বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি, একাত্তরের পরাজিত শক্তি- জামায়াত ও পাকিস্তানি থেকে শুরু করে ডানপন্থী এবং অতি-সুশীলরা দাবি করেন, একাত্তরে বিহারীদের উপর গণহত্যা চালানো হয়েছিল। এ নিয়ে দেশে বিদেশে এই প্রো-পাকিস্তানি গং নানান সময়ে বিচার দাবি করেছিল। তাদের দাবি, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ৫ লক্ষ বিহারীকে হত্যা করা হয়েছিলো।
এই সংখ্যাটি দেখে মনে পড়লো, ১৯৭৪ সালে করাচি থেকে প্রকাশিত কুতুবউদ্দিন আজিজ নামের এক পাকিস্তানী সাংবাদিকের সম্পাদিত বই ‘ব্লাড এন্ড টিয়ার্সের’ কথা। এই বইটি হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে। এই বইটিতে বলা আছেঃ আওয়ামী লীগ সর্মথকরা পূর্ব পাকিস্তানে ১ থেকে ৫ লক্ষ বিহারীকে হত্যা করেছে। তাদের দাবি করা ৫ লক্ষ বিহারীর সংখ্যাটি সম্ভবতঃ এখান থেকেই নেয়া।
এই কাল্পনিক বিহারী হত্যার গল্পটি খুব কাঁচাভাবে ফেঁদেছিল সাংবাদিক আজিজ আর এই কাঁচা রূপকথার গল্পকে সত্য দাবি করেছিল হামুদুর রহমান কমিশন। এখন আসুন বাস্তবতার দিকে তাকাই।
আওয়ামী লীগপন্থীরা পূর্ব পাকিস্তানে একাত্তরে এত বিহারী হত্যা করলো, অথচ পৃথিবীর কোন সংবাদমাধ্যম এ নিয়ে কোন রিপোর্ট করলো না কেন? বিদেশী সংবাদমাধ্যমের কথা ছেড়ে দিই; পাকিস্তানের দুই অংশের কোন সংবাদমাধ্যম কেন এ নিয়ে রিপোর্ট করলো না? এমনকি পাকিস্তানপন্থী কোনো সংবাদমাধ্যমেও এই বিষয়ক একটি লাইন কেন খুঁজে পাওয়া যায় না। একাত্তরে পাকিস্তানের পরমমিত্র আমেরিকার কোনো সংবাদমাধ্যমেও এই বিষয়ে কোনো সংবাদ নেই বরং আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় ভিন্নচিত্র দেখা যায়, তা নিচে উল্লেখ করবো।
কিন্তু বিপরীত অর্থাৎ সত্য ঘটনাটিই সেই সময়কার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে; তা হলোঃ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী, বিহারী ও তাদের বাঙালি দোসরদের হাতে বাঙালিদের গণহত্যা, ধর্ষণ ও ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনা। তথ্য-উপাত্ত দিয়ে এটি বর্তমানে একটি প্রমাণিত সত্য যে, একাত্তরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী, বিহারী ও দালালরা ত্রিশ লক্ষাধিক বাঙালিকে হত্যা করেছিল, পাঁচ লক্ষ বাঙালি নারীকে ধর্ষণ করেছিল।
হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট ও কুতুবউদ্দিন আজিজ বলছে, একাত্তরে ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া জাতীয় অধিবেশন স্থগিত করলে আওয়ামীপন্থীরা বিহারীদের গণহত্যা শুরু করে। পাকিস্তানিদের এই দাবিটি যে নিছক উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রোপোগান্ডা ও রূপকথা, তার প্রমাণ হলো, সারাবিশ্বের সংবাদপত্র বলছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আহবানে বাঙালিরা ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন করেছে। এবং এই সময়টিতে পাকিস্তান সরকার ও বিহারীরা মেতে উঠেছিল বাঙালি হত্যার হোলিখেলায়। অর্থাৎ, কোন স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বাঙালি কর্তৃক বিহারী নির্যাতনের কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না, এমনকি পাকিস্তান ও তাদের দালালদের দাবিকৃত এই গণহত্যার কোন নির্যাতিতের যৌক্তিক ভাষ্য বা প্রমাণ পাওয়া যায় না। শুধু পাওয়া যায়, পাকিস্তানপন্থীদের স্থূল দাবি, যার পক্ষে তারা কোন যৌক্তিক প্রমাণ উপস্থাপন করেনি।
পুরো একাত্তর জুড়ে বিহারীরা বাঙালিদের কচুকাটা করে, পাকিস্তান আয়োজিত পৃথিবীর নৃশংসতম একটি জাতিগত ধোলাইয়ে অংশ গ্রহণ করে বিহারীরা। পূর্ব পাকিস্তানে বিহারীরা জাতি হিসেবে বাঙালি গণহত্যায় অংশগ্রহণ করেছিল। চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়তলী, হালিশহর, পতেঙ্গা, চকবাজার, লালখান বাজার এলাকাগুলোতে বিহারীরা গাছের পাতা ছেঁড়ার মত করে বাঙালিদের গণহত্যা-ধর্ষণ করেছিল। সেই সময়ের পত্রিকায় এর বর্ণনা পাওয়া যায়।
ঢাকার মিরপুরে বিহারীদের বর্বরতা বর্ণনা নতুন করে দেয়ার কিছু নেই। মিরপুরকে বাঙালির জন্য দোজখখানা বানিয়েছিল সেখানকার বিহারীরা। পূর্ব পাকিস্তানে সবচেয়ে বড় বিহারী অধ্যুষিত অঞ্চল সৈয়দপুরে কি বর্বরতার সাথে বাঙালিদের হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতন করেছিল বিহারীরা। সৈয়দপুর হয়ে গিয়েছিল বাঙালির শ্মশানখানা। একাত্তরের ২৫ মার্চ সৈয়দপুরে রেলওয়ের ওয়ার্কশপে বাঙালিদের জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিল বিহারীরা। খুলনায় বিহারীদের বাঙালি নির্যাতনের কথা পড়তে যেয়ে যে কেউ শিউরে উঠবেন।
মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় জুড়ে বিহারীরা সেখানে পাকিস্তান বাহিনীর হয়ে বাঙালি গণহত্যায় লিপ্ত ছিল। বিহারীরা নিজেদের ভাবতো আশরাফ তথা উচ্চ মর্যাদার মুসলমান। তারা বাঙালিদের ভাবতো আতরাফ মানে নিঁচু জাতের মুসলমান। বিহারীরা ভাবতো, বাঙালি মুসলমানরা হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির চর্চাকারী অবিশুদ্ধ মুসলমান। তাই, তারা পাকিস্তানি ও বাঙালি দোসরদের সাথে একজোট হয়ে গণহত্যা-ধর্ষণ তথা জাতিগত ধোলাইয়ের মাধ্যমে পাকিস্তানের অনুগত বিশুদ্ধ বাঙালি মুসলমান জাতির সৃষ্টি করতে চেয়েছিল।
একটি প্রশ্ন আসতে পারে, একদমই কি বিহারীরা একাত্তরে মারা যায়নি? এর উত্তর, হ্যাঁ, বিহারীরাও মরেছে একাত্তরে। তবে, তা বাঙালি কর্তৃক পরিকল্পিত কোন গণহত্যা বা হত্যাকান্ড ছিল না। বিহারীরা মারা পড়েছিল সন্মুখ সমরে। বিহারীরা একাত্তরে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে প্রত্যক্ষ সহায়তা করেছিল, অংশগ্রহণ করেছিল বাঙালি গণহত্যা ও ধর্ষণে, আর এই উদ্দেশ্যে গঠন করেছিল আল-শামস বাহিনী। যেসব বিহারী মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের হাতে মারা পড়েছিল, তাদের প্রায় সকলেই আল-শামস বাহিনী, রাজাকার ও আল-বদর বাহিনীর সদস্য ও পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সহযোগী ঘাতক।
যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজেক্ট ‘মাইনরিটি এট রিস্ক’ একাত্তরে এই মৃত বিহারীদের একটি সংখ্যাতাত্ত্বিক তথ্য দিচ্ছে, তা হলো- একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় এক হাজার বিহারী এভাবে মারা গেছে। কোথায় ৫ লক্ষ আর কোথায় এক হাজার! এছাড়া এই এক হাজার বিহারী নিরীহ-নিরস্ত্র কেউ ছিল না এবং এরা পরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়নি, এরা ছিল পাকিস্তান আধা-সামরিক বাহিনী সদস্য ও সন্মুখ সমরে নিহত হয়েছে।
এবার দৃষ্টি ঘুরানো যাক তাদের প্রতি, যারা একাত্তরে কল্পিত এই বিহারী গণহত্যার বিচারের দাবি করছে। এই দাবি যারা করেন- তারা হয় বিএনপি-জামায়াতের সদস্য, পাকিস্তানী অথবা জামাত-আইএসআই কর্তৃক পেইড লবিস্ট-একটিভিস্ট। কেন তারা কল্পিত বিহারী হত্যাকাণ্ডের প্রোপাগান্ডা বাজারজাত করছে? এর উত্তরটি সরল; বর্তমানে একাত্তরে বাংলাদেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলছে। আর এতে মানবতাবিরোধী সর্বোচ্চ অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আদালত কর্তৃক সাংবিধানিক ও আইনতঃভাবে একের এক পাকিস্তানের অনুগত খুনি দালালদের রায় কার্যকর হচ্ছে।
এই সব অপরাধীরা যে পাকিস্তানের এজেন্ট, তা তাদের রায় কার্যকর হবার পর ও এই বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াতে স্পষ্ট হয়ে উঠে। বাংলাদেশে তাদের এইসব চিফ এজেন্টদের বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পাকিস্তান। আর এর জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের কাজ বাধাগ্রস্থ করা। এই অপচেষ্টার কৌশল হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একাত্তরে কল্পিত-বানোয়াট বিহারি গণহত্যার বিচারের দাবি তুলছে পাকিস্তান ও জামাতের পেইড লবিস্ট, একটিভিস্ট ও সদস্যরা। এসব পাকিস্তান-আইএসআই-জামায়াত-বিএনপির বহুল চর্চিত অপকৌশল। এসবে বিভ্রান্ত না হতে আহবান জানাই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)