কানাডার সমর শক্তি নিয়ে কৌতুক আছে যে যুদ্ধের মাঠে কানাডিয় সৈন্যরা ফ্রেন্ডলি ফায়ারেই বেশি মরে। যুদ্ধ-মুদ্ধ তেমন পারেনা বলে নিজেদের গুলি বা জোটভূক্ত সৈন্যদের গুলি খায়। তবে শান্তিরক্ষা, মানবিক মিশন, হাসপাতাল বা সেবাকেন্দ্রে চিকিৎসাসেবা দান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, উদ্ধারকর্ম, ফায়ারফাইট ইত্যাদিতে কানাডিয় সৈন্যরা অনন্য।
তাই গতকাল হঠাৎ কানাডা সামরিক (প্রতিরক্ষা) খাতে কুড়ি বছর মেয়াদে ৩২ হতে ৬২ বিলিয়ন ডলার নিয়মিত বাজেটে অতিরিক্ত যোগ করবে শুনেই আম-কানাডিয়দের আক্কেল গুড়ুম! যেখানে সৌদি আরব এক আমেরিকার কাছ হতে এক চালানেই ১৫০ বিলিয়ন ডলাররের অস্ত্র কিনে, সেখানে প্রথম পাঁচ-দশ বছরে ১৮ বিলিয়ন শুনে কানাডিয়রা কোথায় হেসে গড়াগড়ি করবে, তা নয় উলটো ট্যাক্স দেয়া ডলার অপচয় হবে বলে, সন্তানদের যুদ্ধে যেতে হতে পারে আশঙ্কায়-টেনশনে হা-হুতাশ শুরু করেছে।
আজ একজন কানাডিয় বন্ধুকে বলতে হল— ‘তোমার সন্তানদের যুদ্ধে ঠেলে দিয়ে মারার পাঁয়তারা হচ্ছে বলছো? দ্যাখো কাতারের জনসংখ্যা মাত্র ২৩ লাখ। ৩৮ কোটি জনসংখ্যার কতগুলো আন্তঃমহাদেশিয় বাঘ-সিংহ দেশ এই ক্ষীণতনু খরগোশ শাবকটিকে চিবিয়ে খেতে জোট বেঁধেছে। আমেরিকা সৌদির কাছে ১৫০ বিলিয়ন ডলারে অস্ত্র বেচেছে বালুর নিচে ফেলে রাখার জন্য বা মিসাইল-রকেটের ডগা দিয়ে নাক-কান খোঁচানোর জন্য নয়। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ-ঝঞ্ঝাটের মহাপ্রলয় চললেই অস্ত্রের গতি হবে। যুদ্ধের ফাঁকতালে বড়সড় অস্ত্রের চালান আইসিস-এর কাছে পৌঁছে যাবে অনুমান করা যায়। এবার বল সন্তানদের নিয়ে কাতারি বাবা-মায়ের টেনশন বেশি, না-কি তোমার টেনশন বেশি?
সম্প্রতি ফাঁস হয়ে গেছে যে ইরাক-আফগানিস্তান-সিরিয়ায় মার্কিন বাহিনীর অস্ত্রভান্ডার হতে ১০% বহনযোগ্য অস্ত্র কোথায় কিভাবে কোন সেনাকে দেয়া হয়েছে তার কোনো হিসাব-রেকর্ড পাওয়া যাচ্ছেনা। এদিকে ইরানেও আইসিস নেমেছে। ১২টি জীবনহানি ঘটেছে! অন্য অঞ্চলেও আইসিস। যেদিন ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট দুতার্তে ঘোষণা দিল আমেরিকাকে অবশ্যই সুবিক নৌ-ঘাঁটি ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে হবে রহস্যজনকভাবে তার দুই-তিন দিনের মধ্যেই মিন্দানাও্ভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন আবু সায়াফ-এর ঘাড়ে ভর করে আইসিস দক্ষিণ ফিলিপিন্সের একটি শহর দখল করে ফেলল।
কানাডা প্রসঙ্গে ফিরি। এমনিতে কানাডার প্রতিরক্ষা বাজেট জিডিপির মাত্র ২ ভাগ। এটি ন্যাটোভূক্ত দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই জন্য ন্যাটোর সদস্যরা বহুদিন ধরেই নারাজ। তাদের সম্মিলিত অভিযোগ সামরিক নিরাপত্তা ব্যয় কমপক্ষে ২% এর নীচে হতে পারবেনা শর্তটির বাধ্যবাধকতার কারণে কানাডা ২% বরাদ্দ করে। বাস্তবে বরাদ্দ আরো কম। কারণ, বরাদ্দের একাংশ যুদ্ধফেরত সৈনিক (ভেটারান) ও তাদের পরিবারের সামাজিক উন্নয়ন ও সেবামূলক কাজে ব্যবহার হয়। এটি সামরিক নিরাপত্তা ব্যয় নয়। আরো নারাজ এইজন্য যে ট্রুডো সরকার বলে দিয়েছে ন্যাটোর পৃথিবী দাবড়ানো সামরিক কর্মকাণ্ডে কানাডা মাঠের যুদ্ধ করবে না। শুধুই প্রশিক্ষণ দেয়া, এগিয়ে যুগিয়ে দেয়া, উদ্ধারকাজ, শরণার্থী ব্যবস্থাপনা এইসব করবে।
আমেরিকায় পাগলা রাজার গদি গ্রহণের পর বিশ্বময় অনেকেরই প্রশ্ন—শান্তির দেশ কানাডার সামরিক নিরাপত্তা ভাবনা কি রকম হবে? নাফটা হতে আমেরিকার একক প্রত্যাহার, আমেরিকার বাজারে কানাডার নরম কাঠ ও গবাদি পণ্য রফতানিতে অবিশ্বাস্য শুল্ক আরোপ (প্রায় ২৬%) ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের মধ্যে আমেরিকা-কানাডার বেসামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের সাম্প্রতিক টানাপোড়ন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সম্প্রতি প্যারিস ডিক্লারেশন বা পরিবেশ চুক্তি বিষয়ে দুই দেশের অবস্থান দুই মেরুতে। আমেরিকার মত একটি যুদ্ধবিদ্যানির্ভর বৃহৎ প্রতিবেশির সঙ্গে এই সব টানাপোড়ন কানাডাকে কোনো সামরিক নিরাপত্তা-ঝুঁকিতে ফেলছে কিনা ইদানিং এই প্রশ্নটি কানাডা ও কানাডার বাইরে বিভিন্ন মহলে জোরালোভাবেই উঠছে।
এত কিছুর পরও যুক্তরাষ্ট্রকে কানাডার সবচে বড় নিরাপত্তা-বন্ধু বলা হয়। কানাডা-আমেরিকার সামরিক বাহিনী উত্তর আমেরিকার নিরাপত্তায় সব কাজ যৌথভাবেই করে। এটি সুসংবদ্ধ দ্বৈত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কানাডার নিরাপত্তা নীতি মূলত তিনটি। এক, সকল কিছুর উপরে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা (‘কানাডা ফার্স্ট’ কৌশল)। দুই, ‘উত্তর আমেরিকার নিরাপত্তা’ এবং তিন ‘বহির্বিশ্বে সামরিক অবদান। যুক্তরাষ্ট্র কানাডার প্রথম নিরাপত্তা নীতি অর্থাৎ ‘কানাডা ফার্স্ট’ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না।
কানাডার বেলায় এই নমনীয়তা কেন? অবশ্যই ‘কৌশলগত’। নমনীয়তার কারণ বুঝতে দেখা যাক কানাডার অতি-সাম্প্রতিক নিরাপত্তা সমস্যাগুলো কি কি? টুকিটাকি ঝামেলা বাদ দিলে মূল সমস্যা তিনটি—
এক, উত্তর মেরুতে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে আইসবার্গ গলে গিয়ে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের সংক্ষিপ্ত পথ তৈরি হওয়ায় এবং তেলসহ অফুরন্ত মুল্যবান খনিজ সম্পদ আহরণের সুযোগ তৈরি হওয়ায় রাশিয়া এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর কুনজর পড়েছে। তারা আর্কটিকের স্ব-স্ব সীমানা-মালিকানা দাবি করছে। মাঝে মাঝেই রাশিয়া আর্কটিকের জলসীমার বেশ গভীরে ঢুকে জাহাজ নিয়ে বসে থাকছে। মাছটাছও ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মনোভাব মাস্তানির। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সাহায্য ছাড়া কানাডার পক্ষে রাশিয়াকে সামলাতে পারা অসম্ভব। আর্কটিকের সম্পদে যুক্তরাষ্ট্রেরও আগ্রহ এবং নজর থাকলেও কানাডার উপর কর্তৃত্ব করতে গেলে বিশ্ব সম্প্রদায় যুক্তরাষ্ট্রকেই যে একঘরে করবে সেটি সহজেই অনুমেয়। কানাডার ‘শান্তিবাদী দেশ’ পরিচিতিটি এই বিষয়ে দারুণ উপকারী।
দুই, সাইবার নিরাপত্তা সমস্যা। বিগত দশকে অজ্ঞাত ও রহস্যজনক কারণে কানাডার কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ছোট বড় অনেকগুলো আক্রমণ ও আক্রমণের চেষ্টা হয়েছে। সবচেয়ে বড় আক্রমণটি হয় ২০১৬ সালের নভেম্বরে কানাডার প্রতিরক্ষা সদর দফতরের মূল জাতীয় নিরাপত্তা ডাটাবেইসে। সর্বাধুনিক ও সর্বোচ্চ মানের বহু স্তরবিশিষ্ট এনক্রিপশন ভেঙ্গে হ্যাকারদের ডাটাবেইস হ্যাক করা কানাডার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গভীর দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র জানে এই সমস্যা সমাধানেও যুক্তরাষ্ট্রের মুখাপেক্ষি ও নির্ভরশীল হওয়া ছাড়া কানাডার গত্যন্তর নেই।
তিন, ‘হাইব্রিড ওয়ারফেয়ার’। গোয়েন্দারা অনেক সূত্র হতেই নিশ্চিত কানাডার নিরাপত্তার আগামী বড় চ্যালেঞ্জ হবে অত্যাধুনিক ও অপ্রচলিত কৌশলের আক্রমণ মোকাবেলা করা। যেমন- ড্রোন, জীবাণু অস্ত্র, রাসায়নিক অস্ত্র, ব্রিটেনের সাম্প্রতিক আক্রমণগুলোর মত সমাবেশে গাড়ি উঠিয়ে দেয়া ইত্যাদি নানাবিধ মিশ্র ও আগে-না-দেখা কৌশল। কানাডার নিরাপত্তা ব্যবস্থা অপ্রচলিত আক্রমণ কৌশল প্রতিহত করার উপযোগী হইয়ে উঠেনি বলেও এমন কিছু ঘটলে কানাডার একচেটিয়া যুক্তরাষ্ট্র-নির্ভর হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।
উত্তর মেরুতে বরফ গলা নাব্যতা কানাডার জন্য সুবিশাল আশীর্বাদ হবার সম্ভাবনা যেমন আছে, অভিশাপ হয়ে উঠারও সমান সম্ভাবনা আছে। চিন্তাশীল কিন্তু সন্দিগ্ধ কানাডিয়দের অনেকেই সাইবার সিকিউরিটি সমস্যা ও হাইব্রিড ওয়ারফেয়ারকে আর্কটিকের বরফ গলে যাওয়া সমস্যার উপজাত হিসেবে সন্দেহ করেন।
সব কিছু ছাপিয়ে কানাডার নিরাপত্তা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নমনীয়তার কারণ কানাডার স্ট্যাটাস ক্যুও—যেমন আছে তেমন অবস্থাটি টিকিয়ে রাখতে পারলেই বিশ্ব মোড়লের বেশি লাভ। কানাডা আসলে আমেরিকার ব্যাকইয়ার্ড, হিন্টারল্যান্ড! বাড়ি-লাগোয়া সুবিস্তৃত সুবিশাল পুষ্পোদ্যান। যুদ্ধবিগ্রহ প্রবণ আমেরিকা কখন কি যুদ্ধে কোন ঝামেলায় কীভাবে জড়াবে, কোন ধরণের মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে ঠিক ঠিকানা নেই। তখন আশ্রয়-প্রশ্রয় নিরাপত্তা আয়েশের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর কানাডাই ভরসা। বাগান নষ্ট করার চেয়ে পরিপাটি রাখায় সহায়তাই বেশি কার্যকর।
কানাডা পরিবর্তনশীল দুনিয়ায় নিজের নিরাপত্তা ঝুঁকিগুলো অনুধাবন করতে পারছে। কুড়ি বছরব্যাপী অতিরিক্ত ৩২ হতে ৬২ বিলিয়ন ব্যয় নির্ধারণই তার প্রমাণ। কিন্তু এই বরাদ্দ আসল প্রয়োজনের তুলনায় ছিঁটেফোঁটা মাত্র। আগামী বছরগুলোতে কানাডা নিরাপত্তা ব্যয় আরো কয়েকগুন বাড়ানোর ঘোষণা দিলেও অবাক হবার কিছু থাকবেনা বরং সেটিই হবে বাস্তবসম্মত।
কৈফিয়তঃ
আমি নিরাপত্তা বিশ্লেষক মোটেই নই। তবু নানা জনের নানা প্রশ্নের মুখে নিরাপত্তা বিষয়ে কিছু পড়াশোনা করি এবং ডাইভার্সিটি টাইমস পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখার সুবাদে এই প্রসঙ্গেই লিখি। সম্পাদক সাহেব বললেন— তোমার আলোচনার সঙ্গে শতভাগ সহমত। তবুও পত্রিকার মেজাজ ঠিক রাখতে গিয়ে সেনসিটিভ বিশ্লেষণগুলো কেটেকুটে ছাপছি। দরকারি মেনেও বাদ দিচ্ছি। কাটাকাটির পর পড়তে ভালো লাগছে না শুনে সম্পাদক সাহেব পরামর্শ দিলেন তুমি মূল কথাটি নির্দ্বিধায় অন্য কোথাও লিখো। আগ্রহীদের জন্য ইংরেজিতে লেখা ডাইভার্সিটি টাইমস এর লিংকটি— http://thediversitytimes.ca/2017/06/07/june/ পৃঃ ৯।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)