‘দাদা খেয়ে এসেছেন নাকি গিয়ে খাবেন?’
‘দাদা, অনেকদিন পর বেড়াতে এসছেন! আর্ধেক ডিমের পুরোটাই কিন্তু খেতে হবে!’
পশ্চিমবঙ্গের মানুষের আতিথিয়তা নিয়ে এধরনের কিছু ট্রল প্রচলিত আছে। আতিথিয়তার ক্ষেত্রে তাদের কার্পণ্যতা বুঝাতে এসব বাক্যের প্রচলন!
আসলে এসব লোকমুখে প্রচলিত, কথার কথা। এর কোনো সত্যতা আছে বলে মনে করি না। কোনো অতিথিকে দাওয়াত দেওয়ার পর মানুষ কিভাবে প্রশ্ন করতে পারেন যে, খেয়ে এসেছেন নাকি গিয়ে খাবেন? কিংবা আর্ধেক ডিমের আবার পুরোটাই বা কী! এটা কোনো কথা হলো? অর্ধেক ডিমের কি আর পুরোটা কখনো হয়??
আমার মনে হয় না যে, এভাবে কেউ বলতে পারেন! বিভিন্ন সময় কলকাতায় ভ্রমণ করে অন্তত তেমন ঘটনার মুখোমুখি হইনি আমি। দুয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে কলকাতার মানুষের আতিথিয়তায় তেমন একটা ঘাটতি চোখে পড়েনি। আসলে কোনো একটি ঘটনা ঘটার চেয়ে আমরা রটানোয় ন্যাস্ত থাকি বেশি। অবাস্তব কোনো বিষয় বারবার বললে তা বাস্তবে পরিণত হয়!
এসব ট্রল অস্বীকার করলেও কলকাতার মানুষগুলো খাবার-দাবারের ব্যাপারে একটু কম সৌখীন; এটি মানতে হবে। যেমনটা বাংলাদেশের মানুষের মাঝে আছে, তা তাদের মাঝে অনুপস্থিত। বিশেষ করে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মানুষকে তো খাবারের বেলায় আমেরিকানদের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।
শুনেছি, ‘আমেরিকানরা খাওয়ার জন্য বাঁচে। আর বাঙালি বাঁচার জন্য খায়’। চট্টগ্রাম-কক্সবাজারবাসীও নাকি আমেরিকানদের মতো খাওয়ার জন্য বাঁচে। অতিথি পেলে নানা প্রকারের রান্নার আইটেম নিয়ে ডাইনিং টেবিল পূর্ণ করে দেয় চাটগাঁইয়ারা। কলকাতার লোকজন তার ঠিক বিপরীত। তারা এক বা দুটি আইটেমেই চালিয়ে দেয় সাধারণত। তবে সেসবে আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি থাকে বলে মনে হয় না।
একবার কলকাতার এক বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে মজার ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলাম আমি। রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে রাত্রিযাপন করতে যাই। বাহির থেকে খাওয়ার কথা শুনে ওই বাড়ির কাকিমা এসে গলা ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘এইডা কি করলে গো তুমি? তোমার জন্য এত্তগুলা ডাল আর আলু রান্না করে রেখে দিয়েছি। দেখতো এবার, এই খাবারগুলো যদি নষ্ট হয়ে যায়! খাবার নষ্ট করা ঠিক না গো! সকালে উঠে কিন্তু খেতে হবে. সুনছো?‘!
কাকিমার এমন কথা শুনে হাসি আটকে রাখা কষ্ট হচ্ছিলো আমার। তবু চাপিয়ে রেখে মনে মনে বললাম, ‘খেয়ে এসেছি, বেশ করেছি’! আর রাতের খাবার সকালে খেতে হবে ভাবতেই পেটটা মোচড় দিয়ে উঠলো!
সেদিন ভোরেই আমি সবার আগে উঠেই ব্যস্ততা দেখিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম ঘর থেকে। ডাল আর আলু রান্না খাওয়ার ধকল থেকে বাঁচা গেলো বলে অনেক প্রশান্তি পেয়েছিলাম!
এই একটা তুচ্ছ ঘটনা বাদে অন্যান্য সময় আমি বেশ সমাদরই পেয়েছি কলকাতায়। একদিক থেকে ভাবলে ওই তুচ্ছ ঘটনাও তো খাওয়ানোর আকুতি ছিলো। সেটাও তো আন্তরিকতায়পূর্ণ, তিনি হয়তো ওই খাবারকেই অনেক বড় করে দেখছেন, সেটাই হয়তো তার আতিথিয়তা! কাজেই দাদা-দিদিদের আন্তরিকতার ঘাটতি আছে বলবো না। এবার কলকাতা ভ্রমণে শুরু থেকেই আমাদেরকে আতিথিয়তায় মুগ্ধ করেছেন কলকাতার মানুষগুলো।
এই বিষয়ে পরের কোনো পর্বে লেখা হবে। এখানে কিছু বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। এই লেখার প্রথম পর্ব যেখানে শেষ করেছিলাম, সেখান থেকেই শুরুটা করা যাক!
২ সেপ্টেম্বর আমাদের গ্রিনলাইন বাস যাত্রা করলো কলাবাগান থেকে কল্যাণপুর, গাবতলী হয়ে মাওয়া ফেরিঘাটের দিকে। ১৯ জন তরুণ তুর্কি বাসে। মনে তাদের হাজারো স্বপ্ন, মুখে বিজয়ের হাসি, বুকে সিন্ধু সভ্যতা চূর্ণ-বিচুর্ণ করার দুঃসাহস! আনন্দে-আহ্লাদে যাত্রা হচ্ছে, সবাই চলছি দাদা বাবুদের শহর লক্ষ্য করে৷
রাত ১২টার দিকে বাস ফেরিঘাটে ঠেকে।একটার পর একটা বাস ফেরিতে উঠানো হচ্ছে। আমাদের বাসটিও উঠে পড়লো। কয়েক মিনিট পরই পদ্মার বুক চিড়ে যাত্রা শুরু করলো ফেরি। অনেক বোঝা বয়ে নিয়ে চলেছে একাই। পদ্মার উত্থাল ঢেউয়ে হালকা দুলতে দুলতে ফেরি চলছে সামনের দিকে।
আমাদের টিমের অনেকের কাছে ফেরি একেবারে নতুন বাহন। রাতের পদ্মার জল দেখাতে তাদের কয়েকজন নিয়ে ফেরির ওপরের তলায় চলে যাই আমি। ওপর থেকে পদ্মার জল দেখতে রোমাঞ্চকর লাগে। আলো-আঁধারির জোনাকির পোকার মতো দূর-দূরান্তের বাত্তিগুলো ঝিলমিল করছে পদ্মার জলে। ফেরিতে যেতে যেতে মনে মনে সেই গানটি আসছিলো বারবার, ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিবরে, আমরা কজন নবীন মাঝি’,,,
নবীন মাঝিই তো আমরা। আমাদের স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়ার, নতুন কিছু জয়ের, একটি নতুন সমাজ বিনির্মাণের, সুন্দর পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন আমাদের তরুণ গবেষকদের চোখে-মুখে। তাই তো গবেষণা সংসদের স্লোগান- ‘একটি সুন্দর পৃথিবীর জন্য গবেষণা’। এই স্লোগান বাস্তবায়ন করতেই আমরা নেমে পড়েছি বহু চ্যালেঞ্জ নিয়ে, সীমাবদ্ধতা, আর কঠিন পথ পাড়ি দেওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে আমরা চলেছি একসূত্রে।
পদ্মার বুকে ঝিলমিল আলোর খেলা দেখতে দেখতে ফেরি এসে ভীড়ে তীরে। বাসটি মহাসড়কে চলতে শুরু করেছে এবার। ততোক্ষণে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সবাই। আমার চোখে ঘুম আসি আসি করেও আসে না। কি যেন ভাবনায় ঘুম ভেঙে যাচ্ছে বারবার। জ্যোসনা প্লাবিত চাঁদের দিকে চোখ চলে যাচ্ছে প্রতিবার। পাশে বসে যাওয়া প্রিয় মানুষগুলোর ঘুম দেখে নিজেকে চাঁদের মতো একা লাগছিলো। তবে এক সময় বাসের জানালার ফাঁক দিয়ে জ্যোসনার রোমাঞ্চ দেখতে দেখতে কখন যেন ঘুমিয়ে তলিয়ে গেলাম বুঝতে পারিনি। জেগে দেখি আমরা যশোর পেরিয়ে বেনাপোলের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। ততোক্ষণে সূর্য উঠে গেছে। মৃদু রোদে শরীরে একটা ভাব এসেছে। রাতভরের জার্নিকে জার্নিই মনে হচ্ছে না। ক্লান্তি নেই। কেন যেন মনে হচ্ছে, এভাবে অনেক রাত জার্নি করে যেতে পারবো। এই পথে তার দরকার পড়ছে না। ফলে বাস থেকে আমরা বেনাপোল সীমান্তে নেমে পড়লাম। তারপর ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্টটা সেরে নিলাম।
সড়ক পথে যাত্রায় দুই দিকের ইমিগ্রেশনটাই যতো ঝামেলা! এদিকে বেনাপোল, ওদিকে পেট্রাপোল। একই স্থান; কিন্তু দুদেশের দুটি নাম। এক পা এপারে, অন্য পা ওপারে রাখা যায়! এতো কাছে, তবু কতো দূরে মনে হয় সবকিছু! এভাবে ভাগ হয়ে গেলো দু বাংলা, সেটা সাতচল্লিশে। বিভক্ত হয়ে গেলাম একই ভাষার একটি জাতি ‘বাঙালি’। তাও শুধু ধর্মের অজুহাতে! এসব ছোটলোকি কিভাবে আমাদের পূর্বসূরিরা করতে পেরেছিলেন, ভাবতেই অবাক লাগে! অবশ্য তা ছিলো ‘ডিভাইড এন্ড রুলস’ পলিসি প্রয়োগকারী সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদেরই চক্রান্ত!
তাদের সেই বিভক্তিই বাঙালি জাতির জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। ধর্মের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে গেলো। আর তার বলি হলো নিরীহ কিছু মানুষ। হঠাৎ তাদের দেশ পরিবর্তন হয়ে গেলো, এপার থেকে ওপারে দৌঁড়ঝাপ শুরু হয়ে গেলো। আমাদের কলকাতা হয়ে গেলো আজ আমাদের জন্য ভিন্ন দেশ, ওপার! ওপারে পার হতেই আজ আমাদের এতো পরিশ্রম।
ইমিগ্রেশনের ঝামেলা এড়াতে বেনাপোল কাস্টমসে একজন পরিচিত মুখ খুঁজছিলাম। গতবার কলকাতা থেকে ফেরার সময় মহসীন হলের সাবেক একজন শিক্ষার্থীর দেখা পেয়েছিলাম। যিনি বেনাপোল সীমান্তে কাস্টমস অফিসার হিসেবে কর্মরত। সেই আনিসুর রহমান ভাইকে মনে মনে খুঁজছিলাম। মোবাইলে নাম্বার সার্চ করে নাম্বারটি পেলাম না। কয়েকদিন আগে ফোন বেকআপ দেওয়ায় অনেকের নাম্বারের সঙ্গে আনিস ভাইয়ের নাম্বারও হারিয়েছি। আনিস ভাইকে পেলে ইমিগ্রেশনে ১৯ জন মানুষের লাইন এড়িয়ে যাওয়া যেতো। সেটা ভাবতে ভাবতে মাহবুবুল হক মেহেদী জানালো তার পরিচিত একজন কাস্টমস অফিসারের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি আমাদের অপেক্ষায় আছেন ইমিগ্রেশনে সহযোগিতা করার জন্য।
মাথা থেকে একটা দুশ্চিন্তা নেমে গেলো মেহেদীর কল্যাণে। অনেকগুলো লাগেজ আমাদের। এসব নিয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো কঠিন। কাস্টমস অফিসার সালাউদ্দিন রাজু ভাই কাজটি সহজ করে দিলেন। ফলে কম সময়ের মধ্যে ওপারে ভারতীয় ইমিগ্রেশনে চলে যাওয়া সহজ হলো।
ভারতীয় ইমিগ্রেশন পুলিশ অকারণেই প্রতিজনের কাছ থেকে ১০০ করে আদায় করে থাকে। আমি বুঝিয়ে বললাম, আমরা পশ্চিবঙ্গের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাচ্ছি। সব কাগজপত্র ঠিক আছে। টাকা নিয়েন না। কিন্তু তারা নানা অজুহাত দেখাতে শুরু করলেন। অনেক জোরাজুরি করে ১৯ জনের জন্য ঠিকই ১০০০ হাজার টাকা আদায় করে নিলো পুলিশ। উপমহাদেশে পুলিশ নামটি একটি আতঙ্কের নাম পরিণত হওয়ার পেছনে এসব ছোটখাটো অনিয়মও দায়ী। নিয়মের বাইরে গিয়ে নতুন নিয়ম তৈরি করেছে ১০০ টাকা করে নিয়ে। এটা একেবারেই অনৈতিক!
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ঝামেলা পেরিয়ে মূল ইমিগ্রেশনে গেলাম। সবার ইমিগ্রেশন দ্রুত শেষ হলেও আমারটাই একটু দেরি হলো। গতবার এক্সিট পারমিট নিয়ে দেশে এসেছিলাম পাসপোর্ট হারিয়ে। সেটা তারা এন্ট্রিতে পাচ্ছে না। পরে অন্য এক অফিসার তার পিসিতে খোঁজে পেলেন। এরপর ইমিগ্রেশন শেষ করা গেলো।
গ্রিনলাইনের পেট্রাপোল কাউন্টারে গিয়ে ডলারগুলো রূপি করে নিই এবং ভারতীয় সীম কিনে নেওয়া হলো। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিলো আমাদের কলকাতাগামী বাস। পেট্রাপোল থেকে বাসে কলকাতা যেতে সাড়ে তিন ঘণ্টার মতো লাগে। একই দূরত্বে ট্রেনে গেলে আড়াই ঘণ্টা। আমাদের বাস ছেড়ে দিলো। ওদিকে আমাদের জন্য অপেক্ষায় আছেন বেঙ্গল ইনস্টিটিউ অব পলিটিক্যাল স্টাডিজের প্রতিনিধি ও সংগঠনটির নির্বাহী সদস্য জয়প্রকাশ দা। আমাদেরকে রিসিভ করার জন্য অপেক্ষা করার কথা আগেই জানিয়েছেন তিনি। আমাদের গন্তব্য সল্ট লেক স্টেডিয়ামের ইয়ুথ হোস্টেল। তিনি সেখানেই অপেক্ষায় থাকার কথা। বাসে যেতে যেতে বারবার তার ফোন পাচ্ছি। আমাদের বাস পৌঁছাতে দুপুর প্রায় আড়াইটা বেজে গেলো। আর তিনি অপেক্ষায় আছেন সাড়ে ১২টা থেকেই।
আমরা উল্টোডাঙ্গা নেমে ট্যাক্সি করে সোজা চলে গেলাম সল্ট লেক স্টেডিয়ামে। প্রথমেই জয়প্রকাশ দার সঙ্গে সাক্ষাত। ফুলের তোড়া নিয়ে এসে আমাদেরকে উষ্ণ অভ্যর্থানা জানালেন, শুভেচ্ছায় সিক্ত করলেন গবেষণা সংসদের তরুণ গবেষকদের। ওপারে এসে এমন অভ্যর্থনা আমরা প্রত্যাশা করিনি। অপ্রত্যাশিত কিছু পেয়ে বেশ ভালোই লাগলো।
সহজ-সরল, বিনয়ী জয়প্রকাশ দাকে আমি প্রথমে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভেবেছিলাম। পরে জানলাম তিনি কলকাতার একটি কলেজের পলিটিক্যাল সায়েন্স ডিপা্র্টমেন্টের সহকারী অধ্যাপক! জয় প্রকাশ দা বিনয়ী সুরে জানালেন, ‘এবার আমাকে যেতে হবে। আপনারা দীর্ঘ পথ জার্নি করে ক্লান্ত। এখন রেস্ট নিন। আপনাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে যাদবপুর এবং কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের কনফারেন্সে’-
একথা বলে জয়প্রকাশ দা তার গন্তব্যের দিকে চললেন। আমি তার বিনয়ী আচরণের কথা ভেবে মনে মনে বলছিলাম, জয় হোক জয়প্রকাশ দা এবং তার মতো সকল জ্ঞানী ও বিনয়ী মানুষের। আমি জ্ঞানী ও বিনয়ী মানুষের পুঁজারী!
#চলবে…