‘একুশ মানে মাথা নত না করা’, ‘একুশ আমাদের পরিচয় একুশ আমাদের অহংকার’, ‘একুশের চেতনা, হারিয়ে যেতে দেব না’, ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’ ফেব্রুয়ারি মাস এলেই মহান ভাষা সংগ্রামকে ঘিরে এমন অনেক স্লোগান আমরা দেই, উচ্চারণ করি। প্রশ্ন হচ্ছে এসব স্লোগানের অর্থ কী? এসব স্লোগান কেন উচ্চারণ করা হয়? একুশের চেতনা, ভাবনা নিয়ে এসব আলাপ অনেক পুরনো। কিন্তু এখন কেন নতুন করে করছি? করছি এ কারণে, যখন দেখি আমাদের কথা ও কাজে কোন মিল নেই। আমাদের কর্মে ও চরিত্রে কোন সঙ্গতি নেই। আমাদের চেতনা ও চর্চা স্ববিরোধী হয়। আমাদের বক্তব্য ও বিশ্বাস ভিন্ন হয়।
কানাডার অন্টারিওতে একটি শহীদ মিনার তৈরির কাজ প্রায় শেষের পথে। জেনেছি অনেক দিনের অনেক প্রচেষ্টার ফসল এ কাজ। যারা এ প্রচেষ্টার সাথে ছিলেন এবং আছেন তাঁদেরকে সাধুবাদ জানাই।
টরন্টোতে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের প্রচেষ্টা অনেক দিনের হলেও এটা বাস্তবায়ন করতে ২০১৮/১৯ সালে ৩৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি যখন করা হয় তখন একে নিয়ে, এর কোন সদস্যকে নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি, বিতর্ক হয়নি। কিন্তু গতবছর জানুয়ারীতে টরন্টোতে সাড়া জাগানো ও দেশ-বিদেশে আলোড়ন তোলা লুটেরা বিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠার পর জানা যায় যে, এই কমিটিতে দুইজন বিতর্কিত ও বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসা ব্যক্তি আছেন। তাদের স্থানীয় প্রবাসীরা কমবেশি সবাই চেনে। যাদের বিরুদ্ধে মিডিয়াতে বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার ও ব্যাংকের টাকা মেরে দেয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, বাংলাদেশে দুদক সেগুলো খতিয়ে দেখছে। কানাডায় নজীরবিহীন ইতিহাস সৃষ্টিকারী লুটেরা বিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠার পরও বহুল আলোচিত ওই দুজনের নাম শহীদ মিনার নির্মাণে গঠিত কমিটি থেকে প্রত্যাহার করা হয়নি।
সে সময় লুটেরা বিরোধী সামাজিক আন্দোলন থেকে আমরা কানাডায় বসবাসকারী লুটেরাদের সামাজিকভাবে বয়কট করার অঙ্গীকার করেছিলাম। এই সব ঘৃণিত, অভিযুক্ত, বিতর্কিত ব্যক্তিদের বাঙালি কমিউনিটির যে কোন ধরণের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ ও বয়কটের আহ্বান রেখেছিলাম। তার পক্ষে আমরা ব্যাপক স্বতস্ফুর্ত সাড়াও পেয়েছিলাম। কিন্তু সে আকাঙ্খার প্রতিফলন আমরা এখানে দেখতে পাইনি।
কেউ বলতে পারেন, এই কমিটি যখন করা হয় তখন তাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ ছিল না। এমন ধারণা ভুল। তখনও অভিযোগ ছিল সে সংবাদ আমাদের নজরে আসেনি, এতটা আলোচিত ছিল না। কম আলোচিত হবার কারণে হয়তো তখন তাদেরকে নিয়ে কোন প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু এখন যখন তাদের নিয়ে সঙ্গত প্রশ্ন-অভিযোগ উঠেছে, তখন কেন তাদের প্রত্যাহার করা হচ্ছে না?
কেউ বলতে পারেন তাদের বিরুদ্ধে তো অর্থপাচার, অর্থআত্মসাতের অভিযোগ প্রমানিত হয়নি, তাহলে কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে? যাদের বিরুদ্ধে মামলা আছে, বাংলাদেশের সরকার, দুর্নীতি দমন কমিশন লড়ছে, আদালতের নিষেধাজ্ঞা আছে, মিডিয়া-পত্রিকায় শতশত সংবাদ-প্রতিবেদন আছে, তাদের নিয়ে এমন সংশয় কূটতর্ক ছাড়া কিছু নয়! আর তাদের বিরুদ্ধের অভিযোগ প্রমান করার দায়িত্ব তাদের নিজেদের। এসব সংবাদের কোন প্রতিবাদ আসেনি, হয়নি। এক্ষেত্রে তাদেরকে দেশে যেয়ে সেটা প্রমাণ করে আসতে হবে যে, তারা অপরাধী নয়, নিষ্পাপ। তারা যদি সত্যি প্রমাণ করতে পারেন যে তারা অপরাধী নয়, তাহলে তাদের স্বাগত জানানো হবে।
আমরা শহীদ মিনার করছি, শহীদদের স্মরণ করতে, তাদের চেতনাকে অম্লান রাখতে। কী ছিল তাদের চেতনায়- মানে আকাঙ্খায়? তাদের চেতনা ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা। একুশ হচ্ছে দেশপ্রেম ও প্রতিবাদের আরেক নাম। একুশ হচ্ছে স্বাধীনতার ভিত্তিমুল ও রক্তবীজ। তাহলে প্রশ্ন, এই শহীদ মিনারের মাধ্যমে আমরা কি অর্জন করতে চাই? শুধু কি কয়েকজন ব্যক্তির আত্মদান স্মরণ..?
ভাষার অধিকার, ভাষার স্বাধীনতার সাথে ভাষার অর্থনীতি, রাজনীতি ও শোষনের প্রক্রিয়া বুঝতে হবে। তাহলেই একুশের চেতনার রাজনীতি ও অর্থনীতি বুঝতে পারবেন। বিশ্বায়নের যুগে এখন রাজনীতি-অর্থনীতি বহুমাত্রিক, বহুজাতিক। এক দেশের স্বার্থের সাথে আরেক দেশের স্বার্থ-অর্থ জড়িত। নীতিহীন ক্ষমতাকেন্দ্রীক লুটপাটের রাজনীতির সুযোগে একশ্রেণীর মানুষ দেশের সম্পদ পাচার করে বিদেশে বিলাস বহুল জীবনযাপন করছে। এরা জাতীয় স্বার্থের ক্ষতি করে জনগণকে পথে বসাচ্ছে, ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়ায় পরিণত করছে। কানাডায় অবস্থান নেয়া এ সব লুটেরাদের বিরুদ্ধে কথা বলা সকল প্রবাসীর বিবেকের দায় মনে করি।
গতবছর ১৮ নভেম্বর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল মোমেন কানাডায় অর্থ পাচারের ২৮টি কেসের কথা উল্লেখ করেন, এবং বলেন আরো খোঁজখরব-অনুসন্ধান চলছে। এ ঘটনার পর ১৭ ডিসেম্বর দেশের সর্বোচ্চ আদালত, স্বতপ্রনোদিত হয়ে এক যুগান্তকারী রায়ে বলেন, যারা দেশের সম্পদ পাচার করে, তারা দেশের শত্রু, বেঈমান। অর্থ পাচারকারী জাতীয় স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর, তাদের কাজ কোনভাবেই সমর্থিত, গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। তাদের লুটপাট করা চোরাই ও পাচারকৃত অর্থ সরকারী দফতরে জমা দিতে হবে।
বিচারকগণ বলেন, দেশকে ঠকিয়ে দেশের টাকা বাইরে নিয়ে যাবে এটা হয় না, একজন মানুষের দেশপ্রেম থাকলে এ কাজ কখনোই করতে পারে না। অর্থ পাচারকারী দুর্বৃত্তদের নাম, ঠিকানা, পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ, পাচারের অর্থে কেনা গাড়ী-বাড়ি-সম্পদের তথ্য জানতে চেয়েছে হাইকোর্ট।
সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, ব্যাংকার, যারা বিদ্যমান আইন লঙ্ঘন করে বিদেশে অর্থ পাচারে সম্পৃক্ত, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেছেন হাইকোর্ট। দুদক চেয়ারম্যান, স্বরাষ্ট্রসচিব, পররাষ্ট্রসচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, এনবিআর চেয়ারম্যান ও ঢাকা জেলা প্রশাসককে চার সপ্তাহের মধ্যে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
গতবছর কানাডার ফেডারেল সংস্থা ফিনট্র্যাক (The Financial Transactions and Reports Analysis Centre of Canada (FINTRAC) এক বছরে অর্থ পাচারের ১ হাজার ৫৮২টি সুনির্দিষ্ট তথ্য কানাডার সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস ও আরসিএমপির কাছে হস্তান্তর করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের সাথে এর কোন সম্পর্ক আছে কি’না জানিনা। যদি ফিনট্রাক ও সরকারী তথ্যে এ সব অভিযুক্তদের নাম থাকে তা কি আমাদের লজ্জিত করবে না? তাহলে কেন বাংলাদেশের ব্যাংকের টাকা মেরে কানাডায় পাচারকারী চিহ্নিত অভিযুক্তদের অন্টারিও শহীদ মিনার নির্মাণ কমিটি থেকে বহিষ্কার করা হবে না?
কানাডার শহীদ মিনারে বিতর্কিত ও পলাতক অর্থে একটি ইট, একফোটা রঙও হবে পবিত্র শহীদ মিনারের কলঙ্ক, অমর্যাদা ও শহীদের অপমান। শহীদ মিনারের ইতিহাসের সাথে এ সব ঘৃণিত, পলাতক ব্যক্তিদের নাম জড়িয়ে থাকুক, তা কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। কানাডায় লুটেরা বিরোধী আন্দোলনের সংগঠক, সক্রীয় অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই এই কমিটিতে আছেন। আশা করি এ সব অভিযুক্ত লুটেরাদের কমিটি থেকে বহিষ্কারে ও তাদের অনুদান প্রত্যাখানে কার্যকর ভূমিকা রাখবেন।
লুটেরারা দেশের অর্থ-সম্পদ লুটপাট করে, দেশের ক্ষতি করে- এখানে এসে মহান দেশপ্রেমিক সাজতে চায়। চোরাই অর্থের বদৌলতে পাচারকারী বেঈমানরা কোনভাবেই দেশপ্রেমিক হতে পারে না। তারা তাদের অপকর্মকে জায়েজ করার নানা ফন্দিফিকির করবে- সেক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। এত কিছু জানার পরও যারা এ মহতি কাজে তাদের থাকার সুযোগ করে দেবেন তারাও ঘৃণীত ও ধিকৃত হবেন। গতবছর প্রচন্ড শীতে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে SAY NO TO MONEY LAUNDERS প্লাকার্ড লিখে পরিবার নিয়ে টরন্টোর অস্থায়ী শহীদ মিনারে গিয়েছিলাম। এ বছর নবনির্মিতি শহীদ মিনারে পরিবার নিয়ে যেতে চাই। আশা করি তার আগে আমাদের চেতনার মিনার হবে পবিত্র ও লুটেরা মুক্ত।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)