আর্জেন্টাইন রেফারি বাঁশিতে শেষ ফু দিতেই ফরাসিদের গগনবিদারী চিৎকার ‘আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন’। আনন্দে আত্মহারা পগবা-এমবাপেরা একে অপরকে জড়িয়ে উচ্ছ্বাস করছেন। শিশুদের মতো বাধভাঙা আনন্দে সামিল কোচ দিদিয়ের দেশমও। কিন্তু তখনও দূরে দাঁড়িয়ে জার্সিতে মুখ ঢেকে কাঁদছেন অ্যান্থনিও গ্রিজম্যান।
কোচকে বারবার উপরে ছুড়ে ফ্রান্সের খেলোয়াড়-স্টাফদের উল্লাসের ফাঁকে ক্যামেরার লেন্স যখনই ক্রোয়েশিয়ার খেলোয়াড়দের মুখে পড়ছে, আকাশের পানে তাকানো সবার চোখ বেয়েই তখন পানি ঝরছে। ক্রোয়েটদের যে আবারও কাঁদাল ফরাসিরা।
কিন্তু মস্কোর আকাশ কার জন্যে কাঁদল? ম্যাচ শেষ হওয়ার ঠিক পরেই মুশলধারে বৃষ্টি। কাক ভেজা ভিজেও ফিফা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পুরষ্কার বিতরণ করেন রাশিয়া, ফ্রান্স ক্রোয়েশিয়ার রাষ্ট্রনায়করা। এমন বিরল দৃশ্য আগে যে কখনোই দেখেনি বিশ্বকাপ।
ম্যাচের আগে সমাপণী অনুষ্ঠানে মাঠে ড্রাম বাজান ব্রাজিল কিংবদন্তি রোনালদিনহো। তার ড্রামের তালেই কিনা ম্যাচের শুরু থেকে ফ্রান্সের উপর ঝাঁপান মদ্রিচ-রাকিটিচ-পেরিসিচরা। ম্যাচ শেষে পরিসংখ্যানের সবই থাকল ক্রোয়েশিয়ার পক্ষে, শুধু গোল ব্যবধান আর জয়-পরাজয় ছাড়া।
ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার বল পজেসন ছিল ৬১ শতাংশ। ফ্রান্স ৩৯ শতাংশ। গোলেও ক্রোয়েটদের অর্ধেক শট নিয়েছে ফরাসিরা। মদ্রিচদের ১৫ শটের বিপরীতে এমবাপেদের শট ৮টি। কর্নারের ক্ষেত্রেও তাই ৬-২। ক্রোয়েশিয়ার ৫৪৭ পাসের বিপরীতে ফ্রান্সের পাস ২৬৮টি।
তবু ম্যাচ শেষে সোনার বল পেয়েও বিষন্ন মদ্রিচ। মদ্রিচের মতো বিষন্ন তার সতীর্থতরাও। তবে কি মদ্রিচ-রাকিটিচদের কষ্টে নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি মস্কোর আকাশ?
মস্কোর ফাইনাল অনেকগুলো অন্যরকম ছবি দেখিয়েছে। ভাগ্যের উত্থান-পতনও যে অনিবার্য তার জ্বলন্ত উদাহরণ হয়েও থাকল এই ফাইনাল।
না হলে যে এনগোলো কন্তে টুর্নামেন্ট জুড়ে দুর্দান্ত খেলে দলের প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠেছিলেন, সেই কন্তেকেই ম্যাচের একঘণ্টার সময় তুলে নেন কোচ দেশম। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, এই এক ঘণ্টায় বলে মাত্র ১৯বার টাস করেন কন্তে।
আর ফাইনালের দু-তিনটি সেভ তো বটেই, পুরো টুর্নামেন্টের প্রতি ম্যাচেই যিনি তিন-চারটি করে অবিশ্বাস্য সেভ করেছেন সেই হুগো লরিসের হাস্যকর গোল হজম।
ক্রোয়েশিয়া শিবিরের ছবিটা আরো মর্মান্তিক। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে অসাধারণ গোল করে যিনি দলকে ফাইনালে তুলেছিলেন, সেই মারিও মানজুকিচের নামের পাশে আত্মঘাতী গোল। ওই ম্যাচে দুর্দান্ত গোল করে পিছিয়ে থাকা দলকে যিনি সমতায় ফিরিয়ে ছিলেন, সেই ইভান পেরিসিচের জন্যেই পেনাল্টি পায় ফরাসিরা। সব মিলিয়ে ম্যাচের পরের বৃষ্টিটাও কি কম অবাক করা?
সুখে যেমন মানুষের মনে আনন্দের বৃষ্টি ঝরে, তেমনি দুঃখের প্রতীকও এই বৃষ্টি। মস্কোর আকাশকে কাঁদিয়ে ক্রোয়েট-ফরাসিদের সুখ-দুঃখে প্রকৃতি কি ভারসাম্য টানল?
বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশের মর্যাদা পাওয়ার পর থেকেই নানা সমালোচনায় বিদ্ধ রাশিয়া। মানবাধিকার থেকে নিরাপত্তা সব ইস্যুতেই রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে নাজেহাল করার চেষ্টা করেছে তার দেশি-বিদেশি বিরোধীরা।
কিন্তু কোনো কিছুই পুতিন বা রাশিয়ার বিশ্বকাপ আয়োজনে কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই যখন রাশিয়া বিশ্বকাপ শেষ হতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন মস্কোর আকাশের কালো মেঘ থেকেই যেন ছোট এক টুকরো মেঘ হয়ে দুর্নাম ছড়াতে মাঠে ঢুকে পড়েন চার ব্যক্তি। যদিও তেমন বড় কোনো অস্বস্তি তৈরি করতে পারেননি তারা।
ম্যাচ শেষের আগেই পুতিন বিরোধী গোষ্ঠী ‘পুষি রায়ট’ স্বীকার করে এই কাজ তাদের। পুতিনকে জবাব দিতেই তারা এ কাজ করেছে। একটা সুন্দর আয়োজনে কলঙ্কের আভা। তবে সামান্য এই কলঙ্ক ধুয়ে দিতেই মস্কোর আকাশ কাঁদল কিনা কে জানে?