করোনাভাইরাস সৃষ্ট মহাদুর্যোগের কারণে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তা-দুশ্চিান্তার কারণে স্বভাবতই মন বিক্ষিপ্ত থাকে এবং রাতে ঘুম কম হয়। আগের রাতে এক ফোঁটাও ঘুম না হওয়ায় শনিবার প্রায় সারাদিনই ঘুমালাম। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে ফেসবুক খুলতেই চোখে পড়লো সরকারি কর্মকর্তা এক বড় ভাইয়ের পোস্ট। দুটো ছবিতে দেখলাম হাজার হাজার মানুষ রাস্তায়। প্রথমে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারিনি। আবার দেখলাম। যাচাই করার জন্য কয়েকটি নিউজ পোর্টালে ঢুকলাম। ফেসবুকে স্ক্রল করতে করতে দেখলাম নিউজফিড সেই সব ছবিতে সয়লাব। ততোক্ষণে সংবাদমাধ্যমগুলোতেও খবর আসতে শুরু করেছে, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক মাওলানার জানাজায় হাজার হাজার মানুষের সমাগম’।
রাগে, দুঃখে, কষ্টে, হতাশায় নিজেকে খুবই বিপন্ন মনে হলো। করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বই যখন বিপর্যস্ত তখন এরকম কাণ্ডজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ড ঘটে কী করে? করোনার এ আতঙ্কের মধ্যেও গত দুই সপ্তাহ যাবৎ ওই জেলায় যা ঘটে চলেছে, তা রীতিমতো লোমহর্ষক, ভীতিকর এবং করোনা বিস্তারের ক্ষেত্রে খুবই সহায়ক। পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বক্তব্য এলো ‘আসলে এতো মানুষের জমায়েত হয়েছে যে আমাদের কিছু করার ছিলো না।’ উপজেলা নির্বাহী অফিসার বলছেন, তার কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া হয়নি!
করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সারাদেশই যখন কার্যত লকডাউনে, সৌদি আরবসহ অন্যান্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের ধারাবাহিকতায় ধর্মীয় উপাসনালয়ে জনসমাগম সীমিত করার বা বন্ধ করার নির্দেশনা এসেছে সরকারের তরফ থেকে, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সেনাবাহিনী যেখানে ঘাম ঝরিয়ে চলেছে, সেখানে হাজার হাজার মানুষের এমন সমাবেশ ঘটে কী করে? পরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং স্থানীয়দের ভাষ্যে জানতে পারলাম, সেখানে শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকজনই জমায়েত হননি, এই কড়াকড়ির মধ্যেও আশেপাশের জেলা এমনকি ঢাকা থেকেও ট্রাকে করে লোকজন সেখানে গিয়েছে। এমন এক জমায়েত যা পুরো দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার এবং গোটা দেশে করোনার ভয়ঙ্কর বিস্তারের ঝুঁকি আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
সারাদেশেই কম-বেশি ছড়িয়ে পড়া ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় উগ্রতার যে ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে ব্রাহ্মণবাড়িয়া তার অগ্রভাগে। তাই স্বাভাবিকভাবেই আলোচনা-সমালোচনা ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে নিয়েই বেশি হচ্ছে।
২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ফেসবুকে কথিত একটি ইসলাম-বিদ্বেষী ছবি পোস্ট করার অভিযোগে নাসিরনগরে হিন্দুদের অন্তত ৫টি মন্দির ও বহু বাড়িঘর ভাংচুর করা, ২০১৮ সালের ৬ অক্টোবর চিশতি বাউলের ওপর হামলা এবং তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে প্রাণঘাতি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ায় গত কয়েক বছর যাবত নিয়মিতই নেতিবাচকভাবে সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে জনপদটি। সর্বশেষ, লকডাউন ভেঙে গত ৩১ মার্চ বিশাল সংখ্যক মানুষের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া এবং সারাদেশে করোনা পরিস্থিতির ধারাবাহিক অবনতির মধ্যেই একজন মাওলানার জানাজায় হাজার হাজার মানুষের জমায়েত (কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম বলছে সংখ্যাটা লাখ ছাড়িয়ে যাবে) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে।
অথচ এই জনপদেই জন্ম নিয়েছেন সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, ব্যারিস্টার এ রসুল, নবাব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা, কথা সাহিত্যিক অদ্বৈত মল্ল বর্মণ, কবি আবদুল কাদির, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার পুরোধা ব্যক্তিত্ব কবির চৌধুরী ও মুনির চৌধুরী ভ্রাতৃদ্বয়সহ বহু জ্ঞানী গুণী; যারা পুরো বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির অগ্রণী ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বীকৃত।
কিন্তু এক সময়ের শিল্প-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ এ জনপদটির কেন এ উল্টোযাত্রা? কেনই বা এতো গোঁড়ামি, উগ্রতা সেখানে দানা বেঁধেছে এমন কদাকারভাবে? আচ্ছা, জেলাটির নাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে বিকৃত হয়ে বি বাড়িয়া হয়ে গেল কী করে? শুধুই কি সংক্ষেপণ নাকি অন্য কোনো কারণ আছে? যদি সংক্ষেপণই কারণ হয় তাহলে মৌলভী বাজারের নামও তো এম বাজার হওয়ার কথা ছিলো।
১৮৬০ সালে মহকুমা এবং ১৯৮৪ সালে জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত জনপদটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে বি বাড়িয়া কীভাবে হলো সে সম্পর্কে ঘেটে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পেলাম না। কিন্তু জনপদটির নামকরণের ইতিহাস ঘাটতে গিয়েও একটি বিতর্কিত বিষয় চোখে পড়লো।
সরকারি ওয়েবসাইটে (http://www.brahmanbaria.gov.bd/) জেলাটির নামকরণের ইতিহাস অংশে লেখা ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নামকরণ নিয়ে একাধিক মত রয়েছে। শোনা যায়, সেন বংশের রাজত্বকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অভিজাত ব্রাহ্মণকুলের অভাবে পূজা-অর্চনায় বিঘ্ন সৃষ্টি হতো। এ কারণে রাজা লক্ষণ সেন আদিসুর কন্যকুঞ্জ থেকে কয়েকটি ব্রাহ্মণ পরিবারকে এ অঞ্চলে নিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে কিছু ব্রাহ্মণ পরিবার শহরের মৌলভী পাড়ায় বাড়ী তৈরী করে। সেই ব্রাহ্মণদের বাড়ীর অবস্থানের কারণে এ জেলার নামকরণ ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন।
অন্য একটি মতানুসারে দিল্লী থেকে আগত ইসলাম ধর্ম প্রচারক শাহ সুফী হযরত কাজী মাহমুদ শাহ এ শহর থেকে উল্লেখিত ব্রাহ্মণ পরিবার সমূহকে বেরিয়ে যাবার নির্দেশ প্রদান করেন, যা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়।’ পরষ্পর সাংঘর্ষিক এই দুই মতকে ভিত্তি ধরলে সাম্প্রদায়িক দাপটের একটি ইতিহাস স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সাম্প্রতিককালে জেলাটিতে জন্ম নিয়েছেন অনেক অনেক কথিত ইসলামী বক্তা যারা বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে বারবার আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে আসেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্যকে পাশ কাটিয়ে বর্তমান সময়ে ওই জনপদটির বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ এসব কথিত বক্তার দ্বারাই বেশি প্রভাবিত বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
বিভিন্ন বিতর্কের জন্ম দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে বটে কিন্তু বাংলাদেশের বেশিরভাগ জনপদেই ধর্মীয় উগ্রবাদিতা, কুসংস্কার আচ্ছনতা বেড়েছে বহুগুণে, যা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে উঠেছে। শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়াই নয় পুরো দেশ জুড়েই এসব কথিত বক্তাদের দাপট আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এসব বক্তা মনগড়াভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যকে খেয়াল-খুশি মতো ফতোয়া দিয়ে বাতিল করে দিচ্ছে এবং সাধারণ জনগণ তাদের বক্তব্যকেই বিশ্বাস এবং আচরণের ভিত্তি ধরছে। এটিই যেন পুরো বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতার চিত্র হয়ে উঠেছে।
অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া দেশের কেন এ উল্টোযাত্রা, সে সম্পর্কে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে গভীরভাবে ভাববার সময় এসেছে। প্রয়োজন দেখা দিয়েছে এই কুপমণ্ডুকতা থেকে বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে বের করে নিয়ে আসার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা পন্থা অবলম্বনের।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)