চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

কিংব্যাক মুন্নাকে আমরা কতোটা মনে রেখেছি

আজ ১২ ফেব্রুয়ারি। ‘কিংব্যাক’ খ্যাত ফুটবলার মোনেম মুন্নার প্রয়াণের এক যুগপূর্তি। ২০০৫ সালের এইদিনে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে কিংবদন্তী মুন্না সবাইকে চোখের জলে ভাসিয়ে চিরবিদায় নেন। এত অল্পবয়সে তাঁর চিরবিদায়ে ক্রীড়াঙ্গনে সেদিন নেমে এসেছিল বিষাদের ছায়া। মুন্নার অকাল বিদায়ে সেদিন ফুটবলাঙ্গনে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল বলতে দ্বিধা নেই সেই শূন্যতা একটুও পূরণ হয়নি। উল্টো ফুটবলের বর্তমান দুর্দিন আর দুঃসময়ে তাঁকে যেনো বারবার ভীষণরকম মনে পড়ে।

ক্রীড়ামোদীদের কাছে এখনও ফুটবলার মুন্না ভীষণরকম উজ্জ্বল এবং আত্মপ্রত্যয়ী এক নাম। তাঁর খেলার ধারই ছিল আলাদা। আর তাই স্টপার পজিশনে খেলেও যিনি সর্বসাধারণের মাঝে তুমুলভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। মাঠে শুধু চোখ ধাঁধানো নৈপুণ্য নয়, একই সাথে দক্ষ নেতৃত্ব এবং দুর্দান্ত পেশাদারিত্ব প্রদর্শন করে রীতিমতো ‘ফুটবল আইকনে’ পরিণত হয়েছিলেন। ফুটবল সমনে পরবর্তীতে তাঁর মতো আর কেউ আসেনি। এ কারণেই দক্ষিণ এশিয়ার এক সেরা ফুটবলার হিসেবে খ্যাত ছিলেন তিনি। খেলা থেকে অবসর নেওয়ার পর ফুটবলকেই পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। আর তাই প্রিয় ক্লাব আবাহনীরই দায়দায়িত্ব নিয়েছিলেন ম্যানেজার হিসেবে। কিন্তু কিডনি রোগে আক্রান্ত হলে সহসাই মুন্নার জীবনে বেঁচে থাকার এক নতুন যুদ্ধ শুরু হয়। নিজ বোনের দেওয়া কিডনি তাঁর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হলেও মৃত্যুর কাছে তাঁকে হার মানতে হয়। অতঃপর ২০০৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মুন্না অধ্যায়ের এক করুণ সমাপ্তি ঘটে। আশির দশকের শেষ লগ্ন এবং নব্বই দশক জুড়ে এ দেশের ফুটবলাঙ্গন ছিল মুন্নাময়। ফুটবলাঙ্গনে বেশি পারিশ্রমিক তাঁর চেয়ে আর কেউ পায়নি। ঢাকার মাঠের সবচেয়ে দামি ফুটবলারও ছিলেন মুন্না। কলকাতার মাঠেও ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলে দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তিনি মাঠে যেমন নিজে খেলতেন তেমনি সতীর্থদেরও নেতৃত্ব দিয়ে খেলাতেন। আবাহনী এবং জাতীয় ফুটবল দলকে বিভিন্ন সময় নেতৃত্ব দিয়ে একাই টেনে নিয়ে গেছেন সর্বোচ্চ উচ্চতায়। ৯৫ সালে তারই নেতৃত্বে মায়ানমারে অনুষ্ঠিত চার জাতি কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশের বাইরে প্রথম বাংলাদেশ কোন ট্রফি জেতার অনন্য কৃতিত্ব দেখিয়েছিল। এই টুর্নামেন্টে মুন্নার একক পারফরমেন্স ছিল দেখার মতো। একথা সত্য যে, মুন্না যতদিন মাঠে ছিলেন সেসময় ঢাকার মাঠে যত বড় স্ট্রাইকারের আবির্ভাবই ঘটুক না কেন মুন্নাকে সমীহ করতেই হয়েছে। মুন্নাকে ভেদ অথবা পরাস্ত করে জালে বল প্রবেশ করানোটা কোন স্ট্রাইকারের কাছেই সহজ কাজ ছিল না। আবার মুন্নার সময়ে বাংলাদেশে যত বিদেশী কোচ এসেছেন সবাই মুন্নার খেলার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। সোয়াব, অটোফিস্টার-মুন্নার প্রশংসা না করে পারেনি।

১৯৮৯ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে মোনেম মুন্না (দাঁড়ানো বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়)

আবাহনী ক্রীড়া চক্রের সঙ্গে মুন্নার ছিল অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। আর তাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি নিজেকে বেঁধে রেখেছিলেন এই ক্লাবের সঙ্গে। অনেকেরই হয়ত মনে হয়েছে নব্বই-এর গণভ্যুত্থানের পর একবার দেশের সেরা সব ফুটবলার চড়া দামে মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া সংসদ চক্র ক্লাবে নাম লেখালেও সে সময় মুন্না একাই আবাহনীতেই থেকে যান, তিনি আবাহনী ছেড়ে যাননি। এবং সেবছর মুন্না একাই একদল তরুণ ফুটবলারদেরকে সাথে নিয়ে আবাহনীর আত্মমর্যাদা সমুন্নত রেখেছিলেন। শুধু আবাহনীই নয়, মুন্না যতদিন মাঠে ছিলেন ততদিন দেশের জন্যেও নিজেকে উজাড় করে খেলেছেন। সবসময়ই নিজের সর্বোচ্চটুকু দেশের জন্য দিতে সচেষ্ট থেকেছেন।

৮০-৮১ সালে পাইনিওর লীগে নাম লেখানোর মধ্যে দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে অভিষেক ঘটেছিল মুন্নার। পরের মৌসুম শান্তিনগরে খেলার পর মুন্না যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাবে। তার নৈপূণ্যেই মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। বলা যায় এ সময়ই মুন্না কর্মকর্তাদের নজর কাড়তে সক্ষম হন। এরই ধারাবাহিকতায় ৮৬ সালে ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের হয়ে দুর্দান্ত পারফর্ম করে সবার নজর কাড়েন। এসময়ই আবাহনী কর্মকর্তাদের নজরে পড়েন তিনি। পরের মৌসুমেই মুন্না যোগ দেন আবাহনী ক্রীড়া চক্রে। তখন আবাহনীর হয়ে খেলে যারা জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-আশরাফ উদ্দিন চুন্নু, গোলাম রাব্বানী হেলাল, ইমতিয়াজ সুলতান জনি, খোরশেদ বাবুল, আব্দুল গাফফারসহ অন্যরা। তরুণ ফুটবলার মুন্না এসে এই অভিজ্ঞদের মাঝে নিজের জায়গা করে নেন। এরপর মুন্নাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। যেখানেই মুন্না পা রেখেছেন সেখানেই সাফল্য এসে ধরা দিয়েছে। একটানা ৯৭ সাল পর্যন্ত আবাহনীতে খেলেন তিনি। আবাহনীর হয়েই ফুটবলের বর্ণাঢ্য জীবন ছেড়ে অবসরে যান। তবে ফুটবল খেলা ছাড়লেও মুন্না কর্মকর্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন সহসাই। আবাহনীর ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মৃত্যু অবধি। সর্বশেষ আবাহনী মাঠেই তার শেষ জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।

মুন্নার খেলোয়াড়ি জীবন শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও ছিল বড্ড আলোকময়। আবাহনীর হয়ে যেমন দাপটের সাথে খেলেছেন তেমনি কলকাতা ফুটবল লীগেও টানা তিন বছর খেলে সমান দারুণভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ৯১ সালে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কোচ নাইমুদ্দিনই প্রথম মুন্নাকে প্রস্তাব দিয়ে কলকাতা লীগে খেলার সুযোগ করে দেন। কলকাতা লীগে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে মুন্না লিবেরো পজিশনে খেলে দারুণ আলোড়ন তোলেন এবং সহসাই বাংলাদেশের মতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। জাতীয় দলের হয়ে মুন্না প্রথম খেলার সুযোগ পান ৮৬ সালে। সে বছর সিউলে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসের জন্য নির্বাচিত দলে তিনি প্রথমবারের মতো ডাক পান। তারপর দাপটের সাথে খেলেন ৯৭ সাল পর্যন্ত।


সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফুটবলার মুন্না যেনো সবচেয়ে কাছের মানুষদের স্মৃতিপট থেকে মুছে যেতে শুরু করেছে। কেউ আর এখন মুন্না পরিবারের তেমন খোঁজখবর রাখেন বলে মনে হয় না। মুন্নার পরিবারও তাই খানিকটা আড়ালে আবডালে চলে গেছে বললে ভুল হবে না। রাজধানীর রায়েরবাজারে মুন্নার রেখে যাওয়া ছোট্ট একটি ফ্লাটে সন্তানদের নিয়ে নীরবে জীবনযাপন করছেন স্ত্রী সুরভী মুন্না। সুরভীর বাসায় কোনো আভিজাত্য নেই। বাসাটা একেবারেই ছিমছাম। বাসাতে যতটুকু আভিজাত্য আছে তা হলো দেওয়ালে সাজানো ফুটবলার মুন্নার বিভিন্ন ছবি আর খেলার মাঠ থেকে পাওয়া অজস্র পুরস্কার। এই আভিজাত্যটুকুর বাইরে আসলে আর কিছুই নেই। আর আছে দীর্ঘশ্বাস।

পরিবারের মূল মানুষটি না থাকার কারণে সুরভী মুন্নাকে বছরের পর বছর সংগ্রাম করতে হচ্ছে। মুন্নার মেয়ে এবং ছেলে এখন বেশ বড়। মেয়ে ইউসরা মুন্না বর্তমানে মালয়েশিয়ার একটি ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করছে। ছেলে আজমান ‘এ’ লেভেল পরীক্ষা দিয়েছে। তবে বর্তমানে অর্থনৈতিক চাপ সুরভী মুন্নাকে অনেকটাই অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়লেও তেমন কাউকে খুব একটা পাশে পাচ্ছেন না। ছেলেমেয়ে বড় হওয়ার পারিবারিক ব্যয়ও বেড়ে গেছে অনেক। কিন্তু তাঁর ভাগ্যে কোনো চাকুরিও জোটেনি।

কিংবদন্তী ফুটবলার মুন্নাকে আসলে আমরা কতোটা মনে রেখেছি? কোথাও মুন্নার নামে কী সেই অর্থে কোনো স্থাপনা বা স্মৃতিস্মারক করা হয়েছে? নারায়ণগঞ্জেই বা তাঁর স্মরণে কী করা হয়েছে। না কিছুই করা হয়নি। সাদেক হোসেন খোকা মেয়র থাকা অবস্থায় ধানমন্ডির আট নাম্বার সড়কের সেতুটির নাম ‘মুন্না সেতু’ দেওয়া হলেও সেখানেও যেনো অবহেলা আর উপেক্ষা। মুন্নার নামের উপর একটা কালো ছোপ পড়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে, কিন্তু দেখার কেউ নেই। আবার ওখানে আজ পর্যন্ত মুন্নার একটা প্রতিকৃতিও স্থাপন করা হয়নি যে যা দেখে এই প্রজন্ম তাঁকে চিনবে বা উদ্বুব্ধ হবে। এসব কারণেই বুকে জমিয়ে রাখা অভিমান আর কষ্টের কথা প্রিয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলতে চান মুন্নার স্ত্রী সুরভী মুন্না।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)