গত ২৯ জুন, ২০২০ তারিখে ঢাকায় বুড়িগঙ্গা নদীতে এম.ভি মুয়ূর-২ এর ধাক্কায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটি যাত্রীবাহী ছোট লঞ্চ মর্নিং বার্ড ডুবে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী মন্তব্য করেন যে: এটা কোন দুর্ঘটনা নয়, এটা হত্যাকাণ্ড। এ ঘটনা নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় ও কমিটি ইতিমধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। এ ঘটনায় ৩৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে এবং গত ১ জুন, ২০২০ তারিখে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে দ্য পেনাল কোড ১৮৬০ এর ৩০৪এ, ২৮০, ৩৩৭ ও ৩৪ ধারায় কেরানীগঞ্জ থানায় মামলা রুজু করা হয়েছে।
গত ৩০ জুন তারিখে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ১৯৯৪ সাল থেকে গত ২৬ বছরে ৬৬১টি লঞ্চ দুর্ঘটনায় ৭ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হন। সরকারি হিসাবে নিহতের সংখ্যা ৫৪৩১ জন ও নিখোঁজ হন প্রায় ১৫০০ জন।
নদী নিরাপত্তা বিষয়ক সামাজিক সংগঠন নোঙ্গর এর তথ্য মতে, ২০০৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ১৪ বছরে ৫৩৫টি বড় নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং এ সময়ে দুর্ঘটনা তদন্তে ৮৬৩ টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এত কমিটি করার পরও নৌ-দুর্ঘটনা কমাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সক্ষম হননি।
দুটি বেসরকারি সংগঠন গ্রিন ক্লাব অব বাংলাদেশ এবং নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমটির যৌথ জরিপ পরসিংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে গত ৬ মাসে যাত্রী ও পণ্যবাহী মিলিয়ে মোট ১০৬টি ছোট-বড় দুর্ঘটনায় ১৫৩ জন নিহত ও ৮৪ জন আহত হয়েছে। এ সময়ে নিখোঁজ হয়েছে আরো ২২ জন। চলতি বছররে ১ জানুয়ারি থাকবে ৩০ জুন র্পযন্ত সারা দেশে বিভিন্ন নৌপথে এসব প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির এই সংখ্যা গত বছররে তুলনায় বেশি। এ ছাড়া গত বছর বড় ধরনের লঞ্চ র্দুঘটনা না ঘটলে এ বছর ইতোমধ্যে বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবতিতে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটছে।
নৌ-পরিবহন পরিচালনা ও চলাচল সংক্রান্ত বিষয়ে এবং এ সংক্রান্ত অপরাধ এর তদন্ত ও বিচার দ্য ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৬1976 [The Inland Shipping Ordinance-1976] অনুযায়ী বর্তমানে চলছে। উক্ত আইনের ৪৭ ধারা অনুযায়ী সরকার কর্তৃক নৌ-পরিবহন সংক্রান্ত অপরাধের বিচারের জন্য এক বা একাধিক মেরিন কোর্ট (নৌ-আদালত ) প্রতিষ্ঠার কথা বলা আছে। মেরিন কোর্টের বিচারক প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। বর্তমানে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসের যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে এ পদে পদায়ন করা হয়। এই আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে ৭০ নং ধারায় ৫ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান আছে।
এছাড়া নৌযান চলাচলের অনুমোদন, নদী দূষণ, অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই, অন্য নৌযানের সাথে সংঘর্ষ সহ নৌ-দুর্ঘটনা হতে পারে এরকম অন্যান্য অপরাধের বিষয়ে পৃথকভাবে শাস্তির বর্ণনা আছে। অভিযুক্ত হিসাবে নৌযানের চালক, সহকারী, প্রকৌশলী, মালিকপক্ষ ও কোম্পানিকে শাস্তি দেওয়ার বিধান আছে। ১০ হাজার টাকার ঊর্ধ্বে অর্থদণ্ডের ক্ষেত্রে পরিশোধ ব্যর্থতায় কারাদণ্ড প্রদানের বিধান আছে। শাস্তির মাত্রা খুবই লঘু এবং জরিমানার পরিমাণ ও অনেক কম। এই আইনে ক্ষতিগ্রস্ত নৌযান ও ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের পৃথক কোন বিধান নেই।
বর্তমান সরকার সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ প্রণয়ন করে সড়ক দুর্ঘটনায় কারো মৃত্যু বা গুরুত্বর আহত হওয়ার ক্ষেত্রে দ্য পেনাল কোড ১৮৬০ এর ৩০৪এ ধারার সাথে সড়ক পরিবহন আইনের ১০৫ ধারা যুক্ত করে শাস্তি কঠোর করে এবং ইচ্ছাকৃত দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে হত্যা হিসেবে গণ্য করার বিধান করে। তদ্রূপ ১৯৭৬ সালের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন আইনে দুর্ঘটনায় ক্ষেত্রে কঠোর সাজা প্রবর্তন করা উচিত। বর্তমানে ১৯৭৬ সালের আইনের ৭০ ধারা অনুযায়ী কোন নৌযানকে বিপজ্জনক ভাবে আঘাত, জীবনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া, গুরুতর আহত করা বা কোন নৌযান এর গুরুত্বর ক্ষতি করা এবং উক্ত ঘটনার ফলে কোন মানুষের মৃত্যু, আহত অথবা কোন সম্পদের ক্ষতি হলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে ৫ বছরের কারাদণ্ড অথবা ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান আছে। যা অপরাধের তুলনায় শাস্তির মাত্রা অনেক কম। ২০০৯ সালের কোকো-৪ লঞ্চ ডুবির ঘটনায় ২৫ এপ্রিল, ২০১৮ সালে ঢাকার মেরিন কোর্টে রায় হয় এবং ৯ জন আসামিকে ৪ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
সরকার নৌ-দুর্ঘটনার বিচারের জন্য ঢাকায় সারা বাংলাদেশের জন্য শুধু একটি মেরিন কোর্ট (নৌ আদালত) গঠন করে। উক্ত আদালতে বর্তমানে ১৫৭০টি মামলা বিচারাধীন আছে। তার মধ্যে নৌ-দুর্ঘটনায় প্রাণহানির অভিযোগে শুধু ১৮টি মামলা চলমান আছে। [সূত্র: দৈনিক সমকাল, ১০ জুলাই, ২০২০] ১৯৭৬ সালে আইন কার্যকর হলেও গত ৪৪ বছর ধরে শুধু একটি মেরিন কোর্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের নৌ-দুর্ঘটনা গুলোর অন্যতম আলোচিত ঘটনা হলো ২০০৩ সালের ৮ জুলাই, ভোলাগামী এম.ভি নাসরিন ১ লঞ্চ চাঁদপুরে এসে নদীতে ডুবে গেলে ৪০২ জন যাত্রীর মৃত্যু হয়। উক্ত ঘটনা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন ব্লাস্ট ২০০৪ সালে ঢাকার যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে যাত্রীদের মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা দায়ের করে। গত ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞ আদালত ১৭ কোটি ১১ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ প্রদানের রায় প্রদান করেন। উক্ত রায়ের বিপক্ষে বিবাদিপক্ষ হাইকোর্ট বিভাগে আপীল করে। গত ৫ জুন, ২০১৮ তারিখে হাইকোর্ট বিভাগ নিন্ম আদালতের রায় বহাল রাখেন। বিবাদিপক্ষ উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে মহামান্য আপীল বিভাগে লিভ টু আপীল দায়ের করলে তা সর্বোচ্চ আদালতে এখন বিচারাধীন আছে। এটি শুধুমাত্র ক্ষতিপূরণ আদায়ের লক্ষ্যে দায়ের হওয়া একমাত্র মামলা যা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে ২৩০ টি সক্রিয় নদী বহমান আছে ও প্রায় ৪৫০ টি নদী দখল ও দূষণ জনিত কারণে ক্রিটিক্যাল অবস্থায় আছে। আমাদের সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্র কর্তৃক নদী ও পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা আছে। বর্তমান সরকার নদী দূষণ প্রতিরোধ ও নদীর সীমানা দখল উদ্ধারে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ২০১৩ সালে জাতীয় নদী কমিশন আইন কার্যকরের মাধ্যমে একটি নদী কমিশন গঠন করা হয়েছে। উক্ত কমিশন কর্তৃক ৪৯,১৬২ জনের নদী দখলকারী হিসেবে তালিকা প্রকাশ করেছে।
হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক নদীকে আইনি ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে যুগান্তকারী রায় প্রদান করেছেন। উক্ত রায়ে মহামান্য হাইকোর্ট নদী রক্ষায় পৃথক আদালত গঠনের নির্দেশনা দিয়েছেন। গত ২৩ এপ্রিল, ২০১৮ তারিখে জাতীয় নদী কমিশন সারাদেশের নদী রক্ষায় ৮টি বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ ও পরিবেশ আদালত ২০১০ অনুযায়ী পরিবেশ এর দূষণ রক্ষায় পরিবেশ আদালত ও স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিধান আছে। গত ৯ জুলাই, ২০২০ তারিখে জাতীয় সংসদে জি এম কাদের এম.পি নৌ দুর্ঘটনা বিচারের জন্য পৃথক আদালত প্রতিষ্ঠার দাবী করেন।
নদীপথকে নিরাপদ রাখতে সরকার পৃথক নৌ পুলিশ গঠন করেছে। একজন ডি.আই.জি ও ৩ জন অতিরিক্ত ডি.আই.জি এর নেতৃত্বে নৌ পুলিশ গঠন করা হয়েছে। নৌ পুলিশের কার্যক্রমের জন্য একজন পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে কয়েকটি থানার সমন্বয়ে পৃথক নৌ এলাকা গঠন করা হয়েছে। সারাদেশকে ৮টি বিশেষ নৌ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যদি সরকার শুধুমাত্র নদী এলাকায় অপরাধ দমন করার উদ্দেশ্যে পৃথক পুলিশ ইউনিট গঠন করতে পারে, সেক্ষেত্রে নদী রক্ষা, দূষণ প্রতিরোধ ও নৌ দুর্ঘটনা বিচারে সারাদেশে ২০ থেকে ৩০টি নৌ আদালত গঠন করা উচিত।
এই লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালের পুরনো আইনকে পুন:বিবেচনা করে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী অধিকতর কঠোর শাস্তি, পর্যাপ্ত অর্থদণ্ড এবং ক্ষতিপূরণ প্রদানের ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট আদালতকে প্রদান করা উচিত। এছাড়া নৌ দুর্ঘটনার বিষয়ে নৌ পুলিশ ও বিশেষায়িত সংস্থাকে তদন্ত ক্ষমতা প্রদান করা উচিত। বর্তমানে ঢাকায় অবস্থিত নৌ আদালতে বেশির ভাগ মামলায় সাক্ষী উপস্থিত হয় না এবং রাষ্ট্রপক্ষের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হয় ও সাজার হার খুবই কম। একটি গতিশীল ও কার্যকর নৌ আইন, তদন্ত সংস্থা, প্রসিকিউশন ও আদালতই পারে নৌ দুর্ঘটনায় কার্যকর শাস্তি নিশ্চিত করতে এবং এর মাধ্যমে নৌ দুর্ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)