নাফ নদীতে ভেসে থাকা শিশুর মুখখানি দেখে চোখে পানি আসেনি, এমন একজন মানুষও কি আছে? না নেই। সবাই আমরা কেঁদেছি, ছোট্ট মানুষটির নিথর দেহখানি দেখে। প্রত্যেকেরই চোখে ভেসে উঠেছে তার প্রিয় শিশুর মুখ, তাদের সন্তানের মুখ। বারবার মনে হয়েছে কার অপরাধে, কোন অপরাধে আমার সন্তানের মরদেহ নাফ নদীতে ভাসছে? কেন শিশুমৃত্যুর মত গুরুভার আমাকে বহন করতে হচ্ছে? কেন অসংখ্য মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হল? কেন অগণিত নিপীড়িত ও ভয়ার্ত মানুষের কান্নায় আজ কাঁদছে বাংলাদেশ। এরা আমাদের আত্মীয় নয়, পরিবার নয় কিন্তু এরা সবাই আমাদের প্রতিবেশি-স্বজন। আর স্বজনের এই কষ্ট আমরা সহ্য করতে পারছি না।
আমার চোখে বারবার ভাসছে আরাকান রাজ্যের একটি জেলা মংডুর হাসিখুশি মানুষগুলোর চেহারা বেশ ক’বছর আগে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সময়ে, আমি সুযোগ পেয়েছিলাম ঘোরাঘুরির সুবাদে মংডুতে একটি দিন কাটানোর। আমরা দলেবলে বেড়াতে গিয়েছিলাম টেকনাফে। নেটং এ থাকতে থাকতেই হঠাৎ খবর পেয়েছিলাম যে চেষ্টা করলে আমরা নাকি এখান থেকে বার্মার মংডুতেও যেতে পারবো। ব্যস অমনি সবাই রাজি হয়ে গেল। স্থানীয় সাংবাদিকদের সহায়তায় ৫০০ টাকা দিয়ে একটা অনুমতিপত্র নিয়ে নাফ নদী দিয়ে নৌকা নিয়ে রওনা দিলাম মংডুর দিকে। বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের এলাকা বার্মার এই মংডু। এখান থেকেই বার্মিজ জিনিসপত্র বাংলাদেশের বাজারে আসে। তবে আমরা যাওয়ার অনুমতি পেয়েছিলাম মাত্র ৮ ঘন্টার জন্য। সকালে ঢুকে সন্ধ্যার মধ্যে ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা সেনাবাহিনীর পরীক্ষা-নীরিক্ষা শেষ করে মংডুতে ঢুকলাম। সেখানে কোন বাহন নেই। বড় বড় রাস্তাঘাট কিন্তু যানবাহন নেই। আছে কিছু দোকানপাট। আমরা দিনের খাবার খেলাম বার্মিজ রুই মাছ দিয়ে। হেঁটে হেঁটে বিভিন্ন দোকানপাটে ঘুরলাম। সব দোকানই চালাচ্ছে মেয়েরা। এরপর সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসতে হল, কারণ মংডুতে সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ থাকেনা। সেই মংডু থেকে অসংখ্য মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসছে, সেই মানুষগুলোকে নির্বিচারে মারা হচ্ছে ব্যাপারটা ভাবতেই মনটা কষ্টে ছেয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ এখন খুব কঠিন একটি সময় পার করছে। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরাও খুব অসহায়বোধ করছি। এই দৃশ্য আমাদের কাছে খুব পরিচিত। মাত্র ৪৬ বছর আগে ঠিক আমরাও এইভাবে সীমান্ত পার হয়েছিলাম। উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম ভারতে। একদিকে হাজার হাজার মানুষের কান্না, হাহাকার, শিশুর মৃত্যু, রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে পথের পাশে থাকা মানুষ, নারীর অবমাননা, লুটতরাজ, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, সন্তানের কাঁধে বৃদ্ধ বাবা-মা অন্যদিকে এতগুলো মানুষকে বাংলাদেশে থাকতে দেয়ার মত চ্যালেঞ্জ।
সত্যি কথা বলতে এই রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু সবাই আমাদের জন্য বোঝা। ইতোমধ্যে যে রোহিঙ্গারা এদেশে প্রবেশ করেছিল, তারা কেউই আর তাদের স্বদেশ ভূমিতে ফিরে যায়নি, যেতে পারেনি। এদেশের মানুষের সাথে মিশে গেলেও জানা গেছে এদের অনেকেই মাদকসহ নানাধরণের অসামাজিক কাজের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ পাসপোর্ট যোগাড় করে অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগ ।
আরাকান রাজ্য, রোহিঙ্গা ইস্যু, মুসলিম না বৌদ্ধ না হিন্দু এনিয়ে অনেক আলোচনা আছে, অনেক ইতিহাস আছে। এখন মিয়ানমার সরকার যে কারণ দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের খেদিয়ে দিচ্ছে, তা খুবই অন্যায় যুক্তি। এই রাখাইন রাজ্যটি শুরু থেকেই আরাকান রাজ্যের মূল ভ’খন্ড ছিল। ১৯৪৮ সালে বৃটিশ শাসন থেকে বার্মা স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এই রোহিঙ্গাদের তারা তাদের নাগরিক বলেই মেনে নিয়েছিল। এমনকী রোহিঙ্গাদের প্রশাসনিক পদও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বার্মার সামরিক জান্তা ১৯৮০ সালে এসে হঠাৎই ঘোষণা করে রোহিঙ্গারা বার্মার লোক নয়। ব্যস এরপর থেকে শুরু হয় নিধন, বিতাড়ণ, নির্যাতন। লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে এসে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশের দুয়ারে।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা অনেক বেশি, সমস্যারও কোন শেষ নেই। এরমধ্যে দিনের পর দিন বাড়তি মানুষের বোঝা টানার মত শক্তি, প্রশাসনিক জোর ও তাদের বসবাসের জন্য জায়গা দেয়ার মত স্থানেরও অভাব রয়েছে। তারপরও এতগুলো নিরাশ্রয় মানুষ যখন ভাসতে ভাসতে এসে দাঁড়িয়েছে, বাংলাদেশ পারেনি তার দরজা বন্ধ করে দিতে। কারণ আমরা জানি উদ্বাস্তু হওয়ার কষ্ট কতটা?
বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে, সরকারের মধ্যে রোহিঙ্গাদের নিয়ে নানা মত থাকলেও একটি মানবিক তাড়না থেকেই এদেশের মানুষরা চায় অসহায় রোহিঙ্গারা একটা আশ্রয় পাক। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন ধর্মীয় নয়, মানবিক কারণেই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে। মিয়ানমার যে সমস্যা তৈরি করেছে, তা তাদেরই সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশ তাদের পাশে আছে। তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গণের সহায়তা কামনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান একদম পরিষ্কার । এখন শুধু কড়া নজর রাখতে হবে যেসব সাহায্য আসছে, এর বন্টনটা কেমন হচ্ছে? এলাকার মাস্তান, পলিটিক্যাল ক্ষমতাবানরা যেন ভাগ বসাতে না আসে। এরকমটা হলে সরকারকেই এই দায়ভার বহন করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি দাতা সংস্থা ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে আরো অনেক বেশি এগিয়ে আসতে হবে। আর সাধারণ মানুষও চাইছে শরণার্থী মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে। তাদেরও পাশে নেয়ার নেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে এবং তা এখুনি ।
বর্মী জান্তা নির্বিচারে এই নিধনযজ্ঞ চালাবে, আর বিশ্ববাসী তা চেয়ে দেখবে এবং অসহায় মানুষের দায়ভার বাংলাদেশের উপর চাপিয়ে দেবে এ আমরা কিভাবে, কতদিন মেনে নেবো? খন্ডকালীন অর্থ সাহায্য দিয়ে বা সফর করে বা উষ্মা প্রকাশ করে এ সমস্যার সমাধান হবেনা। অথচ জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থাগুলো ও বেশ কয়েকটি দেশ তাই মনে করছে। কি এক অজ্ঞাত কারণে তারা বর্মী সরকারের উপর কোন চাপই সৃষ্টি করতে পারছেনা। বরং শক্তিশালী কিছু দেশ ধান্ধায় আছে কীভাবে মিয়ানমারের সঙ্গে অর্থনৈতিক জোট বাঁধবে ?
রোহিঙ্গা সমস্যা আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বেশ আগেই। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিশ্বের বড় বড় মানবতাবাদী দেশ বারবার এই সমস্যা সমাধানের কথা মুখে মুখে বলেছে। কিন্তু সমাধানের বাস্তব কোন পথ খুঁজে বের করছেনা। বিশ্ব বিবেক চুপ, মানবাধিকার সংস্থাগুলো চুপ, আরব বিশ্ব চুপ, পরাশক্তিরা চুপ। কোন দেশই মিয়ানমার সরকারের এই জঘণ্য আচরণের বিরুদ্ধে কোন একশন নিচ্ছেনা, এমনকি কোন কোন দেশতো এই আচরণের কোন নিন্দাও করছেনা। মিয়ানমারের নেত্রী নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী সুচি তার কাজের গুণে নোবেল শান্তি পুরস্কার’ কে রীতিমত পদদলিত করে ছেড়েছে। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আচরণ গৌতম বুদ্ধের অহিংস নীতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছে। মিয়ানমার সরকার, আইন-শৃঙ্খরা রক্ষাকারী বাহিনীর সহিংস আচরণকে ক্রমাগত সমর্থন দিয়ে চলেছেন শান্তি পুরস্কার প্রাপ্ত নেত্রী। রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর নির্যাতন নিপীড়ণের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদতো করেইনি, বরং অবস্থান নিয়েছে নিপীড়কদের পক্ষে। মিয়ানমারের সাধারণ মানুষ, সংবাদমাধ্যম, পেশাজীবিদের ভূমিকাইবা কী? তারা কি তাদের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে? বোধকরি, বহুবছরের সামরিক শোষণ-শাসন তাদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিয়েছে।
মিয়ানমার সরকার যা করছে, তাতে করে জাতিগত হানাহানি বাড়ার আশঙ্কা আছে। সবচেয়ে ভয়ে আছি আমরা, এই অসংখ্য বেকার মানুষকে জঙ্গিরা যদি কাজে লাগানোর চেষ্টা করে, সেটা হবে আমাদের জন্য মরার উপর খাড়ার ঘা। জঙ্গিরা এই সুযোগ হাতছাড়া করবে বলে মনে হয়না ।
বাংলাদেশের নিজেদের সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বন্যার প্রভাব আমরা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এরমধ্যে শুরু হল রোহিঙ্গা সমস্যা। জানিনা কবে কীভাবে এই সমস্যার সমাধান হবে? রোহিঙ্গারা কি পারবে তাদের নিজ ভিটায় ফিরে যেতে? কবে তাদের মিলন ঘটবে সেখানে ফেলে আসা প্রিয়জনদের সাথে? আমরা সেই প্রতীক্ষায় থাকলাম।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)