, ভাবনা আসলো, আসলেই তো কিসিঞ্জার তো মিথ্যে কিছু বলেনি। এই দুর্নীতি, ধর্ষণ, লুঠ, অপচয়, অন্যায় অবিচার না জানি কবে বন্ধ হবে। আবার না জানি বিদেশী রাষ্ট্রের কাছে হাত না পাততে হয়। সত্যি সত্যি না আবার তলা বিহীন ঝুড়িতে ফেরত না যায়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)