ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে সরকারি সম্মানির বাইরে কোন আয়ের উৎস নেই স্বঘোষিত ‘জনতার কমিশনার’ তারেকুজ্জামান রাজীবের। ২০১৫ সালের সিটি নির্বাচনের আগে কোনো দৃশ্যমান ব্যবসাই ছিল না তার। তবুও অবৈধ আয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন ‘মোহাম্মদপুরের সুলতান’ রাজীব।
রাজীবকে আটকের পর তাকে সঙ্গে নিয়ে মোহাম্মদপুরের বাসা ও কার্যালয়ে তল্লাশি চালায় র্যাব। রাতভর এ তল্লাশি অভিযানে শুধুমাত্র ৫ কোটি টাকার চেক ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি। র্যাবের ধারণা, আগে থেকেই সতর্ক থাকায় কাউন্সিলর রাজীব আর্থিক লেনদেনের আলামত সরিয়ে ফেলেছেন।
অভিযান শেষে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন: আমরা মোহাম্মদপুরে তার বাসা এবং অফিসে তল্লাশি করেছি। সেখানে তেমন কিছু পাইনি। কারণ আমরা যা বুঝতে পেরেছি তার বাড়িতে আর্থিক লেনদেনসংক্রান্ত যেসব ডকুমেন্ট ছিল সেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
তবে তারই একজন সহযোগীর আত্মীয়ের বাড়ি থেকে একটি চেকবই উদ্ধার করা হয়েছে। বইটিতে দেখা গেছে, ব্র্যাক ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্টে একদিনে (তিনটি চেকের মাধ্যমে) পাঁচ কোটি টাকা জমা দেওয়া হয়েছে। আমরা এগুলো তদন্ত করে দেখছি কোথায় টাকা জমা দিয়েছেন, টাকাগুলো কোথায় গিয়েছে।
রাজীবের বিরুদ্ধে আপাতত অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটি মামলা হবে জানিয়ে তিনি বলেন: অর্জিত আয়ের উৎস এবং অর্থ পাচার পাচারের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন এবং এই অর্থ তিনি কোথায় খরচ করেছেন দেখা হবে। যদি এখানে মানি লন্ডারিংয়ের কোনো বিষয় থাকে তখন তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলা হবে।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন: রাজীবের সহযোগী এবং তার সঙ্গে জড়িত রয়েছে এমন আত্মীয় বা অনাত্মীয় প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা তো আসলে তার বৈধ আয়ের কোনো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। তার যে একটি রাজকীয় বাড়ি রয়েছে এ বাড়িটির বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। বাড়ির প্রত্যেকটা আসবাবপত্র থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা জিনিস সে দেশের বাইরে থেকে আমদানি করে এনেছে। এসব তার জ্ঞাত আয়ের বহির্ভূত অর্থাৎ অবৈধ আয় দিয়ে তিনি এসব করেছেন বলে আমাদের মনে হয়েছে।রাজীবের বিরুদ্ধে অন্য যেসব অভিযোগ এসেছে, সেগুলোও তদন্ত করে দেখা হবে।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেন: জমি কেনাবেচা করে এমন তিনটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাজিবের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পেয়েছেন তারা।
“এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত থেকে মূলত জমি দখলের কাজটি সে করত। কোনো ভুক্তভোগী জমি দখলের অভিযোগ নিয়ে আমাদের কাছে এলে আমরা তাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করব।”
যে ব্যাংকে রাজিবের পাঁচ কোটি টাকা জমা দেওয়ার রশিদ পাওয়া গেছে, সেখানে খোঁজ নিয়েও প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান র্যাবের এই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
সারওয়ার আলম বলেন: কাউন্সিলর হওয়ার আগ পর্যন্ত তার দৃশ্যমান কোনো ধরনের ব্যবসা বা পেশা ছিল না। বর্তমানে সিটি করপোরেশন থেকে যে সম্মানি পায় সেটা তার একমাত্র প্রধান আয়। এছাড়া যে অবৈধ লেনদেনেরর বিষয়গুলো রয়েছে, সেসব তদন্ত সাপেক্ষে বেরিয়ে আসবে।
এর আগে শনিবার রাতে রাজীব আটক হওয়ার পর তাকে যুবলীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কার করার কথা জানান সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ।
তিনি বলেন: চলমান অভিযানে যুবলীগের কেউ দুর্নীতি বা অন্য কোনো কারণে গ্রেপ্তার হলে তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা ছিল আমাদের। সেই মোতাবেক রাজীবকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
২০১৫ সালে কাউন্সিলর নির্বাচনে তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। দলীয় প্রার্থী ও মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ সভাপতি শেখ বজলুর রহমানকে হারিয়ে নির্বাচিত হন তিনি।
মোহাম্মদপুর এলাকায় যুবলীগের রাজনীতি দিয়েই রাজীবের রাজনৈতিক জীবন শুরু। অল্পদিনেই নেতাদের সান্নিধ্যে মোহাম্মদপুর থানা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক পদ বাগিয়ে নেন। এরপর অভিযোগ আছে, কেন্দ্রীয় যুবলীগের এক নেতাকে এক কোটি ২০ লাখ টাকা দিয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন রাজীব।
বেশ কিছুদিন ধরে আলোচনার মধ্যেই শনিবার দিনগত রাতে বন্ধুর বাসায় আত্মগোপনে থাকা রাজীবকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এসময় ওই বাসা থেকে সাতটি বিদেশি মদের বোতল, একটি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন, তিন রাউন্ড গুলি, নগদ ৩৩ হাজার টাকা ও একটি পাসপোর্ট জব্দ করা হয়।
র্যাব জানায়: সন্ত্রাসবাদ, চাঁদাবাজি এবং দখলদারিত্বের মতো সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে রাজীবকে আটক করা হয়েছে। পরে তাকে সঙ্গে নিয়ে রাতভর মোহাম্মদপুরে তার বাসা ও কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয়।