চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

করোনা লকডাউন

সবে ফোনটা রাখলো কুনাল। পাক্কা চল্লিশ মিনিট। কী আর করার আছে এই লকডাউনের বাজারে? গোটা সপ্তাহ জুড়ে ওয়ার্ক ফ্রম হোমের অত্যাচার, আর উইক এন্ডে একে ওকে ফোন। কুনাল আগে এখানে- নিস শহরেই থাকত। মাস ছয়েক হল চাকরি বদলে ইউরোপের আরও উত্তরে পোল্যান্ডে চলে গিয়েছে।

যে কথা হচ্ছিল আরকি, এমন একটা পরিস্থিতি ইউরোপের অনেক মানুষই প্রথমবার দেখছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমকালীন প্রজন্মের হাতে গোনা কিছু বয়স্ক মানুষ দেখে থাকলেও থাকতে পারেন। এখনকার  মিলেনিয়ামদের একেবারেই সে দুর্ভাগ্য সইতে হয়নি। তবে যারা গত কয়েক বছর তুরস্কের রাজনৈতিক উত্থান পতনের স্বাক্ষী, তাদের ব্যাপারটা একটু আলাদা। তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতার চেয়ে ইউরোপের হালফিলের লকডাউনের ধরনটা একেবারেই আলাদা। মাথার উপর দিনরাত রাষ্ট্রীয় চোখরাঙানি নেই-চারপাশে ফিসফিসে মিলিটারি আতঙ্ক নেই-টেলিফোনে কলিগদের দেশ ছেড়ে পালিয়ে বাঁচার খবরের মূহ্যমানতা নেই। যেটা আছে- তা শুধুই একটা অজানা অচেনা মৃত্যুচেতনা। সমকালীন ইউরোপের এই করোনা মহামারীর নাড়ি বুঝতে হলে প্রথমেই একটু ইতিহাসের পাতায় ডুব দেওয়া প্রয়োজন।

এপিডেমিক শব্দটার উত্থান ইউরোপের গ্রিসে। এপি অর্থে উপর আর ডেমস অর্থে মানুষ সেখান থেকেই ডেমোক্রেসি বা গণতন্ত্র। কোনও ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস জনিত মরণ রোগ যখন একই দেশের অনেক মানুষকে সংক্রামিত করে, তখন তাকে এপিডেমিক বা মহামারী বলে। আবার সেই এপিডেমিক যখন এক দেশের সীমান্ত পার করে পড়শি দেশ মহাদেশ বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে- তখন তারই নাম হয় প্যানডেমিক বা অতিমারী। ইউরোপকে কিন্তু প্লেগ, স্মলপক্স এবং কলেরা মহামারীর আঁতুড়ঘর বলা যেতেই পারে।

সময়টা খ্রিষ্টপূর্ব চারশো ত্রিশ থেক চারশো ছাব্বিশ পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধের সমকালীন এথেনীয় প্লেগ লাখ খানেক মানুষের প্রাণনাশের কারণ হয়। রাজনীতিবিদ পেরিক্সের জীবনাবসান তার মধ্যে অন্যতম। ক্লাসিকাল গ্রিসের পতনের অন্যতম কারণ এই এথেনীয় প্লেগ। থুসিডাইডিস যিনি এই রোগ থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁর অনবদ্য তথ্যবয়ানে মহামারির একটি পর্যাপ্ত ক্লিনিকাল চিত্র তৈরি করেন। সেই সময়ে কোনও রোগের সঙ্গে মিল না থাকায় এই মহামারীর সূত্র পর্যন্ত থুসিডাইডিস পৌছতে পারেননি ঠিকই তবে এই ভাইরাস যে তার বাহককে খানিকটা প্রতিরোধক্ষমতা প্রদান করে তা ওর কাজে স্পষ্ট। নথিভুক্ত ইউরোপীয় মহামারীর মধ্যে এর পরেই উল্লেখযোগ্য জাস্টিনিয়ান প্লেগ। বাইজান্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ানকে বিজিত মিশরের উপহার হিসেবে পাঠানো শস্য বোঝাই জাহাজ ছিল ব্যাকটেরিয়ার প্রসবকক্ষ। সেই সময়ে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের কনস্টানটিনোপল ছাড়িয়ে দাবানলের মত এশিয়া আফ্রিকার অংশবিশেষ ছাড়াও সম্পূর্ন ইউরোপকে গ্রাস করে এই অতিমারী। জাহাজের ইঁদুরের সংস্পর্শে আসা মাছির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এই মারণ রোগ, খ্রিষ্টাব্দ পাঁচশো একচল্লিশ থেকে পাঁচশো বিয়াল্লিশ এই এক বছরে কেড়ে নেয় তিন থেকে পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণ। সমকালীন পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ।

এরপর আরও বেশ কয়েকটি মহামারীতুল্য রোগের সম্মুখীন হয়েছে প্যান ইউরোপ। তবে তার কোনওটাই তেরশো সাতচল্লিশ এর বিউবনিক প্লেগের মতো বীভৎস আকার ধারণ করেনি। জাস্টিনিয়ান প্লেগের মতোই এই রোগের সুত্রপাত ইটালির সিসিলিয়ান মেসিনায় নোঙর করা বারোটি পণ্য বোঝাই জাহাজে। প্রত্যেকটি জাহাজে ঢুকে দেখা যায় তার নাবিকেরা হয় মৃত নতুবা মুমূর্ষু। সিসিলির প্রশাসন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জাহাজগুলিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার হুকুম দিলেও ততক্ষণে অনেকটাই দেরি হয়ে যায়। তেরশো ছেচল্লিশ থেকে তেরশো তিপ্পান্ন এই সাত বছরে বিউবনিক প্লেগ ইউরেশিয়ায় প্রায় সাত দশমিক পাঁচ থেকে বিশ কোটি মৃত্যু দেখেছিল। এই মর্মান্তিক দুরবস্থার হাত থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা না থাকলেও ইউরোপের সমকালীন ডাক্তার ও জীববিজ্ঞানীরা এটা বেশ বোঝেন যে মানুষে মানুষে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারলে ভাইরাসের সংক্রমন খানিকটা হলেও আটকানো সম্ভব। সে কারণেই রাগুসার ভেনিস নিয়ন্ত্রিত বন্দর নগরীর কর্তৃপক্ষ আগত নাবিকদের জাহাজেই সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় বসবাস করার হুকুম দেন। অন্তত তাদের সুস্থতা প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত। প্রথমে নাবিকরা তাদের জাহাজে ত্রিশ দিন পর্যন্ত বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করেন। যা ভেনিশিয়ান আইনে ট্রেন্টিনো হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার সময়সীমা বাড়িয়ে চল্লিশ দিন করে দেওয়া হয় এবং সেই নিয়মের নাম হয় কোয়ারেন্টিনো। হালের করোনা প্যানডেমিক সামাল দেওয়ার প্রচলিত হাতিয়ার সোশাল কোয়ারেন্টাইন এর দাদা অবশ্যই সেই বিউবনিক প্লেগের ভেনেসিয়ান কোয়ারেন্টিনো। এরই মাঝে অবশ্যই এসে পড়বে স্মলপক্স কলেরা ও উনিশো আঠারোর স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জার কথা। বারো হাজার বছরেরও পুরনো ভারিওলা ভাইরাস জনিত স্মলপক্স রোগের প্রথম ইউরোপীয় উপস্থিতির ঐতিহাসিক প্রমান মেলে একশো পয়ষট্টি থেকে একশো আটানব্বই সালের রোমে। পনের শো শতাব্দীতে ওল্ড ও ওয়ার্ল্ড তথা ইউরোপের সঙ্গে সঙ্গে স্মলপক্সের মরণকামড় অনেক বেশি করে উপলব্ধি করেছিল মেক্সিকো বা নিউ ওয়ার্ল্ড।

আর আনুমানিক দুশো বছর পার করে আঠারো শো সালে, বিলেতের ডা. এডওয়ার্ড জেনারের হাত ধরে স্মলপক্স ভ্যাক্সিনের আগমন। সবশেষে উনিশো আশি সালে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশান পৃথিবীকে স্মলপক্স মুক্ত বলে ঘোষণা করে। উনিশ শতকের বিধ্বংসী কলেরার ক্ষেত্রেও কিন্তু ইংল্যান্ডই নেতা। ডা. জন স্মো তাঁর বৈজ্ঞানিক মেধা ও পদ্ধতিতে প্রমান করেন হাওয়া নয়- পানীয় জলই কলেরার বাহক। একশো বছর আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরে ঘটে যাওয়া স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা প্যানডেমিক গোটা যুক্তরাষ্ট্রকে শ্মশানে পরিণত করলেও তার জন্ম কিন্তু ইউরোপেই ফ্রান্সে।  গত একশো বছরে ঘটে যাওয়া সমস্থ এইচ এন ভাইরাস এপিডেমিকের পূর্বসুরী এই স্প্যানিশ ফ্লুয়ের এইচ এক এন এক ভাইরাস!

কাজেই উপরের তথ্য থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে এপিডেমিকাল- ইউরোপের নিজস্ব একটা বিস্তীর্ণ বিবর্তন ইতিহাস রয়েছে আর তার পাশাপাশি রয়েছে প্রতিটি মহামারী যুদ্ধে নতুন নতুন চিকিৎসা হাতিয়ার আবিষ্কারের অভ্যেস। যাকে বলে নেসেসিটি ইস দ্য মাদার অফ অল ইনভেনশানস।

এবার আসা যাক কোভিড১৯ সম্পর্কিত বর্তমান পরিস্থিতে। আজ ২০ এপ্রিল দুই হাজার বিশ।  দু:স্বপ্ন পিছু ছাড়ে না। সংখ্যাটা বেড়েই চলেছে রোজ।  বাইশ জানুয়ারি ইসিডিসি ইউরোপীয়ান সেন্টার ফর ডিজিস প্রিভেনশন এন্ড কন্ট্রোল এর রিপোর্ট অনুযায়ী দুই হাজার উনিশ সালের একত্রিশ ডিসেম্বর চায়নার উহান মিউনিসিপাল কর্পোরেশন তাদের সামুদ্রিক খাদ্যদ্রব্যের বাজার হিউনান হোলসেল সিফুড মার্কেট থেকে ছড়ানো নিউমোনিয়ার কথা জানায়। কিছু প্রাথমিক তদন্তের পর নয় জানুয়ারি সেই নিউমোনিয়ার জন্যে দায়ী নতুন এক জীবাণু করোনাভাইরাসের খবর পৃথিবীর কাছে প্রকাশ করেন চায়নার সিডিসি যার নাম দেওয়া হয় সিভিয়ার একিউট রেসপিরেটরি সিনডম করোনাভাইরাস দুই। পরে রোগটির নাম দেওয়া হয় করোনাভাইরাস ডিজিজ দুই হাজার উনিশ। জানুয়ারির বিশ তারিখ মোট দুইশো পঁচানব্বইটি কেস রিপোর্ট করে চীনে সিডিসি যার মধ্যে দুইশো একানব্বই দুইশো একানব্বই জন উহানের অভ্যন্তরীণ নাগরিক এবং বাকি চারজন থাইল্যান্ড জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আগত বিদেশিকর্মী বা পর্যটক। ইসিডিসি নয় জানুয়ারির রিস্ক এসেসমেন্ট রিপোর্টে কিন্তু বলেই রেখেছিল- এই রোগের বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা অনেকখানি । ইউরোপীয় নাগরিকরা চায়নার উহান অঞ্চলে আসা যাওয়ার কথা যেন দ্বিতীয়বার বিবেচনা করেন,রিপোর্টে সেই কথাও বলা হয়।

তবে প্রাথমিক কিছু সাবধানতাকে মান্যতা দিলেও কর্মক্ষেত্রে বা সাধারণ জীবনে কোনও দেশই খুব বেশি সেই রিপোর্ট পাত্তা দেয়নি। তাছাড়াও ইউরোপ বেশ কয়েক দশক সংক্রামক ব্যাধির সম্মুখীন হয়নি বললেই চলে। কাজেই এই ধরনের কোনও ভাইরাস আক্রমণকে রুখে দেওয়ার জন্য যে চিকিৎসা পরিকাঠামো দরকার তা জার্মানি ফ্রান্স ইটালি অথবা অন্য কোনও দেশের হাতেই ছিল না। তবে দরকারে একটা পর্যায় অবধি ঠেকা দিয়ে শুরুর দিকের কাজ চালিয়ে তার উপর ভিত্তি করে পরবর্তী রণকৌশল তৈরি করার মানসিকতার অভাব ছিল না কখনো।

কাজেই উহান অঞ্চলে প্রায়শই যাতায়াতকারী ইউরোপীয় ওয়ার্কফোর্সের হাত ধরে বেশ সাবলীল ভাবেই কোভিড প্রবেশ করে এই সমস্ত দেশগুলোয়। একেবারে হালে এলসেভিয়ারের একটি বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকায় প্রকাশিত ক্লিনিকাল স্টাডিতে দেখানো হয়েছে ইউরোপের প্রথম পাঁচ কোভিড রোগির সময়ানুসারিক বিবর্তন। সতেরো থেকে বাইশ জানুয়ারির মধ্যেই সংক্রামিত মানুষেরা প্রবেশ করেন ইউরোপে। তেইশ থেকে উনত্রিশ তারিখের মধ্যে ধরা পড়ে ভাইরাল ইনফেকশন। যাদের মধ্যে একজনের মৃত্যু ঘটে চৌদ্দ ফেব্রুয়ারি।

এবারে দু একটি দেশভিত্তিক তথ্যে আলোকপাত করা যাক-

চীনের সংক্রমণ ইউরোপে ছড়ানোর পর যে কটি দেশ সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের মধ্যে ইটালি অবশ্যই অন্যতম। তার পরে আছে স্পেন জার্মানি ও ফ্রান্স। ইটালির প্রতি ভালোলাগাটা ভালোবাসায় পরিণত হতে বার তিনেক যাতায়াতের বেশি সময় লাগে না। সে এমন এক দেশ যার ইতিহাস প্রকৃতি খাওয়া দাওয়া মানুষ সবকিছুই আপাদমস্তক সৌন্দর্যে মোড়া। ইউরোপীয় নন্দনতত্ত্বের উচ্চতম বিন্দু ইটালি এ কথা বলা হলেও বোধহয় অত্যুক্তি হয় না। তাই সেই দেশটা এই আকালের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ভাবলে মনটা খারাপ হয়ে যায় যে কারো। একত্রিশ জানুয়ারি দুজন চীনা পর্যটকের কোভিড টেস্টের ইতিবাচক ফলাফলের মধ্যে দিয়ে ইটালির অন্ধকার সময়ের সূত্রপাত। ওই একই দিনে রাষ্ট্র ইমারজেন্সি চালু করে এবং তাদের তরফে চীনের সব বিমান পরিষেবা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখার নির্দেশ আসে। সপ্তাহ খানেক পরে উহান ফেরত এক ইটালিয়ান পুরুষ কোভিড আক্রান্ত হিসেবে নথিভুক্ত হয়। প্রধানমন্ত্রী কন্তে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান দেশের কোভিড লড়াইয়ে তার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং তা সঠিক দিকেই এগিয়ে চলেছে।

সমস্যাটা হয় অন্য জায়গায়। এই সময়ের ভিতরে গোপনে শতাধিক সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তর ইটালির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। একুশ ও বাইশ ফেব্রুয়ারি লোম্বার্ডি অঞ্চলে প্রায় ছিয়াত্তর জনের কোভিড পজিটিভ এবং এক জনের মৃত্যুর খবর আসে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লোম্বার্ডি ও ভেনেতো অঞ্চলের এগারোটি প্রভিন্সের ছয় কোটি মানুষের কোয়ারেন্টাইনিং এর নির্দেশিকা জারি করে সরকার। পয়লা মার্চ খবরে বলা হয় সম্পূর্ণ দেশে কোভিড সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। ইটালির দুর্দশার প্রধান কারণ অবশ্যই নাগরিকদের উদাসিনতা ও সরকারি নির্দেশিকা অমান্য করার প্রবণতা। দশ মার্চ দেশব্যাপী কোয়ারেনটাইন বলবৎ হওয়ার পরেও বিশ মার্চের পুলিশ রিপোর্টে বলা হয়- বিগত আট দিনে কোয়ারেনটাইন অমান্য করার অপরাধে প্রায় তিপ্পান্ন হাজার মানুষের নাম ঠিকানা নথিভুক্ত করা হয়েছে। আজ ষোল এপ্রিল সে দেশের কোভিড রোগীর সংখ্যা দেড় লাখেরও বেশি। মৃত কুড়ি হাজার ছাড়ায়। এমন অস্থির সময়ে রাষ্ট্রের আইন না মানার ফল কত ভয়ংকর হতে পারে- ইতিহাস ইটালিকে তার জ্বলন্ত উদাহরণ হিসাবেই মনে রাখবে।

স্পেনের  সংক্রমণের ইতিহাসটাও বেশ খানিকটা ইটালির মতোই। ফেব্রুয়ারি আঠারো। জার্মান সুইস সীমান্ত ছুঁয়ে ফ্রান্সের ছোট্ট শহর মূলহাউস। ঝামেলার সূত্রপাত সেখান থেকেই। প্রত্যেক বছরের মতোই এক সপ্তাহ ব্যাপী ক্রিশ্চান ওপেন ডোর কনফারেন্স হয়েছে এ বছরেও। সারা বিশ্বের খ্রিষ্টধর্ম অবলম্বনকারীদের সমাগম কনগ্রেগেশান দু হাজারের বেশি মানুষের মিলনক্ষেত্র। রাষ্ট্র তার নাম দিয়েছে দ্য করোনা টাইম বম্ব। সেই দু হাজারের মধ্যে বেশ কিছু সংক্রামিত ছিলেন। তারাই ছড়িয়ে পড়েন দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বিগত দেড় মাসে শুধু মাত্র ফ্রান্সে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা সাত থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লক্ষ সাতচল্লিশ হাজারের বেশি।  মৃতের সংখ্যা ছুঁয়েছে প্রায় আঠেরো হাজার। আড়াই হাজারের বেশি রোগীকে মূলহাউস কনফারেন্সের সঙ্গে সন্নিবদ্ধ করেছে সরকার। ওই দুহাজার মানুষের মধ্যে মারা গিয়েছে সতেরো জন। সম্পূর্ণ লকডাউন অবশ্য চালু হয়েছে মৃতের সংখ্যা একশো আটচল্লিশ ছুঁতেই। এক মাসের বেশি হল স্কুল কলেজ অফিস প্রায় সমস্ত কিছুই বন্ধ।  তার মাঝেই বাকি দেশগুলোর মতোই প্রাণ হাতে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মী, গ্রোসারি স্টোরের কর্মচারি, ইন্ডাস্ট্রির মেনুফ্যাকচারিং ইউনিটের লোকজন শুধুমাত্র দেশের সাধারণ মানুষকে একটু বেঁচে থাকার রসদ যোগাবেন বলে।  রাষ্ট্র সন্ত্রস্ত মানুষ সন্ত্রস্ত।  এ যেন এক যোদ্ধার সহনক্ষমতার ধারণক্ষমতার পরীক্ষা।সব করছেন ম্যাকরন।  তাঁর কিছু ভুল কিছু ঠিক।  শুরুর দিকে মানুষের মাঝে নিজে পৌঁছে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন স্বাভাবিক জীবন সম্ভব।  আবার নিজেই ইটালির দিশায় না হেঁটে জোর কদমে রাষ্ট্রীয় মেশিনারির সাহায্যে স্তব্ধ করেছেন দেশকে।

সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্যারিস এবং তার আশপাশের অঞ্চল। সংক্রমণের সিংহভাগ সেখানেই। প্যারিসের পরই নিস ফ্রান্সের অন্যতম পর্যটন প্রাণকেন্দ্র। ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরার চোখের মণি। ইতিহাস সংস্কৃতি আনন্দ বিলাসবহুল পান খাওয়াদাওয়ার আয়োজনে উপচে পড়া ঝকঝকে স্বপ্ননগরী। প্রত্যেক বছর পঞ্চাশ লক্ষেরও বেশি পর্যটক আসেন এখানে। ফ্রান্সের চল্লিশ শতাংশ পর্যটক শুধুমাত্র নিসে আসেন রিভিয়েরার গ্রীষ্ম উপভোগ করবেন বলে। আর সঙ্গে আনেন পাঁচ বিলিয়ন ইউরোর রোজগার। কাজের সুবাদে এখানে থাকার একটা সুযোগ হয়েছে। ফ্ল্যাটের বারান্দা দিয়েই খানিকটা সমুদ্র সৈকতের পরিমণ্ডল উপভোগ করা যায়। তাই গত বছরও কী ভাবে মার্চের শেষ থেকেই সেজে উঠে শহর গ্রীষ্মের আগমনের উৎসাহে। এ বছর করোনার লকডাউন কেড়ে নিয়েছে প্রাণোচ্ছাসের সবটুকু। যেন এক আমরণ ডিপ্রেশান গ্রাস করেছে শহরটাকে। নিস টুরিজমের ওয়েবসাইট দেখলে বোঝা যায় শহর তথা সম্পূর্ণ রিভিয়েরার অর্থনীতি কি অসহনীয় ধাক্কা সহ্য করছে এই লকডাউনে।

এবার আসা যাক জার্মানির কথায়।  দুই হাজার আঠারো এর ফেব্রুয়ারি থেকে দুই হাজার উনিশ জানুয়ারি পর্যন্ত জার্মানির  ড্রেসডেন শহরে কেউ কাজ করলে জার্মান শৃঙ্খলাবোধ সম্বন্ধে খুব পরিষ্কার একটা ধারণা তৈরি হতে পারে। পুরনো বন্ধুরা যখন সপ্তা তিনেক আগে মাঠে নদীর পাড়ে একজোট হওয়া পার্টিরত জার্মানদের একের পর এক ভিডিও আর ছবি পাঠায়। তখন একটু অবাক হতে হয়। তার কদিন বাদেই মার্কেল সাহেবা যখন টিভিতে দেশব্যাপী লকডাউনের কথা জানালেন তখন খানিকটা স্বস্তি পেলেও মনে মনে একটা উৎকন্ঠা কাজ করে সবার। দেশের উপর সমগ্র ইউরোপের অর্থনীতি বেশ খানিকটা নির্ভরশীল তার পক্ষে চাইলেও এক রাতের মধ্যে সমস্ত প্রোডাকশন লাইন স্তব্ধ করে দেওয়া আত্মহননের সমার্থক। শেষ অবধি সে ভার রক্ষা করা সম্ভব হয়নি কারণ এই অন্ধকার সময়ে নিজের দেশের মানুষের জীবনের চেয়ে উপরে অর্থনীতিকে বসানো চলে না। কার্স্টেন জেস্কির মতো অনেকেই মনে করেন এই লকডাউনের ফলে ইউরোপিয়ান অর্থনীতির ধস আরও অনেকখানি বাড়বে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত যোগ হয়েছে হেসে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী শেফারের আত্মহত্যার খবর। এই ইন্ডিউসড ইকনমিক কোমার মধ্যেও কিন্তু জার্মানির কোভিড জনিত মৃত্যুর হার সর্বোচ্চ আক্রান্ত দেশগুলির মধ্যে সর্বনিম্ন। এর একটি প্রধান কারণ অবশ্যই আর্লি ডিটেকশান বা শুরুতেই সংক্রমন আটকানোর প্রক্রিয়া। দক্ষিণ কোরিয়ার মত চটজলদি না হলেও মার্কেল সরকারের ট্রেস টেস্ট ট্রিট পদ্ধতির ধীর কিন্তু সাবলীল গতির কাজ শুরু হয়ে অনেকদিন আগেই। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের রিপোর্ট অনুযায়ী একজনের কোভিড পরীক্ষার ফল ইতিবাচক ধরা পড়লে তার পরিবার ও বন্ধুস্থানীয় সমস্ত মানুষের উপর একে একে টেস্ট চালিয়েছে রাষ্ট্র। ফ্রান্স বা অন্যান্য সংক্রামিত ইউরোপীয় দেশের তুলনায় জার্মানির পরীক্ষা চালানোর ক্ষমতা কয়েক গুণ বেশি। সমসাময়িক রিপোর্টে জানা যায়- ফ্রান্স যেখানে দিনে সাত হাজার পরীক্ষা করতে পারে সেখানে জার্মানির সংখ্যাটা কুড়ি হাজারের বেশি। এছাড়াও ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটেও জার্মানি অনেকখানি এগিয়ে থাকায় সংকটাপন্ন অনেক রোগীই ভাল হয়ে উঠেছেন। আর এরই বিপরীতে ইটালি বেশ কয়েকদিন ধরেই সত্তর আশি বছরের মৃত্যুপথযাত্রী রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়ে।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। শুধু মহামারীতে নয় প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা দু দুটো বিশ্বযুদ্ধে মানুষ এই একই ভয়াবহতার সাক্ষী থেকেছে একাধিকবার। মানুষের যেচে তৈরি করা বিপর্যয়গুলো ইরাক যুদ্ধ বা তুরস্কের ক্যু পরবর্তী সময়ের মতো আস্তে আস্তে গা সওয়া হয়ে যায়। কারণ আমরা জানি আমরা চাইলেই আবার একই ভাবে একই জায়গায় একই স্থাপত্য দাঁড় করাতে পারি। অথবা জার্মানির মত নি:শব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালিমা মুক্তির আশায় বছরের পর বছর অন্যান্য দেশের যুদ্ধে সর্বস্ব হারানো মানুষগুলোর একটু বেঁচেবর্তে থাকার আর্জিটুকু মেটানোর চেষ্টা নিরলস ভাবে চালিয়ে যেতে পারি চাইলেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে? সমগ্র ইউরোপ বিগত শতাব্দীগুলোর মত আবার একটা নৃশংস প্রাকৃতিক হত্যালীলার উপকেন্দ্রে এসে দাঁড়িয়েছে নিরস্ত্র। তার সঙ্গে ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছে একটা অর্থনৈতিক ব্ল্যাকহোলে। এই শ্মশানযাত্রা মানুষের আয়ত্বের বাইরে।  ইতিহাস সাক্ষী শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত যুদ্ধ চালাবেন মার্কেল ও ম্যাকরনরা। সবশেষে এ অন্তর্জলীর অবসান হয়তো ঘটবে একটা প্রশ্নে এসে- আবার নয় তো?

এই একবিংশ শতাব্দীতেও বিশ্ব কি তবে আরও একবার আরও একটা মহামারীর যার সাবধানবাণী ইসিডিসি শুরুতেই জানিয়েছে মুখে চিকিৎসা শাস্ত্রের নতুন কোনও ইউরোপীয় বিস্ময় আবিষ্কারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। কেবল মাত্র সময়ই তার উত্তর জানে আর জানে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়তে লড়তেও মানুষের বাঁচতে চাওয়ার অদম্য ইচ্ছা।

প্রায় তিন সপ্তাহের ওপর হল বোধহয় টেক্সাসে শহর হিউস্টনে লকডাউন শুরু হয়েছে। অফিস আর স্কুল তো তারও আগে থেকে বন্ধ। চুমু হাগ বন্ধ বিধি নিষেধের শুরু থেকেই। সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং বজায় রাখার চেষ্টা ঘরে বাইরে। তা  আমরা যারা সিনেমায় নায়ক নায়িকা চুমু পেলে গাছের আড়ালে চলে যায় আর বদলে ফুলে ফুলে ধাক্কা  খায়  দেখে দেখে বড় হয়েছি তাদের আর ওসব নিয়ে অত চিন্তা কী।  চুমুর অতো চল নেই আমাদের রক্তে। আর  হঠাৎ করে কেউ হাগ করলেও কেমন যেন ঈদ ঈদ লাগে। যাই  হোক শুনলাম নাকি বেশ কিছু পরিবারে ছ ফিট দূরত্ব বজায় রাখতে বালিশ বগলে স্বামী স্ত্রীও আলাদা আলাদা ঘরে গিয়ে দরজা দিচ্ছেন। খেলা ছোটাছুটি বেয়াদপী সব বন্ধ এখন। কিন্তু কৌতূহল আমেরিকান প্রতিবেশীদের নিয়ে। তারা এ নিরামিষ আয়োজনে বাঁচে কী করে । পাড়ায় কারও বাড়ি থেকে আজ পর্যন্ত একটাও দাম্পত্য  ঝগড়ার আওয়াজ শুনিনি।  দুই গাড়ি নিয়ে দুজন কাজে  যাওয়ার আগে তাদের বরং নিজের ড্রাইভ ওয়েকে আইফেল টাওয়ার বলে মনে করে- সাত সকালে জবরদস্ত সব চুমু খেতে। গত বারো বছরে একই প্রতিবেশীর বার দুই  তিন সঙ্গী বদল হলেও চুমুর নিষ্ঠাতে  কিন্তু কোনওদিন  ঘাটতি হয়নি। কিন্তু এখন দৃশ্য অন্যরকম। চুমুতে লাল আর সব্বাই অচ্ছুত!

এমন সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং এর  সময় এক অদ্ভুত দৃশ্য। সে দারুণ ব্যাপার। আমার একদম পাশের  বাড়ি। মালিক মালকিন ছিল জেসিকা আর এলেন। যদিও তাদের  গল্প বলতে হলে বেশ খানিকটা ফ্ল্যাশব্যাকে যেতে  হবে। এ পাড়ায় বাড়ি কিনে আসতেই তাদের সঙ্গে প্রথম আলাপ। তখনও তারা বিবাহিত নয়। দুজনে মিলে নতুন বাড়ি কিনেছে। সংসার পাতব পাতব করছে। বিয়ের জন্য নাকি নানা ব্যস্ততায় সময় করে উঠতে পারছে না। কোল যদিও একেবারে ফুল কুসুমিত। দশমাসের ফুটফুটে বাচ্চা ড্যানিয়েল। খুব তাড়াতাড়ি জেসিকা ও অ্যালেন দুজনেই আমাদের অতি নির্ভরযোগ্য প্রতিবেশী হয়ে উঠল। ড্যানিয়েল অর্ধেক সময় আমাদের বাচ্চাদের সঙ্গেই আমাদের বাড়িতে লুচি চিনি ডিমসেদ্ধ ঘি ভাত খেয়ে বড় হতে লাগল। দিনে দিনে আমাদের দু বাড়ির সম্পর্ক এমন হল যে-  হঠাৎ করে রাতের দিকে কারও চিনি তেল চাল ডিম ফুরোলে দুই পরিবারই আমাদের বাচ্চাদের হাতে বাটি কাপ ধরিয়ে পাঠিয়ে দিতাম একে অন্যের বাড়ি। ড্যানিয়েলের জন্মদিনে পায়েস বানিয়ে দিতে বলত  অ্যালেন।  ইতিমধ্যে তার বছর চারেক বয়স হলে তার বাবা মা এক সুযোগে টুক করে বিয়েটা সেরে ফেলে। তাদের আর একটি ফুটফুটে বাচ্চা হয়। দুটো কুকুর দুটো বাচ্চা নিয়ে তখন ভরা সংসার। জেসিকাদের বাড়িতে গেলেই দেখা যায়- সংসার চাকর সন্তানপা লন সবেতেই দুজনার সমান ভাগ। অ্যালেন ব্যাকইয়ার্ডে ডেক বানাচ্ছে তো জেসিকা স্টাডিরুমের দেওয়াল রং করছে। বাড়ির সব বিল পেমেন্টেও দুজনার সমান ভাগ। অ্যালেন পশুপ্রেমী নিরামিষাশী। বাংলাদেশের খাবার খেতে খুব পছন্দ করে। জেসিকা আবার কোনও মশলাদার খাবারই মুখে তুলতে পারে না। অ্যালেন সকালে বড় কালো কুকুরকে নিয়ে হাঁটে তো জেসিকা বিকেলে ছোট্ট সাদা কুকুর নিয়ে দৌড়তে বেরোয়। দুজনেই পাগলের মতো ভালোবাসে সঙ্গ। আর দুজনেই দুজনকে  নিয়ম করে লম্বা চুমু খায় মুহুর্মুহু। তখন তাদের প্রেম হ্যাংলা চোখে দেখি আর মাঝে মধ্যেই  আমার ঘরের লোকটিকে এসে বলে যাই- ওগো- অমন প্রেম আমার হল না কেন?

সে আমার দিকে না তাঁকিয়ে উত্তর না দিয়ে টিভির নিউজ শুনতে থাকে। ওমা। এমন করে কয়েক বছর দিব্যি চলতে চলতে বছর দুয়েক আগে  হঠাৎ দেখি  সাতমহলা স্বপ্নপুরীর নিভল হাজার বাতি। এলেনের মুখ থমথমে। জেসিকার মেজাজ খিটখিটে।  ড্যানিয়েল এসে চুপিচুপি আমার ছেলেদের বলে গেল – মম এন্ড ড্যাড বোথ ওয়ান্ট টু  লিভ সেপারেটলি। এর পরেই শুনলাম জেসিকা এ পাড়াতেই একটু দূরের গলিতে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। এলেন একা থাকতে শুরু করে। 

জেসিকার টাকায় যে ফার্নিচারগুলো কেনা হয়েছিল সেগুলো এ বাড়ি থেকে উবে গিয়ে মেঝে খাবলা খাবলা ফাঁকা হয়ে থাকল। কালো কুকুর পড়লে এলেনের ভাগে । সাদা কুকুর চলে গেল  জেসিকার কাছে । ছেলে মেয়েও ভাগ হল। সোম থেকে বৃহস্পতি সকাল মা বৃহস্পতিবাার বিকেল থেকে সোমবার সকাল বাবা। কিছুই বুঝতে পারলাম না কী হল। ওরাও নিজে থেকে ভেতরের খবর তেমন কিছু বলল না। শুধু জানালো একেবারেই বনিবনা হচ্ছে না। হয়তো ডিভোর্সই হয়ে যাবে। তার আগে কিছুদিন আলাদা থেকে দেখতে চায় দুজনে। তারও পরে একদিন শুনি- এককালে যেমন বিয়ে করতে তারা সময় পাচ্ছিল। সেই সময়াভাবেই ডিভোর্সটাও হয়ে উঠছে না। এর মধ্যে না চাইতেও জেসিকা এলেন দুজনারই স্পাই হয়ে উঠি । এলেন সকালে বলে -জেসিকার সঙ্গে পার্কে দেখা হলে গল্পে গল্পে একটু জিজ্ঞেস করে দেখো তো  নতুন কাউকে পেল কিনা? জেসিকা সন্ধ্যেবেলা ফোন করে বলে- একটু তোমার ড্রাইভওয়েতে গিয়ে উঁকি মেরে দেখে বলো তো এলেনের বাড়ির সামনে কোনো গাড়ি দাঁড় করানো আছে কিনা?

এমনই  চলছিল গত প্রায় দুবছর। ওমা। হঠাৎ করে আবার সপ্তাহ দুয়েক আগে দেখি এক পিক আপ ট্রাক থেকে লোটাকম্বল নামাচ্ছে  জেসিকা। তড়াং করে সেটা থেকে লাফ দিয়ে নামল সাদা কুকুর ও দুই বাচ্চা। হাঁটতে বেরিয়ে তার দিন দুয়েক পরে দেখি- বাড়ির দরজা খোলা। জেসিকা ভেতরে বাড়ি পরিষ্কার করছে দেখা যাচ্ছে।  খাবলা মেঝে আবার ফেরত আসা জিনিসে ভরে গেছে। আমাদের ব্যাকইয়ার্ডের পাশেই তাদের ব্যাকইয়ার্ডে  সাদা কুকুর কালো কুকুর আবার একসঙ্গে দাপাদাপি করে খেলছে। বাড়ির সামনে জেসিকা ছোট ছোট গোলাপের চারা পুঁতছে। ড্রাইভওয়েতেই  একটু অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে একটু ইত:স্তত করে জিজ্ঞেস করে- তোমার কাছে  এক্সট্রা একদুটো ফ্রোজেন সামোসা হবে? এলেনকে ভেজে দেব?

আমি বললাম- হ্যাঁ আছে। এক্ষুনি দিয়ে যাচ্ছি তোমার দরজার সামনে। গ্লাভস  পরে নিয়ে প্যাকেট ওয়াইপ করে নিও।  কিন্তু তোমাদের কি ব্যাপার বলো তো এই দুবছর পরে? একসঙ্গে থাকছ নাকি আবার?

একটু আমতা আমতা করে এবার জেসিকার উত্তর- হ্যাঁ। মানে ডিভোর্স তো হয়নি আমাদের এখনও আর  দুজনেই সত্যি আর কোনও নতুন সম্পর্কেও  জড়াইনি। আসলে আমাদের ছোট বড় কোনোওকিছুতেই মতে মিলতো না- ঝগড়া হতো। একা থাকছিলামও দিব্যি।  কিন্তু এই করোনার জন্য স্কুল অফিস এতোদিন বন্ধ থাকবে। ওয়ার্ক ফ্রম হোম। বাচ্চাদেরই বা একা একা সামলাই কি করে? চাকরি বাকরিও এর পরে থাকবে কিনা সন্দেহ। খরচ খরচা সব ভেবে আমার ওই  ভাড়াবাড়ি ছেড়ে দিচ্ছি। এখানেই থাকব। এলেনও তাই চায়।   এতদিন পর নিজে থেকে ফিরে আসতে বলল- জানো। বাচ্চারাও খুব খুশি। লেট আস ট্রাই ওয়ান্স মোর।

পরদিন বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে দেখি- এলেন জেসিকার ড্রাইভওয়েতে আবার আইফেল টাওয়ার গজিয়েছে।  দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বিশালাকার চুমু আবার। তারাও হাঁটতেই বেরোচ্ছে একসঙ্গে।  দেখতে দেখতে মনে  হল দে উইল লিভ হ্যাপিলি এভার আফটার।

লকডাউন তো চলছে। প্রশাসনিক তরফে বার বার বলাও হচ্ছে ঘর থেকে না বেরোতে। অথচ প্রায় প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে সকাল হতে না হতে থলি হাতে ব্রেড দুধ ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের সন্ধানে বাজারে ছুটছেন বাড়ির কর্তা। তাই করোনা ভাইরাস নিয়ে সচেতনতা থাকলেও ঝুঁকি কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। আবার বয়স্ক মানুষ যাদের পক্ষে এইসময়ে ঘরের বাইরে যাওয়াটাও রীতিমতো চ্যালেঞ্জ, এমনকি পরিচারিকা পরিচারকহীন বাড়িতে রান্না বান্না করাটাও বেশ দুস্কর তাদের অবস্থা হয়ে দাঁড়াচ্ছে আরও সঙ্গীন। এইসব সমস্যার কথা ভেবেই এবারে শহরের বিভিন্ন আবাসনগুলিতে তাদের  পাউরুটির পসরা নিয়ে হাজির হয়ে যাচ্ছে কলকাতার অন্যতম ঐতিহ্যশালী বেকারি, ফ্লুরিজ।

চব্বিশ তারিখ লকডাউনের ঘোষণার আগেই এই রাজ্যে পাঁউরুটির একটা ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। কিন্তু ব্রেড তো আমাদের অত্যাবশ্যকীয়  পণ্যগুলির অন্যতম। রেডিমেড খাবার হিসেবে এইসময় বাড়িতে মজুত থাকাটা জরুরিও। সেই ব্রেড এইভাবে বাজারে আসা বন্ধ হয়ে যাওয়াতে মানুষ বিপদে পড়ে যান। সেটা দেখেই আমরা ভাবতে শুরু করেছিলাম কী করে এটাকে সামলানো যায়। এদিকে যেহেতু কারফিউ চলছে। কারও পক্ষে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয় আর যেহেতু আমাদের মধ্যে অনেকেই শহরের বিভিন্ন আবাসনগুলিতে থাকেন সেখান থেকেই আমরা ভাবতে শুরু করলাম কেমন হয় যদি আমরা আমাদের ফুড ট্রাকে করে পাঁউরুটি সোসাইটিগুলোতে মানুষের কাছে পৌছে দিই। যেমন ভাবা তেমন কাজ। আর সেখান থেকেই শুরু। এখন তো এমনও হচ্ছে ব্রেড ফুরিয়ে যাচ্ছে বার বার করে নিয়ে যেতে হচ্ছে। আমাদের মিল্ক ব্রেড ব্রাউন ব্রেড আর হোয়াইট স্যান্ডউইচ ব্রেডের এতই চাহিদা। বলছিলেন ফ্লুরিজের এক্সিকিউটিভ শেফ বিকাশ কুমার।

ইতিমধ্যেই সাউথ সিটি আরবানা, অভিষিক্তা, গ্রীনউড নুক, হাইল্যান্ড পার্ক ও অভিদীপ্তার মত আবাসনগুলিতে তাদের ফুড ষ্টল দিয়ে ব্যাপক সাড়া পেয়েছে ফ্লুরিজ। যতটা আশা করা হয়েছে তার থেকে অনেকটাই বেশি চাহিদা দেখতে পাচ্ছি। এমনও হচ্ছে আবাসনের মানুষের প্রয়োজন মেটাতে একই আবাসনে বার বার যেতে হচ্ছে। এমনকি তাদের অনুরোধে কেক কুকিজ প্যাটি পেস্ট্রিও নিয়ে যেতে হচ্ছে। এইভাবে আমরা এই কঠিন সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারছি বলে ভালোও লাগছে বললেন বিকাশ।

তিরানব্বই বছরের পুরনো এই সংস্থা শহরের ইট কাঠ পাথরের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে বহুদিন। তাই শহরের মানুষের পাশে দাঁড়াতে বেশি ভাবতে হয়নি ফ্লুরিজকে। এমনকি ফুটপাথবাসী এবং ঘরহীন মানুষের জন্যও তারা ভেবেছেন। পুলিশের সহযোগিতায় ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে সেকাজ। প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায় পাউরুটি ও বেকারির কেক ও শুকনো খাবার বিলি করা হচ্ছে। এছাড়াও শহরের বিয়াল্লিশটি স্টোরের মধ্যে দুটি খোলা হয়েছে ও আরও কয়েকটি খোলার জন্য প্রশাসনের কাছে অনুমতি চাওয়া হয়েছে যাতে এই বিপদের দিনে কিছুটা হলেও মানুষের জীবন সহজ করে দেওয়া যায়।

লকডাউনের থোড় বড়ি খাড়াতে অনায়াসে একটু বৈচিত্র আনতে আর ইস্টার সানডেতে বাড়ির ছোটদের গোমড়া মুখে হাসি ফোটাতে নিজের স্পেশাল রেসিপিও শেয়ার করলেন সেলেব্রিটি শেফ বিকাশ কুমার।

হোমমেড চকোলেট ফাজ উইথ টোস্টেড আমন্ড ভেজে গুঁড়ো করে রাখা আমন্ড বাদাম একশো পঞ্চাশ গ্রাম মিষ্টি কনডেন্সড মিল্ক– এক ক্যান মোটা করে কুচি করা ডার্ক চকোলেট পঞ্চাশ গ্রাম মাখ ত্রিশ গ্রাম ভ্যানিলা দশ মিলি লিটার চা চামচপ্রণালী প্রথমে বেকিং পাত্রটিতে নিচে ও চারিদিকে ভালো করে ফয়েল পেপার দিয়ে লাইন করে নিতে হবে।এরপরে একটি স্টেনলেস স্টিলের পাত্রে কনডেন্সড মিল্ক ডার্ক চকোলেট ও মাখন একসঙ্গে নিয়ে একটি সসপ্যানের অল্প অল্প ফুটতে থাকা জলে দিয়ে নাড়তে থাকতে হবে। খুব সাবধানে ঘন ঘন মাঝাড়ি আঁচে নাড়তে থাকতে হবে। যাতে বেশি গরম না হয়ে যায়। একটা সময় মিশ্রনটি ঘন ও মসৃন  হয়ে যাবে। তখন মিশ্রনটিকে ওভেন থেকে সরিয়ে মিশ্রনটিতে ভ্যানিলা ও গুঁড়ো করে রাখা আমন্ড বাদাম দিয়ে দিতে হবে।

এবারে আগে থাকতে প্রস্তুত করে রাখা বেকিং ট্রেতে ফজের মিশ্রনটি ঢেলে দিতে হবে। একটি চওড়া এবং পাতলা হাতা বা খুন্তির সাহায্যে ওপরটা যতটা সম্ভব মোলায়েম করে দিতে হবে। এই অবস্থায় ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রেখে দিতে হবে ঠান্ডা করতে। ঠান্ডা হয়ে গেলে ফয়েলের কোনগুলি ধরে খুব সাবধানে ফজ বার করতে হবে এবং ছুরির সাহায্যে ছোট ছোট টুকরো করে নিতে হবে। সার্ভ করার আগেই কিছুক্ষণ ফ্রিজে রেখে তারপরে পরিবেশন করতে হবে।

(চলবে)